আরিফ কাটিং সেন্টার!

করোনাকালে গৃহবন্দী জীবনে আরিফ সাহেব একটা বিষয়ে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন বলা বাহুল্য। সেটা হচ্ছে কাটাকুটি। স্ত্রীকে রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করতে তিনি শাকসবজি, মাছ-মাংস—সবকিছু কেটেকুটে সাইজ করে দেন। এমন নয় যে আগে তিনি এসবে পারদর্শী ছিলেন। এই করোনাকালে করতে করতে দিব্যি পারদর্শী হয়ে উঠেছেন এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাজটা তার ভালোই লাগে। বেশ ভালো লাগে।

ছিলানোর একটা ছোট্ট যন্ত্র আছে। সেটা দিয়ে লাউ, পটোল, আলু, চিচিঙ্গা, ডাঁটা—সব সুন্দরভাবে ছেলা যায় এবং দ্রুততম সময়ে। আরিফ সাহেবের দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে এই ছিলানোর অসামান্য যন্ত্রটি যে আবিষ্কার করেছে, তাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া খুবই জরুরি, নিদেনপক্ষে বিকল্প নোবেলও দেওয়া যেতে পারে। আসলে কত প্রতিভাবানের যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাহোক, সেই যন্ত্র দিয়ে ছিলানোর পর কাটিং বোর্ডে ছুরি দিয়ে আলু, পটোল, লাউ সাইজ করতেও বেশ লাগে আরিফ সাহেবের। এই করতে করতে তিনি মুরগি, মাছ, মাংস কাটতেও ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে উঠলেন যেন।

একদিন স্ত্রীকে বললেন, আচ্ছা, ফেসবুকে একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়?

কিসের বিজ্ঞাপন?

যেকোনো ধরনের কাটাকুটিতে আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত, এই টাইপের।

স্ত্রী ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, বোঝার চেষ্টা করলেন তার স্বামী সিরিয়াস না ঠাট্টা করছে। তবে তার কন্যা বেশ উত্সাহ দিল।

হ্যাঁ বাবা, দারুণ হবে। তুমি ফেসবুকে একটা পেজ খোলো কাটাকুটির ওপর। সেটাতে দেওয়া থাকবে, তুমি যেসব ধরনের কাটাকুটিতে মাস্টার হয়ে উঠেছ।

সত্যি বলছিস?

অবশ্যই। আমি তোমাকে পেজ খুলে দেব, দাঁড়াও।

ব্যাপারটা ঠাট্টা-তামাশার মধ্যেই ছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তার মেয়ে তাকে না জানিয়ে ফেসবুকে একটা পেজ খুলে ফেলল ‘মি. আরিফ কাটিং সেন্টার’ নামে। আর কী আশ্চর্য, পরদিনই একজন নক করে বসল, জরুরি ভিত্তিতে তার কাটাকুটির হেল্প দরকার।

ওয়াও! মেয়ে আনন্দে চিত্কার করে উঠল। বাবা, তোমার ফার্স্ট কাস্টমার। এক্ষুনি রওনা হও।

না। খবরদার, করোনার সময় বাইরে যাওয়া যাবে না। মা হুংকার দিলেন।

কিন্তু দিস ইজ বিজনেস, মা। বাবার ফার্স্ট অফার। বাবার যাওয়া উচিত। মাস্ক পরে যাবে।

শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তাভাবনা করে ডাবল মাস্ক পরলেন, একটা ব্যাগে ভরলেন কয়েক ধরনের ছুরি, ছিলানোর সেই বিখ্যাত যন্ত্র জিগজাগ কাঁচি, কাটিং বোর্ড। এসব নিয়ে রওনা হলেন এক সকালে। তার আগে অবশ্য তার ক্লায়েন্টকে ফোন দিলেন। গলা শুনে বোঝা গেল, যথেষ্ট ভদ্রলোক। তবে গলাটা কেমন খাঁজকাটা খাঁজকাটা মনে হলো। মানে কেমন যেন খড়খড়ে।

ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখেন একটা ফাঁকা মাঠ। আশপাশে কোনো বাড়িও নেই। ঢাকা শহরে এমন জায়গাও আছে তাহলে। ঠিক তখন তার ফোন বেজে উঠল। সেই খড়খড়ে গলা বলল, আরেকটু সামনে এসে বাঁয়ে ঘুরুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

