২ বি আর নট ২ বি

নিখুঁতভাবে চলছে সব।

নেই কোনো কয়েদখানা, নেই বস্তি বা পাগলাগারদ। পঙ্গুত্ব, দারিদ্র্য কিংবা যুদ্ধ? সেসবও নেই।

রোগ-শোকের ওপর বিজয়নিশান ওড়ানো অনেক আগেই শেষ। হার মেনেছে বার্ধক্যও। মৃত্যু এখন দুর্ঘটনা বাদ দিলে, স্বেচ্ছাসেবীদের শেষ অভিযানে পরিণত হয়েছে!

যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা আজ স্থির, ঠিক চার কোটি।

উজ্জ্বল এক সকালের কথা। শিকাগোর লাইং-ইন হাসপাতালে বসে আছে এডওয়ার্ড কে ওয়েলিং জুনিয়র নামের এক যুবক। সন্তান প্রসব করছে ওর স্ত্রী। ওয়েটিং রুমে অবশ্য ও ছাড়া আর কেউ নেই। আজকাল বাচ্চা জন্ম নেয় না বললেই চলে।

ওয়েলিংয়ের বয়স ৫৬। যে সমাজে মানুষের গড় আয়ু ১২৯ বছর, সে সমাজের প্রেক্ষাপটে ‘যুবক’ ওকে বলাই যায়। এক্স-রে করে জানা গেছে, একসঙ্গে তিন বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছে ওর স্ত্রী। এই প্রথম সন্তান নিচ্ছে দম্পতিটি।

তো যুবক ওয়েলিং এই মুহূর্তে বসে আছে ওর চেয়ারে, সামনে ঝুঁকে দুই হাতের ওপর দিয়েছে মাথার ভার। এমনভাবে গা ছেড়ে দিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে সে যে অদৃশ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। কামরার আবহের সঙ্গেও যায় ওর বিবর্ণ ক্যামোফ্ল্যাজ। দেয়াল থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে সব চেয়ার এবং অ্যাশট্রে, মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে অনেক কাপড়।

কামরাটা সাজানো হচ্ছে নতুন করে এমন এক লোকের স্মৃতির সম্মানে, যে স্বেচ্ছায় মারা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!

এক বৃদ্ধ, ২০০ বছর হবে বয়স, বসে আছে একটা মইয়ের ওপরের ধাপে; অবজ্ঞার সঙ্গে আঁকছে একটা ম্যুরাল। লোকটার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ছবিটা ওর নিজেরও পছন্দ না। আগে মানুষকে দেখে তার বয়স আঁচ করা যেত। সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখতে ওকে ৩৫–এর বলে মনে হয়। বার্ধক্য রোখার ওষুধ আবিষ্কারের আগেই ওকে ছুঁতে সক্ষম হয়েছিল জরা।

একটা খুব পরিচ্ছন্ন বাগানের ম্যুরাল আঁকছে বৃদ্ধ। নারী-পুরুষ সেখানে সাদা পোশাক পরে আছে, আরও আছে চিকিৎসক ও নার্স। ব্যস্ত তারা মাটি চষার কাজে, কেউবা লাগাচ্ছে বীজ কিংবা ছড়াচ্ছে কীটনাশক অথবা সার। বেগুনি রঙের পোশাক পরা কিছু নারী-পুরুষও রয়েছে। ওরা টেনে তুলছে আগাছা, সেই সঙ্গে কেটে ফেলছে অসুস্থ-দর্শন গাছ। পাতা নিড়ানি দিয়ে সরানো, ময়লার বাক্সে জঞ্জাল ফেলার কাজও করছে। মানব ইতিহাসে কখনো, মধ্যযুগের হল্যান্ড কিংবা প্রাচীন জাপানকে হিসাবে এনেই কোনো বাগান এতটা প্রাণহীন, অথচ বেশি যত্নের ছিল না। প্রতিটা গাছ যেন যথেষ্ট পরিমাণে সার, পানি, আলো, বাতাস ও পুষ্টি পায়, সেদিকে পূর্ণ নজর রাখা হচ্ছে।

করিডর ধরে হঠাৎ হেঁটে আসতে দেখা গেল এক আর্দালিকে। মন খুলে গাইছে ছেলেটা, জনপ্রিয় একটা গান:

যদি মোর ওষ্ঠের ছোঁয়া প্রিয়ার ভালো না লাগে,

বলছি আমি কী করব,

বেগুনির এক মেয়েকে অনুরোধ করে,

ওপারের টিকেট কাটব!

