আলোকদৃষ্টি

ঘটনার সূত্রপাত বছর দুয়েক আগে এক শরৎকালে, অনিন্দ্যর দাদুবাড়িতে। ইউনিভার্সিটিতে পূজার বন্ধ চলছিল। ওরা তিন বন্ধু ছুটি কাটানোর জন্য রওনা দিয়েছিল অনিন্দ্যর দাদুবাড়ির উদ্দেশে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানা, গ্রামের নাম সুকুন্দপুর। অনিন্দ্যর দাদু রামকুমার ভট্টাচার্য অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন, বরাবর তাঁর বাড়িতে এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় পূজা হয়। পরিবারটির অবস্থা এখন যদিও পড়তির দিকে, আর গ্রামের বাড়িতে থাকার মতো তেমন কেউ নেই এখন আর। তবু এখনো সুকুন্দপুরে দুর্গাপূজা মানেই ভট্টাচার্যবাড়ির পূজা। তো সেবার সেই পূজা দেখবে বলেই ঢাকা থেকে বাসে করে রওনা দিয়েছিল ওরা তিন বন্ধু—অনিন্দ্য, রিসাত আর জয়।

ওরা যখন সুকুন্দপুর গিয়ে পৌঁছায়, তখন রীতিমতো সপ্তমীর আয়োজন চলছে। আশপাশের গাঁওগেরাম থেকে আত্মীয়স্বজন এসে গমগম করছে গোটা বাড়ি। পুরোনো দালানবাড়ি, পলেস্তারা খসে পড়ছে ছাদের এখান-ওখান থেকে। দোতলার টানা বারান্দার রেলিংয়ে কোথাও কোথাও ফাঁকফোকর হাঁ করে আছে, সারানোর লোক নেই। বাইরের বড় উঠানে প্রতিমা বসানো হয়েছে। ভারি সুন্দর প্রতিমা। চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। দেখে তো ওরা মুগ্ধ। লম্বা যাত্রাপথে তারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিল দোতলার দক্ষিণের ঘরে, যে ঘর তাদের জন্য বরাদ্দ করা ছিল আগে থেকেই। শুয়েই অঘোর ঘুম। বাইরে এত শব্দ, হইচই, কাড়া-নাকাড়া, ঢোলের আওয়াজ—কিছুই তাদের ঘুম টলাতে পারেনি। রিসাতের ঘুম যখন ভাঙে, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে শরতের ঠান্ডা বাতাস এসে ঢুকছে ঘরটাতে, হিমেল হাওয়ায় কুঁকড়ে তখনো শুয়ে আছে বাকি দুই বন্ধু। ওদের গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে রিসাত তখন বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

আকাশটা লালে লাল হয়ে উঠেছে তখন। সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বলে উঠেছে গোটা বাড়ি আর উঠানে। একটু পর শাঁখের আওয়াজ বেজে উঠল। পরিবেশটা ভারি ভালো লাগছিল রিসাতের। সে কখনো দুর্গাপূজা এভাবে কাছ থেকে দেখেনি, তাও আবার গ্রামে। সে পায়চারি করতে করতে বারান্দার শেষ মাথায় বড় হলঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। এটা একটা লাইব্রেরি ছিল বোধ হয়। দেয়ালজুড়ে বড় বড় আলমারি, ধুলোয় ভরা। বইগুলো বেশির ভাগই বোধ করি হারিয়ে গেছে বা চুরি গেছে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় কাঠের টেবিল। একদিকে একটা ছেঁড়া ইজিচেয়ার। একটা কাচের আলমারির ভেতর অনেক মেডেল, ক্রেস্ট, কাপ। ধুলোয় ধূসরিত।

