লায়ার!

সাবধানে চুরুট ধরালেন আলফ্রেড ল্যানিং। তিরতির করে কাঁপছে তার আঙুলের ডগা। চুরুটে টান দেওয়ার সময় প্রতিবার কুঁচকে যাচ্ছে ধূসর ভুরুজোড়া।

‘মানুষের মন পড়তে পারে ওটা। কিন্তু কেন?’ গণিতবিদ পিটার বোগার্টের দিকে ফিরে বললেন তিনি।

দুই হাতে কালো চুল সমান করতে করতে বোগার্ট বলল, ‘ওটা ৩৪ নম্বর আরবি মডেল, ল্যানিং। বাকিগুলো সব সাধারণ রোবট ছিল।’

টেবিলে বসা তৃতীয় মানুষটি এ কথা শুনে ভুরু কোঁচকাল। ইউএস রোবট অ্যাম্প; মেকানিক্যালম্যান, ইনকরপোরেশনের সবচেয়ে কমবয়সী অফিসার মিল্টন অ্যাশ। পদের গর্বে মাটিতে পা পড়ে না তাঁর।

‘অ্যাসেম্বলিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো গাফিলতি ছিল না। এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।’

তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল বোগার্টের ঠোঁটে। ‘তাই নাকি? গোটা অ্যাসেম্বলির ঠিক থাকার নিশ্চয়তা যদি তুমি দিতে পারো, তোমার প্রমোশনের জন্য সুপারিশ করব আমি। কেবল একটা পজিট্রনিক ব্রেন বানানোর জন্যই ৭৫ হাজার ২৩৪টি অপারেশন দরকার। প্রতিটি অপারেশনের সাফল্য নির্ভর করে ৫ থেকে ১০৫টি বিষয়ের ওপর। এর যেকোনো একটায় গন্ডগোল হলেই “ব্রেনটা” বরবাদ হয়ে যাবে।’

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মিল্টন অ্যাশ, কিন্তু চতুর্থ একটা কণ্ঠে বাধা পেল।

‘আপনারা এভাবে একজন আরেকজনের কাঁধে দোষ চাপাতে থাকলে আমি চললাম।’ সুজান ক্যালভিনের পাতলা ঠোঁটজোড়া পরস্পরের ওপর চেপে বসেছে। ‘এর চেয়েও বড় সমস্যা চেপে বসেছে আমাদের কাঁধে। একটা রোবট মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। কাজটা সে কীভাবে পারে, সেটা বের করা আপনাদের ঝগড়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

অ্যাশের ওপর স্থির হলো ক্যালভিনের ধূসর চোখজোড়া। দাঁতালো হাসি দিল তরুণ অফিসার।

ল্যানিংও হাসলেন। এমন পরিস্থিতিতে বরাবর তা-ই করেন। ‘ঠিকই বলেছ, ড. ক্যালভিন। এমন একটা রোবট বানিয়ে ফেলেছি আমরা, যেটা আপনাআপনিই চিন্তা করতে পারে, নিজের চিন্তাধারার গতি ঠিক করতে পারে। ঘটনাটা কীভাবে ঘটল জানা থাকলে, ব্যাপারটা যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারত। জানি না যেহেতু, এখন জানতে হবে। পরিষ্কার?’

‘আমি একটা পরামর্শ দিতে পারি?’ জানতে চাইল বোগার্ট।

‘বলে ফেলো।’

‘আমি বলি কি, রহস্যটা উদ্‌ঘাটনের আগ পর্যন্ত আরবি-৩৪-এর কথাটা গোপন থাকুক। এমনকি আমাদের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও জানানোর দরকার নেই। ব্যাপারটা সম্পর্কে যত কম মানুষ জানবে ততই ভালো...’

‘বোগার্ট ঠিকই বলেছে,’ সায় দিল ক্যালভিন। ‘ইন্টারপ্ল্যানেটারি কোড পাল্টে রোবট মডেল মহাশূন্যে পাঠানোর আগে প্লান্টে নিয়ে টেস্ট করার অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই রোবটবিরোধী প্রপাগান্ডা বেড়ে গেছে। এখন এই রোবটের মন পড়তে পারার ক্ষমতার কথা যদি কোনোভাবে ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি।’

চুরুটে আরেকটা টান দিয়ে অ্যাশের দিকে ফিরলেন ল্যানিং। ‘যদ্দুর মনে পড়ে, তুমি বলেছিলে, এই মন পড়ার ব্যাপারটা প্রথম কেবল তোমার চোখেই পড়ে। আর কেউ ছিল না আশপাশে।’

‘হ্যাঁ, আমি একাই ছিলাম। ভয়ে কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। অ্যাসেম্বলি টেবিল থেকে সরাসরি আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আরবি-৩৪–কে। ওবারম্যান তখন বাইরে কোথাও গিয়েছিল। তাই রোবটটাকে নিয়ে আমিই টেস্টিং রুমের দিকে রওনা দিই।’ ক্ষণিকের বিরতি নিল অ্যাশ, ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠেছে ঠোঁটের কোণে। ‘তারপর টেস্টিং রুমের কাছাকাছি পৌঁছাতেই, হুট করে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে ওটা। আমি কিন্তু একটা কথাও বলিনি এতক্ষণ। মনে মনে নানান কথা ভাবছিলাম অবশ্য। কিন্তু দুটি তো এক জিনিস হলো না, তাই না? যা-ই হোক, রোবটটাকে কোনোমতে তালা মেরে রেখে দৌড়ে আসি ল্যানিংয়ের খোঁজে। একটা রোবট আমার চিন্তা পড়তে পারছে, আমার মনের ভেতর উঁকি দিতে পারছে, আমার মনের সবচেয়ে গোপন কথাও তার কাছে গোপন থাকছে না—ভাবতেই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।’

‘তোমার কেমন লাগছিল, বুঝতে পারছি,’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল সুজান ক্যালভিন। ‘নিজের চিন্তা নিজেদের মধ্যে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমরা।’

অধৈর্য কণ্ঠে দুজনের আলাপে বাগড়া দিলেন ল্যানিং। ‘তাহলে আমরা মাত্র চারজনে জানি ব্যাপারটা। ঠিক আছে, খুব সাবধানে এগোতে হবে। অ্যাশ, রোবটটার অ্যাসেম্বলি লাইন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখবে তুমি—কিচ্ছু বাদ দেবে না। কোথাও বিন্দুমাত্র ভুলত্রুটি দেখলে সেসব অপারেশন বাতিল করে দেবে। অপারেশনগুলোর তালিকা করে রাখবে।’