তা–ই করলেন আরিফ সাহেব। তখন দেখলেন, যা দেখলেন, তা না দেখলেই বোধ হয় ভালো হতো। তিনি তার পায়ের জোর হারিয়ে ফেললেন। মনে হচ্ছে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবেন। তার সামনে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা চাকতির মতো জিনিস। হ্যাঁ, একটা ইউএফও বা সসার। তার থেকেও বিস্ময় হচ্ছে, সেই চাকতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ রঙের মানুষের মতো একটা প্রাণী। তার হাতে অদ্ভুত একটা যন্ত্র। বোধ হয় ফোনটোন–জাতীয় কিছু কিংবা লেজারগানও হতে পারে।

আমি এনড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে এসেছি। তোমাদের ভাষায় আমি একজন এলিয়েন। আবার আমার কাছে তুমিও একজন এলিয়েন।

আ-আপনি বাংলায় কথা বলছেন কীভাবে?

আমার সঙ্গে ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার আছে। সে যাহোক, যে কারণে তোমাকে ডেকেছি। তুমি তো কাটিং মাস্টার, তাই না। সব ধরনের কাটাকুটিতে পারদর্শী?

জি জি।

শোনো তাহলে, আমি স্যাম্পল হিসেবে পৃথিবী থেকে একটা মানুষ নিয়ে যেতে চাই। এই যে দেখো...। আরিফ সাহেব দেখলেন, আগে খেয়াল করেননি। এলিয়েনটার পেছনেই একটা ট্রলির ওপর একটা লোক শুয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে মৃত। চেহারাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু আস্ত লোকটাকে এভাবে নেওয়া যাবে না। একে কেটেকুটে এই বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে হবে। দেখতেই পাচ্ছ, আমি একটা ছোট স্পেসশিপে করে এসেছি। তোমাদের বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ শক্তিকে সুইংবাই করে আসতে হলে এর চেয়ে বড় স্পেসশিপে আসা যায় না।

কি-ক্কি বলছেন আপনি এসব? এই লোক কি মৃত?

হ্যাঁ, তোমাদের ভাষায় এই মুহূর্তে মৃত। তবে আমাদের গ্রহে নিয়ে আমি তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে নেব। এটা ওখানে কোনো বিষয় নয়।

কী বলছ এসব পাগল–ছাগলের মতো? তুমি একটা মরা মানুষকে কেটেকুটে নিয়ে গিয়ে প্রাণ সঞ্চার করবে? ইয়ার্কি পেয়েছ? রেগে গিয়ে আরিফ সাহেব তুমি বলতে শুরু করলেন।

এই পর্যায়ে এলিয়েনটা হা হা করে হাসল। বলল, বুঝতে পারছি, তোমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এখনো অনেক পিছিয়ে আছ। শোনো, তাকে কেটেকুটে নিয়ে গেলেও তার সব অণু-পরমাণু তো সঙ্গে করে নিয়েই যাচ্ছি, তাই না? ওখানে গিয়ে রি–অ্যারেঞ্জ করতে লাগবে তোমাদের পৃথিবীর সময়ে মাত্র দুই মিনিট। নেহাত জায়গা হচ্ছে না দেখে কাটাকুটি করতে হচ্ছে। শুরু করো, আমার হাতে সময় কিন্তু খুব বেশি নেই।

দেখো, আমি এসবের মধ্যে নেই।

কিন্তু তুমি তো তোমার এফবির পেজে লিখেছ সব ধরনের কাটাকুটিতে তুমি বিশেষ পারদর্শী।

তাই বলে মানুষ কাটাকুটি? আমি এক্ষুনি ৯৯৯–এ ফোন দিচ্ছি। পুলিশ এসে তোমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।

ফোন দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি এখানে সব নেটওয়ার্ক জ্যাম করে রেখেছি। শোনো, তুমি যদি কাজটা করে দাও, তোমাকে করোনা ভ্যাকসিনের ফর্মুলা দিয়ে যাব। ওটা বিক্রি করে তুমি বিলিয়নিয়ার হয়ে যাবে।

আমার বিলিয়নিয়ার হওয়ার দরকার নেই। তুমি তো ওকে আগে মেরেছ? তাই না?