যদি মোর ভালোবাসা না চাও তুমি,

কেন বৃথা রইব এই দুনিয়ায়?

সরে যাব আমি এখান থেকে,

রেখে যাব নতুন কোনো প্রাণ, সেই ফাঁকা জায়গায়!

প্রথমে ম্যুরাল, এরপর তার শিল্পীকে দেখল আর্দালি।

‘একদম আসল মনে হচ্ছে’, বলল সে। ‘নিজেকে ওই বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি কল্পনায়।’

‘তুমি যে ওখানে নেই, তা কে বলল?’ বিদ্রূপমাখা হাসি হাসল বৃদ্ধ। ‘বাগানের নাম শুনবে? প্রাণের বাগান।’

‘ডা. হিটজ ভালো কাজ করেছেন।’ আর্দালি বলল। সাদা পোশাক পরিহিত এক পুরুষের অবয়বের দিকে ইঙ্গিত ওর, সেই পুরুষের চেহারা আসলে ডা. বেঞ্জামিন হিটজের। হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের প্রধান তিনি, দেখতেও খুব সুদর্শন। ‘আরও অনেক চেহারা আঁকা বাকি।’ যোগ করল সে।

আসলেই, ম্যুরালের অনেক দেহেরই চেহারা এখনো আঁকা হয়নি। হাসপাতালের কর্মচারীদের পাশাপাশি বেশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং ফেডারেল ব্যুরো অব টার্মিনেশনের শিকাগো অফিসের কিছু সদস্যের স্থান হবে ওগুলোতে।

‘এত সুন্দর ছবি আঁকতে পেরে নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে তোমার?’ জিজ্ঞেস করল আর্দালি।

বিকৃত হয়ে গেল আঁকিয়ের চেহারা। ‘তোমার ধারণা, এই ছবি নিয়ে আমি গর্বিত? জীবন বলতে এ-ই বুঝি আমি?’

‘তাহলে কী বোঝো, সেটা বলো।’

এক পাশে পড়ে থাকা রংওয়ালা ময়লা কাপড়ের দিকে ইঙ্গিত করল বৃদ্ধ। ‘ওই যে, ওটাই জীবন। ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখো, অন্তত এই জঘন্য ম্যুরালের চেয়ে সৎ একটা চিত্র দেখতে পাবে।’

‘বিষণ্ন মনের এক বুড়ো তুমি, তাই না?’ আর্দালির প্রশ্ন।

‘কেন? সেটা হওয়া কি অপরাধ?’ জিজ্ঞেস করল আঁকিয়ে।

‘জীবনের ওপর যদি বীতশ্রদ্ধ হও, দাদু, তাহলে...’ বলে একটা ফোন নম্বর উল্লেখ করল ছেলেটা। যাদের আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই, তারা ওই নম্বরে ফোন করে। তবে শূন্যটাকে সে উচ্চারণ করল ‘নট’ বলে।

নম্বরটা হলো, ২ বি আর ০২ বি।

ওটা ঘোরালে যে প্রতিষ্ঠানে ফোন যাবে, সেটা নানা নামে পরিচিত। কেউ বলে ‘অটোম্যাট’, কেউবা ‘ক্যানারি’। আরও নাম আছে ওটার। বার্ডলান্ড, কীটনাশ, সহজ বিদায়, আর দেখা হবে না মা, এখন যাই, চলি তাহলে, আর কেঁদো না, ভাবছ কেন!

‘টু বি আর নট টু বি’ হচ্ছে ফেডারেল ব্যুরো অব টার্মিনেশনের মিউনিসিপাল গ্যাস চেম্বারের নম্বর।

খেপে গেল বৃদ্ধ। ‘যখন যাবার সময় হবে’, বলল সে, ‘তখন অন্তত কীটনাশে গিয়ে মরব না।’

‘নিজেই করবে যা করার?’ আর্দালি বলল। ‘কাজটা বড় নোংরা, দাদু। তুমি তো যাবে, কিন্তু যাদের রেখে যাবে, তাদের কথা কিছু হলেও তো ভাবো!’

কিন্তু সেই ভাবনা আঁকিয়ের মাথায় আছে বলে মনে হলো না। ‘এই বিশ্বের আরেকটু নোংরামি খুব দরকার, বুঝলে?’

