দ্য অ্যাটমাইজার

‘দেখুন, গবেষণাটা এখনো ইন প্রসেস। আমি চাই না এটা নিয়ে বাইরে কোনো কথাবার্তা হোক,’ গম্ভীরভাবে বললেন ড. কায়িন।

‘কিন্তু এটা তো রীতিমতো বিস্ময়কর! বড় অণু ভেঙে ছোট অণু-পরমাণু...শুনতে বেশ মনে হচ্ছে,’ একটু বেশিই উচ্ছ্বসিত হলেন জার্নালিস্ট গ্রোভা।

ড. কায়িন হাসিমুখে বললেন, ‘আসলে গবেষণাটা যতটুকু অণু ভাঙাভাঙি নিয়ে, তার চেয়েও বেশি মার্স মিশন নিয়ে।’

‘মার্স মিশন, মা-মানে মঙ্গল অভিযান?’

‘হ্যাঁ, আমরা ছয় বছর কাজ করে যে অ্যাটমাইজার মেশিন বানিয়েছি, তা তো কোনো ছেলেখেলা নয়, মি. গ্রোভা। এটা ঠিক, প্রায় সব ধরনের অণুকেই ভাঙা সম্ভব একটাকে দিয়ে। কিন্তু আমরা আপাতত কেবল সেসব অণুকেই ভাঙার প্ল্যান করছি, মঙ্গলে থাকার জন্য যেগুলোকে ভাঙা প্রয়োজন।’

মি. গ্রোভা কথাটার মাথামুণ্ডু তেমন বুঝে উঠতে পারলেন না। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মঙ্গলের জন্য অ্যাটমাইজারকে আপনারা কীভাবে ব্যবহার করতে চান?’

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ড. কায়িন বললেন, ‘প্রক্রিয়া আসলে বেশ জটিল। পুরো মঙ্গল ছেয়ে আছে মরিচায়। পৃথিবীতে এই মরিচাকে আমরা সব সময় এড়িয়ে চলতে চেয়েছি। কিন্তু মঙ্গলে ওই মরিচার মধ্যেই আমাদের নিজেদের জীবন খুঁজে নিতে হবে।’

‘সেটা কীভাবে?’

‘প্রতিটা মরিচার অণুতে দুটি লোহা আর তিনটা করে অক্সিজেন। যদি এই অ্যাটমাইজার ঠিকঠাক কাজ করে, তাহলে মরিচার অণু থেকে লোহা আর অক্সিজেন পরমাণুকে আলাদা করতে পারব। এভাবে বেশ কিছু পানির অণুও পাওয়া যাবে। সেই পানি দিয়ে মঙ্গলের ভূমিতে জলাশয় গড়ে উঠবে। আর অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণ...’

ড. কায়িনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করলেন গ্রোভা, ‘কিন্তু লোহাগুলো দিয়ে কী হবে? রাশি রাশি লোহা নিশ্চয়ই মঙ্গলে বর্জ্য হয়ে পড়ে থাকবে।’

‘মোটেও না, মি. গ্রোভা। মজবুত লোহাগুলো দিয়েই আমরা মঙ্গলে সুরক্ষিত লিভিং ক্যাপসুল বানাতে পারি। তখন ওই গ্রহের হিংস্র এলিয়েন-হিউবটদের হামলা থেকেও বাঁচা যাবে।’

মি. গ্রোভা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘কিন্তু লোহাগুলো যে আবার মরিচায় পরিণত হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে মি. কায়িন? এটা কিন্তু বেশ চিন্তার ব্যাপার।’

‘অ্যাটমাইজার থাকতে চিন্তা কিসের, জনাব?’ আত্মবিশ্বাসের একটা ঝিলিক ফুটে উঠল ড. কায়িনের চোখে-মুখে, ‘দেখুন, অ্যাটমাইজার ব্যবহার করেই আমরা লোহার পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে দু-একটা প্রোটন সরিয়ে বা ঢুকিয়ে লোহাকে ক্রোমিয়াম, ম্যাগানিজ, কোবাল্ট, নিকেল এসব উত্পাদন করতে পারি। তখন তো আর মরিচার ভয় নেই।’