দেয়ালে অনিন্দ্যর দাদুর সাদাকালো ছবি। ভারি সুপুরুষ লোকটি, শুনেছে একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় আর শিকারিও ছিলেন তিনি। ঘোড়ায় চড়তে পারতেন। তরবারিও। কলকাতা জুবিলি ক্লাবে এককালে প্রথম সারির ফুটবল খেলেছেন। মেডেল আর কাপগুলোর সামনে একটা খাপওয়ালা জং-ধরা তরবারি পড়ে ছিল। রিসাত কৌতূহলবশে তরবারিটা ওঠাতে গিয়েই প্রথম ঘটনাটা ঘটল। দুই বছর আগের কথা। কিন্তু এখনো সব স্পষ্ট মনে আছে। মুহূর্তের মধ্যে যেন গোটা হলঘর নেই হয়ে গেল তার চোখের সামনে। সে নিজেকে দেখতে পেল একটা খোলা ময়দানে, বালু উড়ছে চারদিকে, ভীষণ গরম বাতাস। তার হাতে একটা খোলা তরবারি। তরবারির আগা থেকে লাল রক্ত ঝরছে টুপ টুপ করে। আর তার পায়ের কাছে, নিচে, বালুতে পড়ে আছে একটা নিশ্চল দেহ। মাথার লম্বা চুল এলোমেলো আর লালচে, গায়ের রং বিদেশিদের মতো ফরসা। মুখটা নিচের দিকে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে লোকটির পরনে ফিতাওয়ালা লম্বা বুট, নীল রঙের কোট। একটু ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে এল রিসাত। দেখল দেহটার নিচ থেকে একটা লাল রক্তের ধারা গড়িয়ে এসে পড়ছে তার পায়ের কাছে। রক্ত ভীষণ ভয় পায় রিসাত। বাড়িতে একটা মুরগি কাটাও সহ্য করতে পারে না সে। তাই এ দৃশ্য দেখে সে ভয়ে-আতঙ্কে চিত্কার করে উঠেছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সেই থেকে শুরু। এ পর্যন্ত মোট চারবার ঘটেছে এমন ঘটনা। প্রথমবার অনিন্দ্যর দাদুবাড়িতে, সুকুন্দপুর গ্রামে। দ্বিতীয়বার ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্টের বাড়িতে, তেপায়ার ওপর রাখা কারুকাজ করা চিনামাটির একটা জার স্পর্শ করার পর। তার পরেরবার একটা বইয়ের খোঁজে নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের মার্কেটের মধ্যে যখন দাঁড়িয়ে ছিল। আর শেষবার ঘটল গতকাল, ডাক্তার হাসানের চেম্বারে, কথা বলতে বলতে যখন সে হঠাৎ ডাক্তারের চেম্বারে দেয়ালে ঝোলানো ছোটদের আঁকা একটা পেইন্টিংয়ের গায়ে হাত বোলাতে শুরু করল।

‘সম্ভবত আপনার মাঝেমধ্যে হ্যালুসিনেশন হয়,’ বলছিলেন ডাক্তার হাসান, ‘বা একধরনের টেমপোরাল লোব এপিলেপসি আছে হয়তো আপনার। টেমপোরাল লোব এপিলেপসিতে মানুষ আকস্মিক স্থান-কাল-পাত্র ভুলে অন্য জগতের কথা চিন্তা করতে শুরু করে। ভিন্ন সব দৃশ্য দেখে, শব্দ শোনে। তারপর কয়েক সেকেন্ড পর আবার চেতনা ফিরে পায়। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক নিউরোনাল ডিসচার্জ যখন আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে, তখন সব ঠিক হয়ে যায়।’

‘তাহলে আমার এখন কী করণীয়?’ শান্ত মুখে প্রশ্ন করে রিসাত।

‘আমরা আপনার একটা ইইজি করব। এপিলেপসি ডায়াগনোসিস হলে কিছু ওষুধ দেব। স্ট্রাকচারাল কোনো সমস্যা আছে কি না, তা জানতে এমআরআইও করা লাগতে পারে। চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আর যদি এটা এপিলেপসি না হয়?’