জবাবে হাসল কেবল আর্দালি, চলে গেল ওখান থেকে।

ওয়েলিং, গর্বিত হবু পিতা, মাথা না তুলেই বিড়বিড় করে বলল কী যেন, তারপর আবার চুপ হয়ে গেল।

একমুহূর্ত পর কামরায় এসে উপস্থিত হলো এক রুক্ষ চেহারার মহিলা, পায়ে তার হাইহিল জুতা। পরনের মোজা, ট্রেঞ্চ কোট, ব্যাগ, ক্যাপ ও জুতা—সবই বেগুনি রঙের। এই রংটার আলাদা নাম দিয়েছে বৃদ্ধ আঁকিয়ে: কেয়ামতের দিন যে আঙুর পাওয়া যাবে, সেই রং। দামি ব্যাগে লেগে আছে ফেডারেল ব্যুরো অব টার্মিনেশনের সার্ভিস বিভাগের সিল: টার্ন্সলাইটে বসে থাকা একটা ইগল।

মহিলার চেহারায় লোমের অভাব নেই, বিশেষ করে গোঁফটা তো যে কারও নজরে পড়বে। গ্যাস চেম্বারে কর্মরত সব মেয়ে মানুষের মধ্যেই দেখা যায় এই অদ্ভুত ব্যাপারটা। চাকরিতে ঢোকার সময় তারা যতটাই সুন্দরী বা রমণীয় থাকুক না কেন, বছর পাঁচেকের মধ্যে গুঁফো হয়ে যায়!

‘আমাকে কি এখানে আসার কথা বলা হয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করল সে আঁকিয়েকে।

‘আপনার কাজ কী, তার ওপর সেই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে’, ত্যাড়া জবাব দিল বৃদ্ধ। ‘বাচ্চা প্রসব করবেন?’

‘না, আমাকে বলা হয়েছে একটা ছবির জন্য পোজ দিতে হবে।’ বলল মহিলা, সঙ্গে যোগ করল, ‘আমি লিয়োরা ডানকান। ছবিটা খুব সুন্দর। দেখে তো স্বর্গ বা ওই রকম কিছু একটা মনে হয়!’

‘স্বর্গ না, তবে তেমন কিছু একটা হলেও হতে পারে।’ বলে পকেট থেকে একটা তালিকা বের করল বৃদ্ধ। ‘ডানকান, ডানকান...হুম, আছেন আপনি। অমর হওয়ার তালিকায় লেখা আছে আপনার নাম। ছবিটা দেখুন, চেহারা ছাড়া কোনো দেহ পছন্দ হয়? হলে বলুন, আপনাকে বসিয়ে দেব ওখানে।’

বেশ কিছুক্ষণ মন দিয়ে ম্যুরাল দেখল মহিলা। ‘আসলে’, সে বলল। ‘সব দেখে তো এক মনে হয়। আমি আসলে শিল্পের কিছু বুঝি-টুঝি না!’

‘দেহ তো দেহই, নাকি?’ বলল বৃদ্ধ। ‘বেশ তাহলে, শিল্পের সমঝদার হিসেবে বলব...এই দেহটা খারাপ না।’ একটা মহিলাকে দেখিয়ে দিল সে, ছবিতে সেই মহিলা শুকনো পাতা নিয়ে যাচ্ছে ময়লার বাক্সের দিকে।

‘আসলে’, বলল লিয়োরা ডানকান। ‘এ তো নোংরা সরানোর কাজ করছে, তাই না? আমি সার্ভিসে আছি, ওসব করি না।’

বিদ্রূপ করে হাততালি দিল আঁকিয়ে। ‘আপনি বললেন যে শিল্পের কিছুই বোঝেন না, অথচ পরক্ষণেই প্রমাণ করে দিলেন যে অন্তত আমার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান রাখেন! কত বড় ভুল করে বসতে চাচ্ছিলাম! আপনার আসলে থাকা উচিত...নিড়ানিতে ব্যস্ত থাকাদের দলে।’ বলে আরেকটা দেহ দেখাল সে। ‘এটা কেমন লাগছে?’

‘ইশ্‌!’ লজ্জায় লাল হয়ে গেল বেচারি। ‘তাহলে তো আমি ডা. হিটজের ঠিক পাশের জন হয়ে যাব!’

‘তাতে কোনো অসুবিধা?’