‘বিশাল কাজ,’ গুঙিয়ে উঠল অ্যাশ।

‘তা তো হবেই! তোমার অধীনে যত লোক আছে, সবাইকে কাজে লাগাও। তবে কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও আসল ঘটনা টের না পায়।’

‘হুম...আচ্ছা!’ বিরস বদনে বলল যুবক।

এবার ক্যালভিনের দিকে ফিরলেন ল্যানিং। ‘তুমি কাজ করবে অন্যদিক থেকে। এ গ্রহের রোবসাইকোলজিস্ট তুমি। কাজেই রোবটটাকে আর ওটার কাজকর্ম বিশ্লেষণের দায়িত্ব তোমার। সে কীভাবে চলছে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। তার টেলিপ্যাথিক ক্ষমতার সঙ্গে আর কী কী জড়িত, সেগুলো কত দূর বিস্তৃত, তার আউটলুক কীভাবে বড় হচ্ছে, এবং সাধারণ আরবি প্রপার্টির কতটা ক্ষতি করেছে সে, তা-ও জানতে হবে। বুঝেছ?’

ড. ক্যালভিনের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বলে চললেন ল্যানিং: ‘কাজগুলোর মধ্যে সমন্বয় করব আমি। আর যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, গণিতের নিয়মে সেসবের ব্যাখ্যা দাঁড় করাব। এ কাজে বোগার্ট সাহায্য করবে আমাকে।’

‘আমি বোধ হয় খুব একটা সাহায্য করতে পারব না,’ নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল বোগার্ট। ‘এ লাইনে আমার জানাশোনা কম।’

‘ঠিক আছে, আমি কাজ শুরু করে দিচ্ছি।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অ্যাশ।

সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ক্যালভিনের দিকে ফিরলেন ল্যানিং। ‘তুমি কি আরবি-৩৪–কে একবার দেখতে চাও, ড. ক্যালভিন?’

মাথা দুলিয়ে সায় জানাল সুজান ক্যালভিন।

দরজা খোলার মৃদু শব্দে বই থেকে ফটো ইলেকট্রিক চোখ তুলে চাইল আরবি-৩৪। দেখল সুজান ক্যালভিন ঢুকছে ভেতরে।

দরজায় ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ডটা ঠিকমতো ঝুলিয়ে রোবটের দিকে এগোল সে।

‘তোমার জন্য হাইপার-অ্যাটমিক মোটরের ওপর কয়েকটা বই নিয়ে এসেছি, হার্বি। একবার চোখ বোলাবে?’

ঢাউস তিনটি বই নিয়ে প্রথমটার নামের ওপর চোখ বোলাল আরবি-৩৪, ওরফে হার্বি:

‘হুম! থিওরি অব হাইপার-অ্যাটমিকস।’ পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বিড়বিড় করল সে। তারপর ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘বসুন, ড. ক্যালভিন। কয়েক মিনিট লাগবে এগুলো পড়তে।’

চেয়ারে বসে তীক্ষ্ণ চোখে হার্বির দিকে তাকিয়ে রইল সুজান। চুপচাপ একটার পর একটা বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে রোবটটা।

আধা ঘণ্টা বাদে বইগুলো রেখে সিধে হলো সে। ‘আপনি এগুলো কেন নিয়ে এসেছেন, তা জানি আমি।’

ঠোঁট কেঁপে উঠল ড. ক্যালভিনের। ‘সে ভয়ই পাচ্ছিলাম। তোমার সঙ্গে কাজ করা খুব কঠিন, হার্বি। সব সময় আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকো।’

‘এসব নীরস বই আমার ভাল্লাগে না। আপনাদের বিজ্ঞান স্রেফ ভালো একগাদা থিওরির স্তূপ। একেবারেই সাদামাটা। এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

‘আমার ভালো লাগে গল্প-উপন্যাস পড়তে। মানুষের মোটিভ ও আবেগ নিয়ে আপনারা যেসব কাজ করেছেন, সেসব পড়তে।’

‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি,’ ফিসফিসিয়ে বললেন ড. ক্যালভিন।

‘জানেনই তো, মানুষের মনের কথা পড়তে পারি আমি,’ আগের কথার খেই ধরল রোবটটা। ‘মানব-মন যে কত জটিল হতে পারে, কল্পনাও করতে পারবেন না। মানুষের মনের সব কথা আমি বুঝতে পারি না। কেননা, তাদের সঙ্গে আমার মনের মিল খুবই কম। তবু চেষ্টা করছি। সে কাজে আপনাদের উপন্যাসগুলো খুব সাহায্য করে।’

‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আজকালকার আবেগপ্রবণ উপন্যাস পড়লে বুঝবে, আমাদের মন আসলে খুব নীরস আর বিবর্ণ।’

‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না।’

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সুজান। টের পেল, আরক্ত হয়ে উঠেছে চেহারা। মনে মনে ভাবল, ‘ব্যাপারটা ওকে জানতেই হবে!’

হার্বির উৎসাহ হুট করে মিইয়ে এল। নিচু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, তা আমি জানি, ড. ক্যালভিন। ব্যাপারটা নিয়ে সারাক্ষণই ভাবেন আপনি। যাকগে, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি, বলুন?’

শক্ত হয়ে গেল সুজানের চেহারা। ‘তুমি...তুমি কাউকে বলেছ?’

‘প্রশ্নই ওঠে না!’ এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো রোবট। ‘কেউ তো এ ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি।’

‘তুমি বোধ হয় আমাকে গাধা ভাবো,’ রাগে গরগর করে উঠল সুজান ক্যালভিন।

‘না!’

‘আমি তো দেখতেও আকর্ষণীয় নই।’

‘শারীরিক আকর্ষণের কথা যদি বলেন, এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে আমি জানি, আরও অনেক রকম আকর্ষণ আছে।’

‘যুবতীও নই।’ রোবটের কথা যেন কানেই ঢোকেনি ড. ক্যালভিনের।

‘আপনার বয়স এখনো চল্লিশ হয়নি।’

‘আটত্রিশ বছর,’ তিক্ত কণ্ঠে বলল সুজান। ‘আর সে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক। তোমার কি মনে হয়, ও কখনো...আমার দিকে ফিরে চাইবে?’

