যন্ত্র

আমি জানি, চারদিকে যে যোগাযোগব্যবস্থা বা প্রযুক্তিপণ্যের এত উন্নয়ন, এসব বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলেই হয়েছে। এটি না হলে সমাজ বা সভ্যতা এত দূর এগোতে পারত না। কিন্তু, তা–ও আফজালের এই কথাগুলো আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ছুটির দিনে যে এমন তামাশা সহ্য করা যায় না, এ কথাটা তাকে আজ স্পষ্ট বলে দিতে হবে।

এমনিতে সারা সপ্তাহ অফিসে কলুর বলদের মতো খাটতে হয়। ঘুম থেকে উঠতে হয় সেই ভোরবেলা। তারপর ঢাকার যানজটের কথা নাই–বা বললাম! সেসব ঠেলে যখন অফিসে যেতে দুই-চার মিনিট দেরি হলেই—ব্যস! নামের পাশে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে ‌‘লেট!’

তাই আজ শুক্রবার সকালে যদি আমি একটু ঘুমিয়ে নিতে চাই, তাহলে কি আমাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? দুপুরে ছেলেটার আবৃত্তির আর মেয়েটার ছবি আঁকার ক্লাস আছে; সারা সপ্তাহ তো এসব কাজ তাদের মায়ের দ্বারাই হয়, একটা দিন নাহয় বেচারির কষ্ট লাঘব করি আমি। তা এই সকালবেলা বিশ্রাম না নিলে কীভাবে করব এসব?

ভোর ছয়টায় আফজালের ফোনে ঘুম ভাঙল। সে জানাল, কী একটা অসাধারণ যন্ত্র আনিয়েছে, সেটা দেখতে যেতে হবে। আমি অবাক! আরে, দেখাবি তো ভালো কথা, কিন্তু এই সাতসকালে আমার ঘুমটা নষ্ট না করলে হতো না?

তারপর যে বর্ণনা সে দিল, তা শুনে আমি হতবাক।

এমনিতে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বেশ হাসিঠাট্টা করত আফজাল। ওর চাপার জোর দেখে অবাক না হয়ে পারা মুশকিল। কিন্তু এই বয়সে কি এসব মানায়? জুলফির কয়টা চুল পেকেছে, কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে সে? তা ছাড়া সামাজিক অবস্থানের কথাও তো ভাবতে হবে। এই বয়সে একজন ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে এসব রসিকতা কোনোভাবেই আশা করা যায় না।

তবু এই সাতসকালে এলাম তার বাসায়। আমায় সোফায় বসিয়ে রেখে যন্ত্রটা আনতে গেল সে। বাপের বাড়িতে গেছে সম্ভবত তার বউ।

কেন আসতে বলল আমায় আফজাল? তাস পেটানোর অভ্যাস তার আছে। তা ক্লাবে গিয়ে করে। বাসায় তো বন্ধুদের ডেকে এসব করবে না। তাহলে কী জন্য ডাকল?

আফজাল এল। হাতে সেই যন্ত্রটা। বলল, একটা ই-কমার্স সাইট এটা বিক্রি করছে। চীনে তৈরি। তবে যে প্রতিষ্ঠানটি এটা তৈরি করছে, তারা পেটেন্ট নিবন্ধন করতে পারেনি। আর সে কারণেই বাজারে ঘটা করে লোকজনের সঙ্গে এটা পরিচিত করানো হয়নি। খুব কম মানুষই জানে এই যন্ত্রের কথা। গোপন কোড দিয়ে কিনতে হয়। খরচ হয় বেশ বড় অঙ্কেরই।

আমার মনে পড়ল, ব্যাংকার আফজালের আবার প্রযুক্তির দুনিয়ায় বেশ আগ্রহ। তা–ও জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে সে এটার বিষয়ে জানল। উত্তরে আফজাল বলল, সেসব পরে বলবে। আপাতত আমি যেন এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে দেখি।

আফজাল সকালে ফোনে আমাকে বলেছিল, কেউ যদি এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে, তাহলে ব্যবহারের আগের দশ মিনিট সে যত চিন্তাভাবনা করেছে, তার সবটা এই যন্ত্র বলে দিতে পারবে। সে আমাকে বলল, এটি ব্যবহার করলেই আমি তার কথার সত্যতা যাচাই করতে পারব। হেলমেটের আকারের একটা যন্ত্র মাথায় পরতে হয়।

প্রায় পুরোপুরি অবিশ্বাসের সঙ্গেই আমি সেটি মাথায় পরলাম। আফজাল তার হাতে থাকা ডিভাইসের সুইচে চাপ দিল। দুবার শব্দ হলো, বিপ। বিপ।

তারপর আরও তিনবার শব্দ হলো, বিপ। বিপ। বিপ। মোট পাঁচবার। ঠিক তারপরই যান্ত্রিক স্বর বেরোতে লাগল ডিভাইসটির স্পিকার থেকে—

‌‘আমি জানি, চারদিকে যে যোগাযোগব্যবস্থা বা প্রযুক্তিপণ্যের এত উন্নয়ন, এসব বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলেই হয়েছে। এটি না হলে সমাজ বা সভ্যতা এতদূর এগোতে পারত না। কিন্তু, তা–ও আফজালের এই কথাগুলো আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ছুটির দিনে যে এমন তামাশা সহ্য করা যায় না—এ কথাটা তাকে আজ স্পষ্ট বলে দিতে হবে...’

আমি থ মেরে তাকিয়ে রইলাম যন্ত্রটার দিকে।