একটু থেমে তিনি আবার শুরু করলেন, ‘আসলে এই অণু-পরমাণু বা নিউক্লিয়াসের ভাঙাভাঙি সবটাই রাসায়নিক বন্ধনশক্তির খেলা। যে শক্তিতে এরা পরস্পরের সঙ্গে আটকে থাকে কোনোমতে তার চেয়ে বেশি বিপরীতমুখী শক্তি দিলেই সেগুলো একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর অ্যাটমাইজার এই শক্তিও নেবে সরাসরি সূর্য থেকে।’

মি. গ্রোভ এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। কৌতূহলের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা এই প্রজেক্টকে মার্সের জন্য ব্যবহার না করে পৃথিবীর ভালোর জন্যও তো ব্যবহার করতে পারতেন মি. কায়িন। যেমন ধরুন, এখনকার দূষিত বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মত অণু আছে। সেগুলোকে ভেঙে কার্বন আর অক্সিজেন বানাতে পারেন। তখন এই পৃথিবীটাই বাসযোগ্য হয়ে যেত আর আপনাকে মঙ্গলের জন্য ভাবতে হতো না। মানবজাতির সবচেয়ে বড় উপকারটা বোধ হয় সেভাবেই করা সম্ভব।’

‘কিন্তু আমি যে মানবজাতির উপকার করতে চাই না,’ ড. কায়িনের কথাটা শুনে চোখ বড় করে তাকালেন গ্রোভা। ড. কায়িন বলতে থাকলেন, ‘মানবজাতিকে কখনো বাঁচানো উচিত নয়, মি. গ্রোভা। এটা আমি ইতিহাস থেকেই শিখেছি। ইতিহাস বলে, এর আগে যতবার প্রযুক্তি মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল, মানুষ বেঁচে ওঠার পর ততবারই সেই প্রযুক্তিরই অপব্যবহার করেছে। দেড় শ বছর আগে আইনস্টাইন নামের এক বিজ্ঞানী বিখ্যাত একটা সমীকরণ লিখেছিলেন। সেটা ব্যবহার করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ জ্বালানো যেত, কিন্তু মানুষ সেটা দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করা শুরু করেছে। মানুষ কোনো দিনই বিজ্ঞানকে ভালোবাসেনি, তারা শুধু এটা দিয়ে ব্যবসা করেছে, নয়তো একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে ব্যবহার করেছে। আমি কখনো চাই না অ্যাটমাইজার দিয়ে কেউ নিউক্লিয়ার বোম্ব বা কেমিক্যাল ওয়েপন বানিয়ে পৃথিবীটাকে নতুন করে ধ্বংস করা শুরু করুক।’

‘তাহলে কি অ্যাটমাইজার মানুষকে বাঁচাবে না, মি. কায়িন?’ গ্রোভা অন্যমনস্ক হয়ে প্রশ্ন করলেন। বাঁচাবে। মঙ্গলে সেসব মানুষ নিয়ে সভ্যতা গড়ে উঠবে, যারা শুধু ভালোবাসতে জানে। সেখানে কোনো যুদ্ধ, মারামারি থাকবে না, ওখানকার সভ্যতা হবে বিজ্ঞানের। আর যারা এত দিন বিজ্ঞানকে অপব্যবহার করেছে, তারা এই দূষিত পৃথিবীতে নিজেদের শেষ করে দিক।’

মি. গ্রোভ এই পাগলাটে বিজ্ঞানীর সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না। হঠাত্ জানালা দিয়ে তাঁর চোখ গেল বাইরে, সেখানে ব্যস্ত-দূষিত-কোলাহলপূর্ণ নগরটাকে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। সত্যিই কি অ্যাটমাইজার এসব দূষিত মানুষকে ফেলে গুটিকয়েক ভালো মানুষকে নিয়ে ভিনগ্রহে পাড়ি জমাবে? তিনি ভেবে শেষ করতে পারলেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, মাঝিড়া, শাজাহানপুর, বগুড়া