ডাক্তার হাসান তার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন, ‘কেন আপনার এমনটা মনে হচ্ছে?’

‘আমার মনে হয় স্যার, এটা এপিলেপসি-জাতীয় কিছু নয়। হ্যালুসিনেশন বা ডিলিউশনও নয়। কারণ, আমি যেসব দৃশ্য দেখি বা শুনি, তার কোনোটাই মিথ্যে বা কল্পনা নয়। তা সত্যি আগে অতীতে কখনো ঘটেছে। আমি কেবল তার পুনরাবৃত্তি হতে দেখি বা ফ্ল্যাশব্যাক হতে দেখি বলতে পারেন। সিনেমার মতন।’

ডাক্তার হাসান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। যুক্তিটা জোরালো। হ্যালুসিনেশন হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। তবে মানুষের মস্তিষ্ক খুবই বিচিত্র। হতে পারে শোনা গল্পকাহিনি বা মিথ তরুণটির মস্তিষ্কের নিউরনে এমনভাবে গেঁথে আছে, যা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছেলেটি হুবহু তা-ই দেখতে পায়, যা বহুকাল আগে এখানে ঘটেছিল।

এটা ঠিক যে অনিন্দ্যর দাদু একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে নিজ হাতে তরবারি দিয়ে হত্যা করেছিলেন, সেই গল্প আগে থেকেই জানা ছিল রিসাতের। অনিন্দ্য বহুবার সেই গল্প বন্ধুদের শুনিয়েছে। দুই বছর আগে, শরতের এক বিকেলে, সপ্তমী পূজার দিন, নির্জন পোড়োবাড়ির দোতলার হলঘরে তরবারিটা দেখে অবচেতন মনে সেই কাহিনি মনে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। পরিবেশটা এমন ছিল যে তরবারিটা ধরতেই গোটা ঘটনা একটা সিনেমার মতো তার সামনে ভেসে উঠেছিল মুহূর্তের মধ্যে। এই দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে তার মস্তিষ্কই, মেমোরির জটিল নেটওয়ার্ক গলে বেরিয়ে এসেছিল সেই দৃশ্য।

‘সেটা নাহয় বুঝলাম,’ রিসাত প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু ধরুন নীলক্ষেতের ঘটনাটা? আমি সেই গরমে ভিড়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বই নাড়াচাড়া করছি, একটা পুরোনো বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে ভালো লাগল, বইয়ের নাম নিকোলাই গোগল রচনাসপ্তক, দেখে মনে হলো বইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে, আমি বইটা হাতে নিলাম। অমনি দেখি, কালো ফ্রেমের চশমা পরা কবি শামসুর রাহমান একটা হলদে বাড়ির ঘরে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর সামনে টেবিল, হাতে একটা বই নিয়ে পড়ছেন খুব মনোযোগ দিয়ে, আর তক্ষুনি একটা ছেলে এসে তাঁকে চা দিয়ে গেল। তিনি হেসে বললেন, ‘তারক, বইটা তোমার কাছে রাখো তো! শহীদ কাদরী এলে দিয়ে দিয়ো ওকে।’

‘তো?’ ডাক্তার হাসান প্রশ্ন করেন।

‘আমি বইটা খুললাম। দেখি, পুরোনো হলুদ হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠায় প্রায় আবছা অক্ষরে এখনো লেখা—শহীদ কাদরী। কী আশ্চর্য! বইটা তো আসলেই মূল্যবান। আমার সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে অত পড়াশোনা নেই। বন্ধু জয়ের আছে। আমি বইটা কিনে এনে ওকে দিলাম। ঘটনাটাও খুলে বললাম। সে উত্তেজিত হয়ে উঠল, হলুদ পুরোনো বাড়ি? সবুজ খড়খড়ির জানালা? তারক? নিশ্চয় বিউটি বোডিং! সে বইটা নিয়ে বিউটি বোডিংয়ের তারক সাহার কাছে গেল। বেচারা বইটা হাতে নিয়ে একেবারে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, এ বই আপনার কাছে কীভাবে গেল? কবি শামসুর রাহমান আমাকে সত্যিই দিয়েছিলেন বইটা, শহীদ কাদরীকে দেওয়ার জন্য। আমি এখানেই কোথাও রেখেছিলাম। তারপর কোথায় যে হারিয়ে গেল, আর খুঁজে পাইনি। আপনি কোথায় পেলেন বলেন তো?’