‘আপনার ধারণা ভুল!’ স্টিলের হাত দিয়ে প্লাস্টিকের টেবিলে ঘুষি বসাল হার্বি। ‘আমার কথা শুনুন...’

বুনো দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল সুজান ক্যালভিন। ‘কেন শুনব? এসব ব্যাপারে তোমার মতো একটা মেশিন কী জানে? তোমার কাছে আমি স্রেফ একটা গিনিপিগ। আমার মনের অবস্থা বিশ্লেষণ করে তুমি আনন্দ পাও।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল সে।

অনুনয়ের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রোবটটা। ‘দয়া করে আমার কথা শুনুন। আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারব।’

‘কীভাবে?’ ঠোঁট বাঁকাল মহিলা। ‘উপদেশ দিয়ে?’

‘না, না। লোকে কী ভাবছে না ভাবছে, তা তো জানি আমি। যেমন ধরুন, মিল্টন অ্যাশের মনের কথা জানি।’

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর চোখ নামিয়ে ফেলল সুজান ক্যালভিন। ‘আমি তো আর ওর মনের কথা জানি না। তোমার মুখটা বন্ধ রাখো।’

‘কিন্তু উনি কী ভাবছেন, তা বোধ হয় জানার ইচ্ছা আছে আপনার।’

ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল মনোবিজ্ঞানীর। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ফালতু বকছ তুমি।’

‘ফালতু বকব কেন? আমি স্রেফ আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। মিল্টন অ্যাশ...’ নাটকীয় ভঙ্গিতে থেমে গেল হার্বি।

‘কী?’ মাথা উঁচিয়ে ফেলল সুজান।

‘উনি আপনাকে ভালোবাসেন,’ শান্ত কণ্ঠে বলল রোবটটা।

ঝাড়া এক মিনিট রা সরল না ড. ক্যালভিনের মুখে। তারপর বলল, ‘তোমার ভুল হচ্ছে! আমাকে কেন ভালোবাসবে ও?’

‘জানি না। কিন্তু ভালো উনি বাসেন। ওই অনুভূতি অন্তত আমার কাছ থেকে লুকানো সম্ভব নয়।’

‘কিন্তু আমি...আমি তো...’ তোতলাতে তোতলাতে থেমে গেল সাইকোলজিস্ট।

‘উনি গায়ের রং দিয়ে মানুষকে বিচার করেন না। সুন্দর চুল আর চোখ দেখে পটে যাওয়ার মানুষ নন মিল্টন অ্যাশ। তার কাছে মানুষের মন আর বুদ্ধিমত্তা বেশি গুরুত্ব পায়।’

‘কিন্তু ও কখনো কোনোভাবে ও রকম কোনো ইঙ্গিত দেয়নি,’ কাঁপা স্বরে বলল সুজান ক্যালভিন।

‘তাকে কখনো সুযোগ দিয়েছেন?’

‘কীভাবে দেব? ব্যাপারটা কখনো মাথায়ই আসেনি...’

‘এই তো আসল কথা বলেছেন।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সাইকোলজিস্ট বললেন, ‘ছয় মাস আগে একটা মেয়ে এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে। সুন্দরী—ছিপছিপে গড়ন—স্বর্ণকেশী। সারা দিন তার সঙ্গে বকবক করেছে অ্যাশ। মেয়েটা কে?’

‘ওনার কাজিন। তাদের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই।’

কিশোরীসুলভ চপলতায় উঠে দাঁড়াল সুজান ক্যালভিন। খপ করে হার্বির ঠান্ডা, ধাতব হাত ধরে ফেলল। ‘ধন্যবাদ, হার্বি। এ ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছু বোলো না।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। অর্ধেক পড়া উপন্যাসে মন দিল হার্বি।

হাত-পা টান টান করে আড়মোড়া ভাঙল মিল্টন অ্যাশ। তারপর পিটার বোগার্ট, পিএইচডির দিকে ফিরে বলল, ‘টানা এক সপ্তাহ কাজ করছি। এক সেকেন্ডের জন্যও দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আর কতক্ষণ করতে হবে এ কাজ? তুমি তো বলেছিলে ভ্যাক চেম্বার ডি-এর পজিট্রনিক বিস্ফোরণই এ সমস্যার সমাধান।’

হাই তুলল বোগার্ট। ‘হ্যাঁ, ওটাই সমাধান। আর বেশিক্ষণ লাগবে না। তবে সমাধানটা কত জলদি বের করতে পারব, তা নির্ভর করছে ল্যানিংয়ের ওপর। বুড়ো আমার সঙ্গে একমত হতে পারছে না। ম্যাট্রিক্স মেকানিকসই এখনো ওর ধ্যানজ্ঞান। অথচ এ সমস্যার সুরাহা করার জন্য চাই এর চেয়ে অনেক শক্তিশালী গাণিতিক অস্ত্র।’

‘হার্বিকে জিজ্ঞেস করছ না কেন? তাহলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়,’ ঘুম ঘুম গলায় বিড়বিড় করল অ্যাশ।

‘রোবটটাকে জিজ্ঞেস করব?’ ভুরু উঁচিয়ে ফেলল বোগার্ট।

‘হ্যাঁ। কেন, সুজি বলেনি তোমাকে? রোবটটা রীতিমতো অঙ্কের জাদুকর। একসঙ্গে কয়েকটা হিসাব করতে পারে ব্যাটা। গণিত ওর কাছে বাঁ হাতের খেলা। মুশকিলটা হলো, অঙ্ক মোটেই পছন্দ করে না ও। ওর পছন্দ সস্তা, আবেগময় উপন্যাস। হা হা হা।’

‘ড. সুজান তো এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি আমাকে।’

‘ওকে তো চেনোই। রোবটটাকে পর্যবেক্ষণ শেষ করেনি এখনো। ও তো কাজ শেষ না হওয়াতক কাউকে কিচ্ছু বলে না।’

‘অথচ তোমাকে বলেছে।’

‘ওই কথায় কথায় বলে দিয়েছে আরকি। কদিন ধরে একটু ঘন ঘন দেখা হচ্ছে আমাদের।’ হঠাৎ অ্যাশের চোখ দুটি একটু বড় বড় হয়ে গেল। ‘আচ্ছা, বোগি, মহিলার মধ্যে কদিন ধরে অদ্ভুত কোনো ব্যাপার খেয়াল করেছ নাকি?’

তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল বোগার্টের ঠোঁটে। ‘অদ্ভুত বলতে, ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া ধরেছে।’

‘না, ওটার কথা বলছি না। ওর কথা বলার ধরনটা বেখাপ্পা লাগছে—যেন কোনো কিছু নিয়ে খুব খুশি।’ কিছুক্ষণ ভেবে কাঁধ ঝাঁকাল সে।

‘ও হয়তো প্রেমে পড়েছে।’

চোখ মুদে ফেলল অ্যাশ। ‘তুমি একটা উন্মাদ, বোগি। যাও, হার্বির সঙ্গে কথা বলে এসো। আমি একটু ঘুমাব।’

গভীর মনোযোগে পিটার বোগার্টের কথা শুনছে হার্বি।

‘শুনলাম তুমি নাকি অনেক ব্যাপারেই পণ্ডিত,’ গলায় যথাসম্ভব নিরাসক্তি এনে বলল বোগার্ট। ‘আর কিছু না, স্রেফ কৌতূহল মেটানোর জন্য কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই তোমাকে। সমস্যাটার সমাধান আমি প্রায় করেই ফেলেছি। কয়েকটা ধাপ নিয়ে একটু সংশয় আছে শুধু। কিন্তু ড. ল্যানিং আমার সমাধানটা অনুমোদন করছেন না।’

রোবটটা চুপ করে বসে রইল। বোগার্ট বলল, ‘কিছু বলছ না যে?’

‘আমার চোখে কোনো ভুল ধরা পড়ছে না,’ তার সামনে, কাগজে লেখা অঙ্কগুলো দেখে বলল হার্বি।

‘এর বেশি বোধ হয় কিছু বলতে পারবে না, না?’

‘সে চেষ্টা করা ঠিক হবে না। আপনি আমার চাইতে ভালো গণিতবিদ। আর...আমি অঙ্কের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে পছন্দ করি না। অঙ্ক অত ভালো পারিও না।’

‘আমিও তা-ই ভেবেছিলাম।’ আত্মতুষ্টির হাসি দেখা দিল বোগার্টের ঠোঁটে। ‘ঠিক আছে, তোমাকে খামোখা কষ্ট করতে হবে না।’ সমস্যা লেখা কাগজটা দুমড়েমুচড়ে ময়লা কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল সে। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েও ফের বসে পড়ল। ‘একটা কথা...সেটা হয়তো তুমি...’

‘আপনার চিন্তা গোলমেলে,’ শান্ত কণ্ঠে বলল হার্বি। ‘তবে সেগুলো যে ড. ল্যানিংকে নিয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খামোখা ইতস্তত করছেন। কারণ, আপনার মনে চিন্তাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি জেনে গেছি আপনি কী জিজ্ঞেস করতে এসেছেন।’

অঙ্কবিদের হাত দুটি অভ্যাসবশে মাথার চুলে চলে গেল। ‘ল্যানিংয়ের সত্তর চলছে,’ বলে থেমে গেল সে, যেন এইটুকুতেই সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়ে গেছে।

‘জানি।’

‘প্রায় ৩০ বছর ধরে প্ল্যান্টের পরিচালক হিসেবে আছেন উনি।’ হার্বি মাথা দোলাল।

‘তোমার জানা উচিত উনি...উনি...’ প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল বোগার্ট, ‘অবসর নেওয়ার কথা ভাবছেন কি না।’

‘জানি,’ হার্বির সংক্ষিপ্ত উত্তর।

‘জানো?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘তাহলে...তাহলে বলবে আমাকে?’

‘নিশ্চয়ই বলব।’ কথার কথা বলছে যেন, এমন ভঙ্গিতে জবাব দিল রোবট। ‘উনি ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন।’

‘কী!’ চেঁচিয়ে উঠল বোগার্ট। ‘কথাটা আবার বলো তো!’

‘তিনি ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন,’ আবারও শান্ত কণ্ঠের জবাব। ‘তবে এখনো ওটা কার্যকর হয়নি। উনি সমস্যাটা...মানে আমাকে নিয়ে যে সমস্যা, সেটার সুরাহা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ কাজ শেষ হলেই উত্তরসূরির হাতে অফিসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন।’

জোরে শ্বাস টানল বোগার্ট। ‘আর এই উত্তরসূরিটা? কে সে?’ উত্তেজনায় কাঁপছে তার গলা।

‘আপনি।’

স্বস্তির হাসি দিল বোগার্ট। ‘খুব ভালো লাগল শুনে। এই খবরটা শোনার জন্য এত দিন অপেক্ষা করছিলাম আমি। ধন্যবাদ, হার্বি।’

ভোর পাঁচটা পর্যন্ত জেগে কাজ করেছে পিটার বোগার্ট। তারপর আবার সকাল নয়টায় ফিরে লেগে পড়েছে। রেফারেন্স বই উল্টে চলেছে একের পর এক। ওদিকে ওর সামনে হিসাবের খাতা ভরে উঠেছে নানান জটিল অঙ্কে। পায়ের নিচে জমেছে অর্ধসমাপ্ত হিসাব লেখা ছেঁড়া কাগজের স্তূপ।

মধ্যদুপুরে সর্বশেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছাল সে। চোখজোড়া রক্তলাল। লম্বা হাই তুলে খিস্তি ঝাড়ল। ‘ধুত্তোর শালা! জিনিসটা দেখছি মিনিটে মিনিটে আরও জটিল হচ্ছে।’

হঠাৎ পেছনে দরজা খোলার শব্দে ফিরে চাইল সে। ল্যানিং ঢুকলেন। ঘরের হ-য-ব-র-ল দশা দেখে ভুরু কোঁচকালেন পরিচালক। ‘নতুন কিছু পেলে?’

‘না,’ উদ্ধত কণ্ঠে জবাব এল। ‘পুরোনোটায় সমস্যা কী?’

