গেম

মাথাটা একবার তুলেই আবার নামিয়ে ফেলল সে। একমনে গেম খেলে যাচ্ছে—অন্তত সবার কাছে সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু সে জানে, সে কী করতে যাচ্ছে। ডিসপ্লেটা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে। একবার চলে আসছে বনবাদাড়, ছুটে চলছে নিঃসঙ্গ একজন রেসার। তার পিছে পিছে ছুটছে এক বিশাল ভালুক, সে-ও নিঃসঙ্গ। তারপর হঠাৎ ভালুকটা অদৃশ্য হয়ে গেল, একটা ট্রলিতে উঠে পড়ল রেসার। রেললাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রলিটা। মাঝেমধ্যে মাথা নিচু করে সম্ভাব্য আঘাতটাকে ঠেকাচ্ছে রেসার।

টেম্পল রান ২।

গেমার কিছুটা বিভ্রান্ত। কন্ট্রোল করতে অসুবিধা হচ্ছে—হাজার হোক প্রথমবার গেমটা খেলতে বসেছে। তবে পৃথিবীর কাছ থেকে সে রিমোটটা লুকিয়ে রেখেছে।

ডান হাতে দ্রুত স্ক্রিন স্লাইড করছে গেমার, আর বাঁ হাতের রিমোটটা কাঁথার নিচে রেখে একের পর এক সুইচ চেপে চলছে। এ কাজে তার অসুবিধা হচ্ছে না—কারণ রিমোটটা তার নিজের বানানো।

‘দ্য বেস্ট গেম এভার: নেমেসিস’

ধ্যাত্তেরি! বিরক্ত হলো গেমার, ক্রস বাটনে চাপ দিল। অনলাইন চালু অবস্থায় খেলার এই এক অসুবিধা—যখন-তখন বিজ্ঞাপন আসে।

ডেটা কানেকশন অফ করে পুনরায় খেলা শুরু করে সে। যাবতীয় জিনিস ভুলে মনোযোগ একীভূত করল ওই দুটো জায়গায়—গেম আর রিমোটে।

মানুষের মস্তিষ্ক একই সঙ্গে দুটো কাজ করতে পারে না, তাই তার কাজে বারবার গোলমাল হয়ে হচ্ছে। রিমোট আর গেমের নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে করতে পারছে না। অবশেষে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে কাজটা আবার শুরু করে। এবার আর বিফল হওয়ার সুযোগ নেই। সব ইন্সটলমেন্ট আগে থেকেই করা আছে। শুধু কয়েকটা বাটন প্রেস করার অপেক্ষা।

আকস্মিক উত্তেজনায় কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলে গেমার, স্ক্রিনের ভেতরে থাকা রেসার ধাক্কা খায় অযাচিত একটা পাথরে। আবির্ভূত হয় একটা ভালুক। রেসারের গতি কমে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছে ওটা।

নিজেকে সামলে নেয় রেসার। চলতে থাকে দারুণ ছন্দে। আগুনের নিচ দিয়ে নিজের দেহটা নিচু করে চলে আসে। পাথরের ওপর দিয়ে লাফ দেয় স্বচ্ছন্দে। আর মাঝখানে কয়েনগুলো তো আছেই।

একটা জেম কালেক্ট করার জন্য লাফ দেয় গেমার, অর্থাৎ লাফ দেওয়াল রেসারকে। পরক্ষণেই জিবে কামড় দেয়, গুরুতর ভুল হয়ে গেছে। এই গেমে সে জিততে চাচ্ছে না, জেতাতে চাচ্ছে। সুতরাং কয়েন কিংবা জেমের পেছনে চলার কোনো দরকার নেই। গা বাঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেই হলো।

এবার এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! শেষ বাটনটা ধীরে ধীরে প্রেস করল গেমার, যেন ব্যথা দিতে চায় না রিমোটটাকে। রিমোটটার সঙ্গে কানেক্টেড স্মার্টফোনে কী যেন হয়ে গেল। একটা ফ্ল্যাশ মেরে আবার চালু হলো গেমটা। আবার চলতে লাগল সেই নিঃসঙ্গ রেসার।

ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে এল গেমার। বুক ধুকপুক করছে তার। অপেক্ষা করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার! রেসারটা কোনো পাথরের সঙ্গে বাড়ি খেল না, কিংবা আগুনের নিচ দিয়ে স্লাইড করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিতে হলো না তাকে। স্বচ্ছন্দে চলতে লাগল সে, যেভাবে চলছিল তাকে কন্ট্রোল করার সময়।

গেমটাকে জীবন দিয়ে দিয়েছে গেমার!

একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠতে উঠতে মিলিয়ে গেল, কেননা স্ক্রিনটা থেকে ভয়ংকর এক রশ্মি বেরোচ্ছে! সেটা সরাসরি আঘাত করছে গেমারের চোখকে! কয়েক সেকেন্ড পর একটা কাঁথা পড়ে থাকতে দেখা গেল শুধু, আর একটা স্মার্টফোন। গেমার নিজেকে আবিষ্কার করল এক ভয়ানক জঙ্গলে, পেছনে আবিষ্কার করল এক ছুটে আসা ভালুককে। আর...সেই রেসারকে কোথাও দেখতে পেল না।

প্রোগ্রাম করে গেমটাকে জীবন্ত করার সময় এতটাই জীবন্ত করে ফেলেছিল গেমার, যে স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এসেছে রেসার!

স্ক্রিনের ওপাশের রেসারটা হাসল, যে একটু আগেই ছুটছিল প্রাণের ভয়ে। ছুটতে থাক, গেমার!

লেখক: শিক্ষার্থী, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, ঢাকা