ডাক্তার হাসান একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে লাগলেন সামনে রাখা প্যাডের ওপর। তারপর বললেন, ‘ঘটনাটা আপনি আগে কোথাও পড়েছেন? কোনো পত্রপত্রিকায়? স্মৃতিকথায়?’

‘না স্যার। আমার অত জানাশোনা নেই। পড়ার বইয়ের বাইরে খুব একটা কিছু পড়ার অভ্যাস নেই। পত্রিকা পড়ি। কিন্তু এ ঘটনা পড়িনি।’

ডাক্তার হাসান গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়লেন। কী মুশকিল! এ যে ফ্যান্টাসি গল্পকেও হার মানাচ্ছে। এ রকম কেস এর আগে কখনো দেখেননি তিনি। ওদিকে রিসাত তার চেম্বারে রাখা সোফায় বসে পা দোলাচ্ছে দিব্যি। তার চোখ দুটি চঞ্চল। সে মিটিমিটি হাসছেও। তার হাসি দেখে বিরক্ত লাগছে ডাক্তার হাসানের। তাঁকে বিপত্তিতে ফেলে মজা পাচ্ছে বুঝি ছেলেটা। নাকি গোটা ব্যাপারই বানানো, ভাঁওতাবাজি। মজা করছে সে। তাঁর চোখের দিকে চেয়ে রিসাত বলল, ‘স্যার, আগে এ রকম হলে ভীষণ চমকে যেতাম, অস্থির হতাম। এখন আর হই না। অভ্যাস হয়ে গেছে বলতে পারেন। আপনি যখন একটু আগে আপনার পিয়নকে ডাকতে বাইরে গেলেন, তখন আমি আপনার দেয়ালে ঝোলানো এই পেইন্টিং দেখছিলাম। কী সুন্দর! নিশ্চয় কোনো বাচ্চার আঁকা। শান্ত নীল নদীতে বয়ে চলেছে একটা সাদা পালতোলা নৌকা। ভাবতে ভাবতে যেই ওতে হাত দিলাম, অমনি দেখলাম একজন অপূর্ব সুন্দরী নারী এই ঘরে এই চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদছেন। আর আপনি বিব্রত হয়ে বসে আছেন তাঁর সামনে। ওই নারী একটু পর কান্নাভেজা বিহ্বল চোখে আপনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাস্ট্রোসাইটোমা? ব্রেনের টিউমার? অপারেশন করলেও কি ভালো হবে না, হাসান? যেভাবেই হোক, যা লাগে করো, আমার মেয়েকে তুমি বাঁচাও হাসান। প্লিজ, তোমার পায়ে পড়ি...।’

ডাক্তার হাসানের ঘরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। রিসাত চুপ করে রইল। ডাক্তার হাসানও। একজন সন্তানহারা নারীর কান্না আর আর্তনাদ ঘরজুড়ে ভাসতে লাগল কেবল। ডাক্তার হাসান চোখ থেকে চশমা খুলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। যেন গভীর বিষণ্নতায় ডুবে গেছেন। রিসাত এবার উঠে দাঁড়াল। ফাইলটা হাতে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আমি যাই স্যার। ইইজি, এমআরআই এসব কখন, কীভাবে করব জানাবেন। আমার আর ভালো লাগে না। আমি এসব থেকে মুক্তি পেতে চাই। অন্যের কষ্টের আর বেদনার ভাগ নিতে আর ইচ্ছে করছে না, স্যার।’