‘না, না। অসুবিধা হবে কেন? এ তো বড় সম্মানের বিষয়!’

‘আপনি ওকে শ্রদ্ধা করেন নাকি?’

‘কে করে না?’ এমনভাবে বলল মহিলা যে মনে হলো ওখানেই পূজার বেদি বসাতে শুরু করবে। ছবিতে যে ডাক্তার হিটজকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর বয়স ২৪০ বছর। ট্যান করা ত্বক আর সাদা চুলে তাঁকে জিউস বলে মনে হয়! ‘কে শ্রদ্ধা করে না ওকে?’ আবারও বলল সে। ‘শিকাগোর প্রথম গ্যাস চেম্বারটা তো তার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত!’

‘আপনাকে তাঁর পাশে স্থান দিতে পারলে’, বলল আঁকিয়ে। ‘আমিও আর কিছু চাই না। কিন্তু ছবিতে তাহলে আপনি গাছের কাণ্ড কর্তনরত অবস্থায় থাকবেন, অসুবিধে নেই তো আবার?’

‘আমার কাজ অনেকটা তেমনই’, বলল মহিলা। কাজের কথা ভেবে প্রশান্ত হয়ে উঠল তার চেহারা। মানুষকে হত্যা করার সময়, তার আরামের দিকে খেয়াল রাখার দায়িত্ব ওর!

লিয়োরা ডানকান পোজ দিচ্ছে, এমন সময় ওয়েটিং রুমে পা রাখলেন খোদ ডা. হিটজ! সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্বই অন্য রকম। সফলতা, বেঁচে থাকার আনন্দ এবং প্রতিপত্তি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে!

‘আরে, মিস ডানকান যে!’ বলে ঠাট্টা করলেন তিনি। ‘এখান থেকে তো মানুষ বিদেয় নেয় না, বরং দুনিয়াতে পা রাখে!’

‘আমরা একই ছবিতে স্থান পেতে যাচ্ছি!’ লজ্জাবতী বনে গেল লিয়োরা।

‘তাহলে তো খুবই ভালো।’ বললেন ডা. হিটজ। ‘আচ্ছা, ছবিটা সুন্দর না?’

‘আপনার সঙ্গে থাকতে পেরে খুব গর্ব হচ্ছে।’

‘আরে না...গর্ব তো আমার হওয়া উচিত। আপনার মতো মহিলা না থাকলে, আজকের এই সুন্দর দুনিয়াটা সম্ভব হতো না!’

একটা স্যালুট দিয়ে ডেলিভারি কামরার দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। ‘এইমাত্র যে কী হলো, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না!’

‘কী হয়েছে!’

‘একসঙ্গে তিন বাচ্চা!’

‘ত...তিন বাচ্চা!’ মহিলা আঁতকে উঠল, এই তিনজনকে স্থান করে দিতে যে হ্যাপা পোহাতে হবে তা ভেবে। আইন বলে, কোনো বাচ্চাই বেঁচে থাকতে পারবে না, যদি না তাদের মা–বাবা এমন কোনো স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করতে পারে, যে মরতে চায়। যদি তিনটি বাচ্চাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে অমন স্বেচ্ছাসেবী লাগবে তিনজন!

‘তিনজনকে জোগাড় করতে পেরেছে?’ জিজ্ঞেস করল লিয়োরা ডানকান।

‘আমার জানামতে’, বললেন ডা. হিটজ। ‘একজনকে পেরেছে। বাকি দুজন জোগাড়ের চেষ্টা চলছে।’

‘মনে হয় না পেয়েছে।’ জানাল মহিলা। ‘সারা দিনে একবারে একজনের বেশি মরণেচ্ছু পাইনি আমরা। তিনজন তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে আমি আসার পর সেই অনুরোধ আসলেও আসতে পারে। যা–ই হোক, নাম কী?’

‘ওয়েলিং’, এবার উঠে দাঁড়াল অপেক্ষমাণ পিতা। চোখ লাল হয়ে আছে বেচারার। ‘সদ্যোজাত সন্তানদের দেখার আনন্দে আত্মহারা পিতাটির নাম এডওয়ার্ড কে ওয়েলিং জুনিয়র।’

ডান হাত তুলে দেয়ালের একটা স্থান দেখাল ও, তারপর কর্কশ হাসি হেসে বলল, ‘উপস্থিত!’