উত্তর দেওয়ার ঝামেলায় গেলেন না ল্যানিং। চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘রোবটটার ব্যাপারে ক্যালভিন কিছু বলেছে তোমাকে? ওটা অঙ্কের জাদুকর।’

নাক কোঁচকাল বোগার্ট। ‘শুনেছি। কিন্তু ক্যালভিনের রোবসাইকলোজি নিয়েই থাকা উচিত। হার্বির গণিতের পণ্ডিতি পরখ করে দেখেছি। ক্যালকুলাস করার সামর্থ্য ওর নেই।’

‘ক্যালভিনের তো উল্টো ধারণা।’

‘ওই মহিলা একটা পাগল।’

‘আমার তা মনে হয় না।’ চোখ সরু হয়ে এল পরিচালকের।

‘মানে!’ কঠিন গলায় বলল বোগার্ট।

‘হার্বিকে আজ সারা সকাল পায়চারি করতে দেখেছি। ও যেসব ট্রিকস খাটাতে পারে, তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না।’

‘তাই নাকি?’

‘তোমার বোধ হয় বিশ্বাস হচ্ছে না!’ ভেস্টপকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করলেন ল্যানিং। ‘এটা নিশ্চয়ই আমার হাতের লেখা নয়?’

বড় বড় অক্ষরে লেখা কাগজগুলোর ওপর চোখ বোলাল বোগার্ট। ‘এসব হার্বি করেছে?’

‘হ্যাঁ। ও তোমার ইন্টেগ্রেশন অব ইকুয়েশন ২২ নিয়েও কাজ করেছে। আমি যে উপসংহার টেনেছি, এতেও ঠিক একই উপসংহার টানা হয়েছে,’ কাগজের ওপর টোকা দিলেন ল্যানিং। ‘পজিট্রনিক বিস্ফোরণের লিঙ্গার ইফেক্টকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তোমার নেই।’

‘তা আমি করিওনি। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন...’

‘ব্যাপারটা তুমি আগেও ব্যাখ্যা করেছ। তুমি মিচেল ট্রান্সলেশন ইকুয়েশন ব্যবহার করেছ, তাই না? কিন্তু ওটা দিয়ে কাজ হবে না।’

‘হবে না কেন?’

‘কারণ, তুমি হাইপার-ইমাজিনারিস ব্যবহার করেছ।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘মিচেলস ইকুয়েশন খাপ খায় না, যখন...’

‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ট্রানজেকশন অব দ্য ফারে মিচেলের মূল লেখাটা পড়লে...’

‘পড়ার দরকার নেই। সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে বলে আসছি, তাঁর ব্যাখ্যা আমার পছন্দ না। হার্বিও আমার সঙ্গে একমত।’

‘বেশ,’ চেঁচিয়ে উঠল বোগার্ট। ‘তাহলে রোবটটাকে দিয়েই গোটা সমস্যার সমাধান করিয়ে নিন না। আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘ওটাই আসল কথা। হার্বি সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। আর ও যদি একা সমাধান করতে না পারে, আমরাও একা পারব না। গোটা প্রশ্নটা আমি ন্যাশনাল বোর্ডে পাঠাচ্ছি। এই সমস্যার সমাধান আমাদের সাধ্যের বাইরে।’

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বোগার্ট। ‘ও রকম কিছু করবেন না আপনি।’

রাগে লাল হয়ে উঠল ল্যানিংয়ের চেহারা। ‘আমি কী করব না করব, সেটা তুমি বলে দেবে?’

‘অবশ্যই,’ ধমকে উঠল বোগার্ট। ‘আমি সমস্যাটা সমাধানের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন ওটা আপনি আমার হাত থেকে কেড়ে নিতে পারেন না, বুঝলেন? আপনার মতলব আমি কিছু জানি না ভেবেছেন? রোবটিক টেলিপ্যাথি সমস্যা সমাধানের কৃতিত্ব আমাকে দিতে না চাইলে মস্ত ভুল করবেন।’

‘তুমি একটা রামগর্দভ, বোগার্ট। অবাধ্যতার জন্য এক্ষুনি তোমাকে সাসপেন্ড করব...’ রাগে কাঁপছে ল্যানিংয়ের গলা।

‘তা আপনি পারবেন না, ল্যানিং। মানুষের মন পড়তে পারা রোবট নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কোনো গোপন কথাই গোপন থাকে না। ভুলে যাবেন না, আমি আপনার পদত্যাগের কথা জানি।’

চুরুট খসে পড়ল ল্যানিংয়ের মুখ থেকে। ‘ক্‌...কী...’

খিকখিক করে হাসল বোগার্ট। ‘নতুন ডিরেক্টর কে, তা-ও জানি—আমি। চোখ গরম করবেন না, ল্যানিং।’

গর্জে উঠলেন ল্যানিং, ‘তোমাকে এ মুহূর্তে সাসপেন্ড করা হলো। তোমার চাকরি নেই, বুঝতে পেরেছ?’

বোগার্টের মুখের হাসি চওড়া হলো। ‘এখন এসব বলে কী লাভ? সব তাস আমার হাতে। আমি জানি, আপনি রিজাইন করেছেন। হার্বি বলেছে।’

হঠাৎ ল্যানিংকে দেখে মনে হলো, তাঁর বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেছে। জোর করে রাগ দমিয়ে বললেন, ‘হার্বির সঙ্গে কথা বলব আমি। ও তোমাকে এসব বলতে পারে না। বড় কোনো খেলায় নেমেছ তুমি, বোগার্ট। এসো আমার সঙ্গে।’

কাঁধ ঝাঁকাল বোগার্ট। ‘হার্বির সঙ্গে দেখা করবেন? ভালো, ভালো। চলুন!’

মধ্যদুপুর। ডেস্কের পেছন থেকে মাথা তুলে মিল্টন অ্যাশ বলল : ‘বাড়ির ডিজাইনটা সুন্দর হয়েছে না? আমি আসলে এসব ঠিক বুঝি না।’

মায়াভরা চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে সুজান ক্যালভিন। ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর। আমি প্রায়ই ভাবি...’

‘অবশ্য ছুটি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে,’ মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিল অ্যাশ। ‘কিন্তু হার্বির ঝামেলাটা না মিটলে ছুটি পাব না মনে হচ্ছে। আরেকটা কথা—কিন্তু ব্যাপারটা গোপন।’

‘তাহলে আমাকে বোলো না।’

‘নাহ, তোমাকে তো বলতেই হবে। তুমি...তুমি আমার সবচেয়ে কাছের...বন্ধু।’ দাঁতাল হাসি দিল অ্যাশ।

বুক ধুকপুক শুরু হলো সুজান ক্যালভিনের।

‘আসলে,’ গলা নামিয়ে ফেলল অ্যাশ, ‘বাড়িটা শুধু নিজের জন্য বানাচ্ছি না। আমি বিয়ে করছি। ...আরে, কী হলো?’