‘অতীত কখনো হারিয়ে যায় না, টিকে থাকে মানুষের চেতনায়,’ মাইকেল ট্যালবট লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত বই দ্য হলোগ্রাফিক ইউনিভার্স-এ। তিনি দাবি করেছেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব ঘটনাই সাব-অ্যাটমিক লেভেলে নানা ধরনের কম্পন বা ভাইব্রেশনের মাধ্যমে সুরক্ষিত আছে। আমাদের কনশাসনেস আর রিয়েলিটি এই বিশাল কসমিক হলোগ্রামের সুতোয় বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে, আর তার মধ্যে ঝুলছে আমাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সবকিছুর রেকর্ড। এই গোপন টেপরেকর্ডার খুলে লুকোনো গানগুলো শোনার জন্য চাই অবিশ্বাস্য অতিমানবিক ক্ষমতা। সে ক্ষমতা মানুষের নেই। ভবিষ্যতে মানুষ সেই ক্ষমতা অর্জন করবে কি না, কেউ জানে না। তবে সেদিন ভূত-ভবিষ্যৎ সব পরিষ্কার হয়ে দেখা দেবে মানুষের সামনে। মানুষ অর্জন করবে জ্ঞানের সত্যিকারের ব্যুত্পত্তি।

বইটা বন্ধ করে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন ডাক্তার হাসান। রিসাত ছেলেটাকে যতই দেখছেন, ততই অবাক হচ্ছেন তিনি। তাঁর এত দিনের অর্জিত মেডিকেল জ্ঞান ও বিদ্যাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ছেলেটা। একজন নিউরোলজিস্ট হয়েও ডাক্তার হাসান আজকাল প্যারানরমাল সাইকোলজির বইপত্র পড়তে শুরু করেছেন। ১৯২২ সালে গুস্তাভ পেজেনশেয়ার নামে এক জার্মান চিকিৎসক প্রথম তাঁর বালিকা রোগী মারিয়া ডি জিরোল্ডের মধ্যে এই অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ করেন। মারিয়া কোনো বস্তুকে স্পর্শ করে সেই বস্তুসংশ্লিষ্ট সব অভিজ্ঞতার নির্ভুল বর্ণনা দিয়ে যেতে পারত। এই ক্ষমতার নাম তিনি দিয়েছিলেন সাইকোমেট্রি। তাঁরই থিওরি ছিল এটা যে বস্তুর মধ্যকার ভাইব্রেশনে রক্ষিত ‘বস্তুর অভিজ্ঞতা’ গোপন চাবিকাঠি খুলে পড়ার ক্ষমতা রাখে সাইকোমেট্রিস্টরা। পরে তাঁর এই থিওরির ওপর ভিত্তি করে লেখা হয় দ্য হলোগ্রাফিক ইউনিভার্স বা মিস্টিকার মতো বই। বিজ্ঞানীরা বলেন, যেকোনো বস্তু, তা যতই কঠিন আর সলিডই হোক, তার মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোর বা ছিদ্র। বস্তু এই ছিদ্রগুলো দিয়ে চারপাশের মানুষগুলোর মেন্টাল অরা বা চেতনার ফ্র্যাগমেন্টগুলো নিজের মধ্যে গ্রহণ করে এবং ধারণ করে রাখে। আমরা আমাদের চেতনার অরাগুলো চারপাশের এনার্জি ফিল্ডে প্রতিনিয়তই ছড়িয়ে দিচ্ছি আর আমাদের চারপাশের বস্তুগুলো তা এভাবেই নিজেদের মধ্যে সংরক্ষণ করে চলেছে। আমরা যদি এই বস্তুগুলো পড়তে পারতাম, তবে পৃথিবী আর মানবসভ্যতার সব ইতিহাস পরিষ্কার হয়ে যেত। এটা অনেকটা ফসিল অ্যানালাইসিস করে পুরোনো পরিবেশের ধারণা আবিষ্কার করার মতো ব্যাপার।