‘আহ, মি. ওয়েলিং’, বললেন ডাক্তার হিটজ। ‘দেখতে পাইনি আপনাকে।’

‘হুম, আজ আমি অদৃশ্য মানব।’

‘এইমাত্র ফোনে খবর পেলাম, আপনার তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।’ ডাক্তার সাহেব জানালেন। ‘সবাই সুস্থ আছে, এমনকি মা-ও। দেখার জন্য যাচ্ছি।’

‘হুররে।’ ফাঁকা শোনাল ওয়েলিংয়ের কণ্ঠ।

‘আপনাকে খুব একটা আনন্দিত মনে হচ্ছে না।’ ডা. হিটজের মন্তব্য।

‘আরে নাহ্‌, কী যে বলেন! আমার জায়গায় থাকতে পারলে কোন বাপ খুশি হবে না?’ হাত-পা ছড়িয়ে নিজেকে আনন্দিত দেখাতে চাইল ও। ‘আমার কাজটাও তো খুব সহজ। তিন বাচ্চার মধ্যে কোনটা বেঁচে থাকবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাকে। তারপর নানাকে নিয়ে যাব ‘সহজ-বিদায়’খানায়। ফিরে এসে দেখাব তার রসিদ!’

এবার কড়া হয়ে গেল ডা. হিটজের কণ্ঠ। ‘আপনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভরসা রাখেন না, মি. ওয়েলিং?’

‘আমার ধারণা, এই পদ্ধতিটা একটু বেশিই কড়া’, বলল ওয়েলিং।

‘তাহলে কি সেই আগেকার দিনে ফিরে যেতে চান? যখন বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ২০ বিলিয়ন, হতে যাচ্ছিল ৪০ বিলিয়ন? সেখান থেকে ৮০, ৮০ থেকে ১৬০? মি. ওয়েলিং, আপনি কি জানেন, ড্রুপেলেট কী?’

‘না,’ গাল ফুলিয়ে জবাব দিল ওয়েলিং।

‘ড্রুপেলেট থাকে কালো জামের ভেতরে। ওই যে ছোট ছোট বীজের মতো দেখতে, ওগুলো!’ জানালেন ডাক্তার সাহেব। ‘যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না হতো, তাহলে এই বিশ্বের অবস্থাও হতো কালো জামের মতো! আর আমরা হতাম সেই ড্রুপেলেট!’

দেয়ালের ফাঁকা স্থানটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে ওয়েলিংয়ের।

‘দুই হাজার সালের কথা বলি’, বলে চললেন ডা. হিটজ। ‘বিজ্ঞানীরা দায়িত্ব নিয়ে আইনটা পাস করানোর আগে, মানুষ পান করার মতো পানি পাচ্ছিল না। খাবার বলতে ছিল কেবল সামুদ্রিক শৈবাল। তারপরও সবাই দাবি করত, খরগোশের বাচ্চার মতো সন্তান জন্ম দেওয়া নাকি তাদের অধিকার! সেই সঙ্গে চিরকাল বেঁচে থাকারও!’

‘আমি ওই বাচ্চাদের চাই।’ বলল ওয়েলিং। ‘চাই তিনজনই বেঁচে থাকুক।’

‘সেটাই তো স্বাভাবিক, আপনি তো মানুষ বই কিছু নন।’

‘আমি চাই না যে নানা মারা যান।’

‘কেউ চায় না নিকটাত্মীয়কে ক্যাটবক্সে ফেলে দিতে।’ দয়ার্দ্র শোনাল ডাক্তার হিটজের কণ্ঠ।

‘মানুষ যে কেন এই নামটা ব্যবহার করে।’ পাশ থেকে বলে উঠল লিয়োরা ডানকান।

‘কী?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার সাহেব।

‘মানুষ যে কেন জায়গাটাকে ক্যাটবক্স বা ওই ধরনের নামে ডাকে, তা আমি বুঝতে পারি না।’ মহিলার জবাব। ‘এতে করে সবার মনে ভুল ধারণা জন্ম নেয়।’

‘ঠিক বলেছেন আপনি’, ডা. হিটজ ক্ষমা চাইলেন। ‘আমারই ভুল। আমার বলা উচিত ছিল, নৈতিক আত্মহত্যা কেন্দ্র।’ গ্যাস চেম্বারের আসল নাম ওটা হলেও, কেউ তা ব্যবহার করে না।

‘এবার শুনতে ভালো লাগছে।’