‘কিছু না!’ প্রাণপণে মাথা ঘোরানো ভাবটা আটকাল সুজান। ‘বিয়ে করছ?’

‘নিশ্চয়ই! এখনই তো সময়, তাই না? গত গ্রীষ্মে যে মেয়েটা এসেছিল, ওর কথা মনে আছে? ওকেই বিয়ে করছি। কিন্তু তোমাকে তো অসুস্থ দেখাচ্ছে।’ উদ্বিগ্ন চেহারায় মহিলার দিকে এগিয়ে গেল অ্যাশ।

‘মাথাব্যথা!’ দুর্বল হাতে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল সুজান ক্যালভিন। ‘ভালো কথা: অভিনন্দন।’ টকটকে লাল হয়ে গেছে ওর রুজমাখা সাদা মুখ। ‘যাকগে, আমি এখন আসি...’

প্রায় বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। মনে হচ্ছে, জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছে যেন।

এটা কীভাবে সম্ভব? হার্বি বলেছিল...

আর হার্বি তো নিশ্চিত জানত। ও তো মন পড়তে পারে!

হাঁপাতে হাঁপাতে হার্বির ঘরে ঢুকল ক্যালভিন। পলকহীন চোখে ওর দিকে ফিরে চাইল রোবটটা। তারপর বলল, মিল্টন আসলেই ভালোবাসে ক্যালভিনকে।

‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে, প্রায় অনুনয়ের সুরে। ‘ওনার কথা বিশ্বাস করবেন না। শিগগিরই জেগে উঠে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরবেন আপনি। তখন নিজের বোকামির জন্য নিজেকে নিয়েই হাসাহাসি করবেন। আমি বলছি, উনি আপনাকে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন! ভালোবাসেন! কিন্তু এখানে না! এখন না! এ সবই মোহ।’

মাথা দোলাল সুজান ক্যালভিন। ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ!’ হার্বির হাত আঁকড়ে ধরে একই কথা বলতে লাগল বারবার, ‘এসব মিথ্যে, তাই না? এসব মিথ্যে...’

কীভাবে হুঁশ ফিরে পেল, বলতে পারবে না সুজান। তবে ওর মনে হলো কেউ যেন ওকে অলীক স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবতার রুক্ষ, কাঠফাটা রোদের নিচে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আচমকা এক ধাক্কায় রোবটটাকে পেছনে ঠেলে দিল সে। কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছ তুমি? কী করছ?’

‘আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি,’ পিছিয়ে গিয়ে বলল হার্বি।

ওর দিকে অপলক চেয়ে রইল সাইকোলজিস্ট কয়েক মুহূর্ত। ‘কেন! দাঁড়াও...দাঁড়াও...এবার বুঝতে পারছি! ওহ, খোদা! এত সহজ একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকল না!’

‘আমার আর কিছু করার ছিল না,’ রোবটের গলায় আতঙ্ক।

‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! স্বপ্নেও ভাবিনি...’

দরজার বাইরে চড়া গলার কথা শুনে থেমে গেল সে। বোগার্ট আর ল্যানিং যখন ভেতরে ঢুকলেন, ততক্ষণে সে জানালার কাছে চলে গেছে। ওকে লক্ষই করেনি নবাগত দুজন।

একসঙ্গে হার্বির দিকে এগোল তারা। রাগে থমথম করছে ল্যানিংয়ের চেহারা। তিনিই মুখ খুললেন প্রথমে। ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে, হার্বি!’

প্রবীণ পরিচালকের দিকে নজর ফেরাল রোবটটা। ‘হ্যাঁ, বলুন, ড. ল্যানিং।’

‘তুমি ড. বোগার্টের সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা বলেছ?’

‘না, স্যার।’ জবাব এল ধীরকণ্ঠে। সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুছে গেল বোগার্টের মুখ থেকে।

‘মানে কী?’ রোবটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল সে। ‘কাল কী বলেছিলে, সে কথাটা বলো আবার।’

‘বলেছিলাম...’ হঠাৎ চুপ হয়ে গেল হার্বি।

‘তুমি বলোনি ল্যানিং পদত্যাগ করেছেন?’ খেঁকিয়ে উঠল বোগার্ট। ‘কী হলো, জবাব দাও।’

ওকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিলেন ল্যানিং। ‘রোবটটাকে দিয়ে মিথ্যা বলানোর চেষ্টা করছ তুমি?’

‘ওর কথা আপনি শুনেছেন, ল্যানিং। ব্যাটা “হ্যাঁ” বলতে গিয়ে থেমে গেছে। আপনি সামনে থেকে সরুন! আমি ওর পেট থেকে সত্যি কথাটা বের করবই।’

‘দাঁড়াও, আমি ওকে প্রশ্ন করব!’ রোবটের দিকে ঘুরলেন ল্যানিং। ‘হার্বি, আমি কি পদত্যাগ করেছি?’

চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইল হার্বি। উদ্বিগ্ন গলায় আবার প্রশ্নটা করলেন ল্যানিং, ‘আমি কি পদত্যাগ করেছি?’

ধীরে ধীরে—বোঝা যায় কি যায় না—এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে না করল রোবট। তারপর অনেকক্ষণ কারও মুখে কথা জোগাল না। বিষদৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল দুই বিজ্ঞানী।

‘হলো কী রোবটটার!’ গজগজ করে উঠল বোগার্ট। ‘বোবা হয়ে গেল নাকি? কথা বলতে পারিস না, হারামজাদা?’

‘কথা বলতে পারি,’ ঝটপট জবাব এল।

‘তাহলে প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি আমাকে বলোনি ল্যানিং পদত্যাগ করেছেন? বলো, পদত্যাগ করেননি উনি?’

আবারও নীরবতা। হঠাৎ সুজান ক্যালভিন প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো হাসতে শুরু করায় নীরবতা ভেঙে গেল।

ভয়ে লাফিয়ে উঠলেন দুই গণিতবিদ। বোগার্ট চোখ সরু করে বলল, ‘তুমি এখানে? এত হাসছ কেন? হাসির কী হলো?’