হ্যাঁ। বলেছি তো ওকে আমাদের গ্রহে নিয়ে ফের বাঁচিয়ে তুলব।

আমি জানব কীভাবে, তুমি তোমার গ্রহে নিয়ে ওকে বাঁচিয়ে তুলেছ?

বাহ্, এনটেঙ্গলমেন্ট পড়োনি? কোয়ান্টাম ফিজিকসে? বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে বুঝে যাবে, আই মিন খবর পেয়ে যাবে তুমি মুহূর্তে..., সে রকম একটা ব্যবস্থা আমি করে যাব তোমার সঙ্গে। আলোর বেগের আগেই তোমার কাছে তথ্য চলে আসবে!

দেখো, আমাকে এনটেঙ্গলমেন্ট বোঝাতে এসো না। আমি রিটায়ার করলেও এখনো একটা প্রাইভেট কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়াই।

তাহলে তো বুঝতেই পারছ তুমি কীভাবে খবর পেয়ে যাবে।

কিন্তু তুমি ওকে খুন করেছ। এটা এই মুহূর্তে পৃথিবীর আইনে গুরুতর অপরাধ।

তাহলে সে অপরাধে তুমিও অপরাধী। আমরা দুজন মিলেই খুন করেছি।

মানে?

তুমি এখন এই ঘটনার অবজারভার, এই মহাবিশ্বে অবজারভার না থাকলে কিছুই হয় না বা ঘটে না। কেন, এ নিয়ে তো তোমাদের আইনস্টাইন সাহেব জঙ্গলে গাছ পড়ার একটা গল্প বলেছিলেন না? কিংবা সেই আকাশের চাঁদের প্যারাডক্সটা!

এই সময় হঠাৎ আরিফ সাহেব কী মনে করে একটু এগিয়ে গিয়ে লাশটা দেখে চমকে উঠলেন। আরে, এ তো তার অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার আলিম। তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে, এ তো কেয়ারটেকার আলিম, আমার অ্যাপার্টমেন্টের এক বছরের ইউটিলিটি বিল, ইলেকট্রিক বিল, পানির বিল—সব মিলিয়ে দুই লাখ টাকা নিয়ে ভেগে গিয়েছিল।

এ তোমার চেনা?

অবশ্যই, একে জলদি বাঁচিয়ে তোলো। এর সঙ্গে আমার হিসাব–নিকাশ আছে।

কিন্তু...

আবার বলে কিন্তু, ওকে জলদি বাঁচাও, নইলে তোমার লাশ পড়ে যাবে। আরিফ সাহেব তার ব্যাগ খুলে সবচেয়ে বড় ছুরিটা বের করে প্রায় তেড়ে যান এলিয়েনের দিকে।

আচ্ছা আচ্ছা, দাঁড়াও দাঁড়াও। বলে ছুটে গিয়ে সসারের ভেতর ঢুকে পড়ে এলিয়েনটা । আর সঙ্গে সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হতে থাকে। তারপর মুহূর্তে সসারটা শূন্যে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়!

হায় হায়, ব্যাটা তো ভেগে গেল মনে হচ্ছে।

এই সময় ট্রলিটা দুলে উঠল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল আলিম। হঠাৎ আরিফ সাহেবকে দেখে যেন পিলে চমকে গেল তার। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বলল, স্যা-স্যার, আপ-আপনে এইখানে?

কেয়ারটেকার আলিম জমি বেচে আরিফ সাহেবের দুই লাখ টাকা শোধ করে পুনরায় কেয়ারটেকারের চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছে। তবে সে একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। এলিয়েন তাকে অজ্ঞান করার আগে (বা সাময়িক হত্যার আগে) সে তার সঙ্গে একটা সেলফি তুলেছিল। সেই সেলফি এখন ফেসবুকে ভাইরাল!

আর আরিফ সাহেবও এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, অবজারভার না থাকলে যে কিছু ঘটে না, এই মহাবিশ্বে...এটা চরম সত্যি একটা প্যারাডক্স!