‘আপনার এই বাচ্চাটা, মানে যেটাকে আপনি রাখতে চান আরকি,’ ওয়েলিংয়ের দিকে ফিরলেন ডাক্তার। ‘বেঁচে থাকবে আনন্দঘন এক পরিবেশে। যেটা পরিষ্কার, কোনো কিছুর অভাব নেই যেখানে...কিসের বদৌলতে? অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণপদ্ধতির। এই যে ম্যুরাল দেখছেন, এমনই একটা পৃথিবী হবে ওর।’ মাথা নাড়লেন একটু। ‘২০০ বছর আগে যখন আমি যুবক ছিলাম, তখন এই ধরণি ছিল নরকতুল্য। কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আরও ২০ বছর আমরা বাঁচতে পারব। কিন্তু এখন দেখুন? শান্তি ও সমৃদ্ধি আমাদের দেখাচ্ছে সুদূরের স্বপ্ন!’ উজ্জ্বল হাসি হাসলেন ভদ্রলোক।

পরমুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল ওয়েলিংয়ের হাতের রিভলবার দেখে।

প্রথম গুলিতে ডাক্তারকে মারল ওয়েলিং। ‘একজনের জায়গা হলো; তাও আবার যেনতেন মানুষের জায়গা নয়!’

তারপরের গুলিতে মারল লিয়োরা ডানকানকে। ‘মরণ তো মরণই,’ মহিলার লাশের উদ্দেশে বলল ও। ‘জায়গা হলো দুইজনের জন্য।’

সবশেষে নিজেকে গুলি করল সে, তিন সন্তানের জন্যই জায়গা সৃষ্টি করল।

তিন-তিনটা গুলি, অথচ কেউ ছুটে এল না, কেউ যেন শোনেইনি!

বৃদ্ধ আঁকিয়ে বসে আছে ওভাবেই। দেখছে নিচের দৃশ্য। ভাবছে, জীবনের চাহিদা জন্ম নেওয়ার। তারপর কিছু একটা করার। বংশবৃদ্ধি করে যত দিন সম্ভব বেঁচে থাকতে চায় সে। আর সবই করতে হয় এমন একটা ছোট্ট গ্রহে, যে গ্রহটাকেও তাল মিলিয়ে দিয়ে যেতে হয় সব।

ভাবনাটা সুখকর নয়। এমনকি এহেন জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে গেলে ক্যাটবক্স বা সহজ বিদায়কেও অর্থবহুল মনে হয়। যুদ্ধের কথা ভাবল আঁকিয়ে, ভাবল প্লেগ আর দুর্ভিক্ষের কথা।

বুঝতে পারল, জীবনে আর কখনো আঁকাআঁকি হবে না ওকে দিয়ে। ব্রাশটা আলতো করে ফেলে দিল নিচে থাকা কাপড়ের ওপর। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, জীবনের এই আনন্দময় বাগানে অনেক দিন কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর না। মই থেকে নেমে হাতে তুলে নিল ওয়েলিংয়ের পিস্তল, নিজের বিদায়ের টিকিট নিজেই কাটবে।

কিন্তু সাহস জোগাতে পারল না।

আচমকা দৃষ্টি পড়ল ঘরের কোনায় থাকা টেলিফোন বুথের ওপর। ওটার কাছে গিয়ে মুখস্থ হয়ে যাওয়া নম্বরটা ঘোরাল—২ বি অর ০২ বি।

‘ফেডারেল ব্যুরো অব টার্মিনেশন,’ উষ্ণ শোনাল ওপাশের মেয়েলি কণ্ঠ।

‘কত দ্রুত ব্যবস্থা করা যাবে?’ জিজ্ঞেস করল আঁকিয়ে।

‘আপনি চাইলে আজ শেষ বিকেলের দিকেই যাবে, স্যার’, বলল মেয়েটি। ‘আরও আগেও হতে পারে, যদি কেউ পিছপা হয় তো।’

‘ঠিক আছে’, বলল আঁকিয়ে। ‘আমার নাম লিখে নিন তাহলে।’ বলে নিজের নামের বানানটা বলল।

‘ধন্যবাদ আপনাকে, স্যার।’ মেয়েটি জানাল। ‘এই শহর আপনাকে ধন্যবাদ জানায়। কৃতজ্ঞতা জানায় আপনার দেশ...আপনার গ্রহ। তবে সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষ থেকে!’