কয়েক দিন পর রিসাত ছেলেটা আবার এসে হাজির। চোখ দুটো লাল। মাথার চুল এলোমেলো। সে চেয়ারে বসে বলল, ‘স্যার, আজকাল ভীষণ মাথাব্যথা হয়। মাঝেমধ্যে চোখে ঝাপসা দেখি। আর ওসব ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটছে। আজকাল আমি আর আমার মধ্যে বেশিক্ষণ থাকি না। বিচিত্র সব মানুষের মধ্যে থাকি। কোনো কিছু স্পর্শ করতেও ভয় লাগে। আপনি কিছু একটা তাড়াতাড়ি করেন, স্যার।’

হাসানের খুব অসহায় লাগতে থাকে। বিষয়টা নিয়ে তিনি তাঁর সিনিয়র এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি তা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন রোগীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে রেফার করতে। ‘এটা হলো সিজোফ্রেনিয়া, ক্লিয়ার হ্যালুসিনেশন, বুঝলে?’ বলেছেন তিনি, ‘রোগী অকারণে নিজের কাছে ধরে রেখো না, সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠিয়ে দাও।’

ডাক্তার হাসান নিজেও কোনো কূলকিনারা করতে পারছেন না। কারণ, রিসাতের ইইজি, এমআরআই আর রক্তের সব রিপোর্ট একেবারে স্বাভাবিক। ওর কোনো রোগই নেই। তিনি রিসাতকে মাথাব্যথার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করলেন।

‘পিএসআই এক্সপ্লোরার’ বইয়ে অবশ্য আরেক বিজ্ঞানী মারিও ভারভোগলিস দাবি করেন, সাইকোমেট্রি একধরনের আলোকদৃষ্টি। অনেকটা টেলিপ্যাথির ক্ষমতার মতো। অটিজমের একধরনের উচ্চতর কার্যকর ফর্ম এটি। ডাক্তার হাসান ঠিক করলেন, তিনি এবার হাইগ্রেড অটিজম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করবেন। বেশ কয়েকজন অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে দেখলে কেমন হয়! তিনি পেডিয়াট্রিক চাইল্ড নিউরোলজি বিভাগে কয়েক দিন ঘোরাঘুরিও করতে শুরু করলেন। এ রকম একদিন হঠাৎ থানা থেকে ফোন।

‘হ্যালো, আপনি কি ডক্টর হাসান?’

‘জি, কে বলছেন?’

‘আমি শাহবাগ থানা থেকে বলছি। এসআই জুবায়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের একজন ছাত্র রিসাত মজুমদার গত রাতে আত্মহত্যা করেছে।’

‘কী বলছেন?’

‘জি, আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না ডক্টর হাসান। তবে মৃত ব্যক্তি আপনার উদ্দেশে একটি চিঠি রেখে গেছে তার ডায়েরিতে। তাই আপনাকে একটু থানায় আসতে হবে।’

ডাক্তার হাসান একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে উঠলেন। কী ঝামেলায় যে পড়তে যাচ্ছেন তিনি, কে জানে! তিনি সব কাজ ফেলে ছুটলেন শাহবাগের দিকে। ফুলের দোকানগুলো পেরিয়ে থানায় ঢুকে জোরে একটা নিশ্বাস নিলেন তিনি। রিসাতের বিভ্রান্ত চেহারাটা মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। আহা, ছেলেটাকে তিনি কোনো সাহায্যই করতে পারলেন না।

বর্তমান চেতনা থেকে অতীত অভিজ্ঞতাকে আলাদা করতে পারলে আপনিও পারবেন, ডাক্তার হাসান! কিন্তু সে চেষ্টা না করাই ভালো। কেননা, এই পথ বেদনাময়!

ছোট্ট চিরকুটটার দিকে অনেকক্ষণ অকারণেই চেয়ে রইলেন ডাক্তার হাসান।