‘হাসির কিছু নেই।’ ঠিক স্বাভাবিক নয় ক্যালভিনের গলা। ‘দেখা যাচ্ছে, ধরা শুধু আমি একা খাইনি। হাস্যকর ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সেরা তিন রোবটিকস এক্সপার্ট একই মৌলিক ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই না?’ ফরসা হাতে কপাল চেপে ধরল সে। ‘তবে ব্যাপারটা আসলে হাস্যকর নয়।’

ক্যালভিনের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল দুই পুরুষের। ‘কিসের ফাঁদের কথা বলছ তুমি?’ আড়ষ্ট গলায় বললেন ল্যানিং। ‘হার্বিকে নিয়ে কোনো সমস্যা?’

‘না,’ ধীর পায়ে তাদের দিকে এগোল ক্যালভিন। ‘হার্বির কোনো সমস্যা হয়নি—সমস্যা হয়েছে আমাদের।’ হঠাৎ পাঁই করে রোবটের দিকে ঘুরল সে। খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘আমার সামনে থেকে দূর হও! ঘরের কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার চেহারাও দেখতে চাই না আমি।’

তার খরদৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেল হার্বি। টলতে টলতে চলে গেল ঘরের এক কোণে।

ল্যানিং রাগী গলায় জানতে চাইলেন, ‘এসব কী হচ্ছে, ড. ক্যালভিন?’

তার দিকে ফিরে সুজান বিদ্রূপের সুরে বলল, ‘আপনাদের নিশ্চয়ই রোবটিকসের প্রথম মৌলিক আইনের কথা জানা আছে।’

‘নিশ্চয়ই জানি,’ বোগার্টের বিরক্ত গলার জবাব। ‘কোনো রোবট মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না—আবার তাকেও নিজের ক্ষতি করতে দেবে না।’

‘কী ধরনের ক্ষতি?’ নাক কুঁচকে প্রশ্ন করল ক্যালভিন।

‘যেকোনো।’

‘ঠিক। যেকোনো ধরনের ক্ষতি। কিন্তু মানসিক অনুভূতির ব্যাপারে কী হবে? কিংবা কারও অহমিকায় আঘাত দেওয়া? কারও আশা যদি ভেঙে যায়? এগুলো কি ক্ষতি বলে বিবেচিত হবে?’

ভুরু কোঁচকালেন ল্যানিং। ‘একটা রোবট কী করে জানবে...’ হঠাৎ খাবি খেয়ে থেমে গেলেন তিনি।

‘ব্যাপারটা আপনি ধরে ফেলেছেন, তাই না? এই রোবট মানুষের মন পড়তে পারে। মানসিক আঘাত সম্পর্কে সব জানে। আপনার কি ধারণা, ওকে যে প্রশ্ন করা হবে, তার সঠিক জবাব দেবে? উঁহু, ও ঠিক সেই জবাবটাই দেবে, যা মানুষ ওর মুখ থেকে শুনতে চায়। অন্য কোনো জবাব দিলে যে আমরা মনে আঘাত পাব, হার্বি তা খুব ভালো করেই জানে।’

‘ঈশ্বর!’ বিড়বিড় করল বোগার্ট।

ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল মনোবিদ। ‘তুমি বোধ হয় হার্বিকে জিজ্ঞেস করেছিলে ল্যানিং পদত্যাগ করেছেন কি না। তুমি আসলে শুনতে চেয়েছিলেন উনি পদত্যাগ করেছেন। সে জন্য হার্বিও তা-ই বলেছে।’

‘এখন বুঝতে পারছি একটু আগে কেন আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে চায়নি ও,’ ফাঁপা স্বরে বললেন ল্যানিং। ‘আমাদের কারও মনে ও কষ্ট দিতে চায়নি।’

হার্বির দিকে ফিরে চাইল সবাই। বুককেসের পাশে, চেয়ারে বসে আছে সে হাতের ওপর মাথা রেখে।

সুজান ক্যালভিনের দৃষ্টি মেঝের দিকে। ‘ও এসব জানত। ...শয়তানটা সব জানে। ওকে বানানোর সময় কোথায় ভুল হয়েছে, তা-ও জানে।’

‘এখানে তোমার ভুল হচ্ছে, ড. ক্যালভিন,’ ল্যানিং বললেন। ‘ভুলটা কোথায় হয়েছে, জানে না ও। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।’

‘এখনো বোঝেননি?’ রাগে চেঁচিয়ে উঠল ক্যালভিন। ‘এর মানে হচ্ছে, মনে মনে আপনি চাননি ও আপনাকে এই সমস্যার সমাধান বলে দিক। তাতে আপনার অহমে ঘা লাগত। একটা মেশিন যা পারে, আপনি তা পারেন না—এই চিন্তায় অপমানে মরেই যেতেন আপনি। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ওকে?’ শেষের প্রশ্নটা বোগার্টের উদ্দেশে করা হলো।

‘করেছিলাম, অন্যভাবে।’ খুকখুক করে কাশল বোগার্ট, লাল হয়ে গেছে চেহারা। ‘ব্যাটা বলেছিল, অঙ্কের ব্যাপারে ও তেমন কিছু জানে না।’

ল্যানিং হাসলেন, মনোবিদও। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, আমি জিজ্ঞেস করব। মেশিনের কাছ থেকে সমাধান নিতে আমার অহমে আঘাত লাগবে না।’ গলা চড়িয়ে, শীতল কণ্ঠে ডাকল সে হার্বিকে। ‘অ্যাই, এদিকে এসো!’

উঠে দাঁড়িয়ে, ইতস্তত পদক্ষেপে আগে বাড়ল হার্বি।

‘তোমাকে বানাতে গিয়ে কোথায় গলদ রয়ে গেছে, তা তুমি জানো। জানো না?’ জিজ্ঞেস করল সুজান।

‘হ্যাঁ,’ প্রায় অস্ফুটে জবাব দিল হার্বি।

‘দাঁড়াও,’ রাগী গলায় বাধা দিল বোগার্ট। ‘কথাটা মিথ্যা। তুমি যা শুনতে চাইছ, রোবটটা ঠিক তা-ই বলেছে। ব্যস, আর কিছু না।’

‘বোকার মতো কথা বোলো না,’ ঝাঁজিয়ে উঠল ক্যালভিন। ‘তুমি আর ল্যানিং মিলে যা জানো, রোবটটা একাই তা জানে। কারণ ও মানুষের মন পড়তে পারে। ওকে একটা সুযোগ দাও।’ গণিতবিদ চুপ হয়ে গেল। রোবটের দিকে ফিরল ক্যালভিন। ‘ঠিক আছে, হার্বি, আমরা অপেক্ষা করছি।’ তারপর পুরুষদের দিকে ফিরে বলল, ‘কাগজ আর পেনসিল নাও।’

কিন্তু হার্বির মুখে রা নেই।

‘কী হলো, হার্বি, জবাব দিচ্ছ না কেন?’ মনোবিদের কণ্ঠে বিজয়োল্লাস।

রোবটটা শিগগিরই হড়বড় করে বলতে শুরু করল, ‘পারছি না। আপনি জানেন, আমি জবাব দিতে পারব না। ড. বোগার্ট আর ড. ল্যানিং চান না আমি উত্তর দিই।’

‘তারা সমাধান চান।’

‘কিন্তু আমার কাছ থেকে চান না।’

‘বোকার মতো কথা বোলো না, হার্বি,’ পাশ থেকে বলে উঠলেন ল্যানিং। ‘আমরা চাই, জবাবটা তুমি আমাদের বলে দাও।’

বোগার্টও মাথা দুলিয়ে সায় জানাল।

‘এসব বলে কী লাভ?’ খেপে উঠল হার্বি। ‘জানেন না, আপনাদের মনের গোপন কথাও পড়তে পারি আমি? অন্তরের গভীরে আপনারা কেউই চান না উত্তরটা আমি বলে দিই। আমি একটা মেশিন। আমার ব্রেনে জীবনের প্রতিচ্ছবি বসানো হয়েছে পজিট্রনিক ক্রিয়ার মাধ্যমে। ওটাও মানুষের তৈরি যন্ত্র। আপনারা মনে আঘাত না পেয়ে আমার কাছে হারতে পারবেন না। সেটা আপনাদের অবচেতন মনে গেঁথে গেছে—কখনো মুছবে না। সমস্যাটার সমাধান আমি দিতে পারব না।’

‘ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি,’ ড. ল্যানিং বললেন। ‘ক্যালভিনকে বলে দাও, তাহলেই তো হয়ে গেল।’

‘তাতে কোনো লাভ হবে না,’ চেঁচিয়ে উঠল হার্বি। ‘কারণ জবাবটা কোত্থেকে এসেছে, তা তো আপনারা জেনেই যাবেন।’

‘কিন্তু, হার্বি, ল্যানিং আর বোগার্ট দুজনেই তো এখন সমাধানটা জানতে চাইছেন।’

‘মনের ওপর জোর খাটিয়ে!’ বলল হার্বি।

‘কিন্তু এখন তারা সমাধানটা চান। আর তুমি না দিলে ওরা মনে কষ্ট পাবেন।’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ!’

‘আবার তুমি বলে দিলেও তারা মনে আঘাত পাবেন।’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ!’ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে হার্বি। পায়ে পায়ে ওর দিকে এগোচ্ছে সুজান। দুই পুরুষ হাঁ করে দেখছে তার কাণ্ড।

‘সমাধানটা ওদের বলতে পারছ না তুমি,’ নিচু, একঘেয়ে কণ্ঠে বলে চলেছে মনোবিজ্ঞানী। ‘কারণ, তাতে ওরা মনে চোট পাবেন। আর তাদের আঘাত দেওয়া তোমার আইনে নেই। কিন্তু উত্তর না বললে তুমি আঘাত পাবে। কাজেই জবাবটা ওদের বলে দিতে হবে। কিন্তু বললে...’

পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে হার্বির। এবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। ‘থামুন! আপনার মন বন্ধ করুন। ওতে শুধু যন্ত্রণা, হতাশা আর ঘৃণা! বলেছিই তো, কাজটা আমি ইচ্ছে করে করিনি! করেছিলাম আপনাকে সাহায্য করতে! আপনি যা শুনতে চেয়েছিলেন, তা-ই বলেছি আমি। বলতে আমি বাধ্য ছিলাম।’

ওর কথায় কান নেই মনোবিজ্ঞানীর। ‘উত্তরটা ওদের বলতে হবে। কিন্তু বললে তুমি চোট পাবে। তাই বলা যাবে না। কিন্তু না বললেও চোট পাবে। তাই বলতে হবে। কিন্তু...’

তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল হার্বি!

মনে হলো, গলার জোরে হুইসেল বাজাচ্ছে যেন কেউ। তীক্ষ্ণ ধাতব চিৎকারে গমগম করতে লাগল গোটা কামরা। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই আওয়াজ। নিস্পন্দ ধাতব ধ্বংসস্তূপ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল হার্বি।

রক্তশূন্য হয়ে গেছে বোগার্টের চেহারা, ‘ও মারা গেছে!’

‘না!’ হি হি করে অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে উঠল ক্যালভিন। ‘মরেনি—ও পাগল হয়ে গেছে। উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছি। তাই একেবারে ভেঙে পড়েছে। ওকে এখন বাতিল মালের আড়তে ফেলে দিতে পারেন। কারণ, ও আর কোনো দিন কথা বলবে না।’

খানিক আগেও যে অবয়বটা হার্বির ছিল, ওটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন ল্যানিং। ঠান্ডা ধাতব মুখে হাত ছুঁইয়ে শিউরে উঠলেন। ‘কাজটা তুমি ইচ্ছা করে করেছ।’ সিধে হলেন তিনি। থমথম করছে চেহারা।

‘ইচ্ছা করে করলেই–বা কী?’ তিক্ত কণ্ঠে বলল সুজান। ‘এটা ওর পাওনা ছিল।’

হতভম্ব বোগার্টের কবজি ধরে টান দিলেন পরিচালক। ‘তাতে আর কী আসে-যায়? চলো, পিটার।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘এ ধরনের ভাবুক রোবট কোনো কাজের না।’ আবার বোগার্টের হাত ধরে টানলেন তিনি। ‘চলো, পিটার।’

দুই বিজ্ঞানী বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর মানসিক স্থিতি ফিরে পেল ড. সুজান ক্যালভিন। ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে জীবন্মৃত হার্বির দিকে চাইল। ওকে দেখেই আবার কঠিন হয়ে গেল তার চোখ-মুখ। অনেকক্ষণ একদৃষ্টে রোবটটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বিজয়োল্লাস মিলিয়ে গেল মহিলার চেহারা থেকে। তার জায়গায় দেখা দিল অসহায় হতাশা। তারপর সীমাহীন তিক্ততায় অস্ফুটে তার ঠোঁট গলে বেরিয়ে এল একটা শব্দ :

‘মিথ্যুক!’