জল্লাদ

প্রায় কয়েক শ বছর আগে এখানে একটা কয়েদখানা ছিল, পুরোনো সে স্থাপনার কোনো কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, এখানে পরাক্রমশালী মোগল শাসকদেরই কেউ একজন একটা দুর্গ বানিয়েছিল, পরে সাদারা এল, দ্রুত প্রাচীন ঔপনিবেশিক এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলল—তারাই উনবিংশ শতাব্দীতে দুর্গের সংস্কার সাধন করে একে জেলখানায় রূপ দিয়েছিল—এগুলো এখন পুরোই আর্কাইভ ম্যাটার, জীবিত কোনো মানুষের স্মৃতিতেই আর এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর বাস্তবেও এখন কথিত ওই মোগল স্থাপত্যের ছিটেফোঁটা কোনো চিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই। এখন মজবুত আর্টিফিসিয়াল সব কাঠামোর স্থাপনা চারদিকে। ছিমছাম গোছানো একেকটা নগর। ইতিহাস যেমন বর্তমান সময়ে এসে বিস্মৃতিতে হারিয়ে গেছে, তেমনি ভূখণ্ডের অতীত ভৌগোলিক চেহারাও।

তবে ইতিহাস বোধ করি সব যুগেই নতুন রূপে নতুন চেহারায় হাজির হয় বা ফিরে আসে।

এই যেমন সেন্ট্রাল জোনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারের মতো আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। প্রতিবার যখন আমার ডাক পড়ে, আমার এমন হয়। কিন্তু আজ মনে হলো, তলপেটেও যেন কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। বেরোনোর ঠিক আগে আগে দাড়ি কামিয়েছিলাম, টের পেলাম কপাল, নাক, গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে চটচটে ঘাম। তলপেটের উদ্ভট শিরশিরানির পাশাপাশি আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে বুঝতে পারছি, ভেতরটা আমার ক্রমশ কেমন এক হাহাকার ফাঁকা ময়দান হয়ে যাচ্ছে। এই অনুভূতিটা আজ নতুন।

আমি সত্তর বছর আগে ইতিহাসের তুখোড় এক ছাত্র ছিলাম, এখনো সুযোগ পেলেই আমি আর্কাইভে ঢুঁ মারি। এই সেন্ট্রাল জোনে ঢাকা নামে খুব পুরোনো একটা শহর ছিল, বিবরণে পাওয়া যায়। এখন যে সেন্ট্রাল জোন, এখানে জেলখানার পরেই গঙ্গা নামে একটা নদীর প্রবাহ ছিল। এখন নেই। আর্কাইভে আছে, এখানে এই সেন্ট্রাল জোনের জায়গাতেই তখনকার ‘সেন্ট্রাল জেলে’ অনেকগুলো আলোচিত খুন ও মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।

আর্কাইভে আরও উল্লেখ আছে: পৃথিবীর একুশ শতাব্দীতে নাকি মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা নিয়ে একটা আন্দোলনও হয়েছিল! খুবই জোরদার আন্দোলন ছিল সেটা। কিছু রাষ্ট্র তখন আন্দোলনে সাড়া দিয়ে আইন করে মৃত্যুদণ্ড রদও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের বিধান পৃথিবীতে পুরো রহিত হয়নি। বরং আর্কাইভের ওসব তথ্যই এখন গালগল্পের মতো শোনায়। আর শুধু পৃথিবী কেন, বাইরের গ্রহগুলোতেও মৃত্যুদণ্ড এখনো চরম এবং চূড়ান্ত শাস্তির বিধান হয়েই আছে।

অথচ পৃথিবী থেকে কত কিছুর অস্তিত্বই তো মুছে গেছে, চিরতরে। কিন্তু মৃত্যু আর মৃত্যুদণ্ড এখনো আছে। শুধু এর ধরনে বা কার্যকরের কায়দায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুকে অনেকখানিই প্রলম্বিত করতে পেরেছে; এখন মানুষের আয়ু দুই-তিন শ বছর। কিন্তু স্বাভাবিক মুত্যুর বাইরেও এই যুগেও মানুষের অকালে মৃত্যু ঘটে! কারণ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান এখনো বহাল আছে, কাজেই অকাল মৃত্যুতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মৃত্যুদণ্ড কতখানি যৌক্তিক, এ নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই যথেষ্ট টানাপড়েন আছে। আমি নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। প্রায় কৃত্রিম আবহে মোড়া এই পরিপার্শ্বে অন্য আরও অনেকের মতোই আমিও প্রতিদিন জেগে উঠি ভোঁতা মাথার এক বিসদৃশ অনুভূতি নিয়ে। ঘরের বাইরে বের হলে বিশুদ্ধ বাতাসেও মনে হয় মিশে আছে চাপা এক ভয়, অপরাধবোধ আর অদৃশ্য এক বিগ ব্রাদার—যে তোমার সবকিছু দেখছে। এ রকম অনুভূতির সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল না। চাকরিটা নেওয়ার পর থেকেই মূলত ধীরে ধীরে ভিন্ন এক জগতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমার। অনেক কিছুই এখন আমার নজরে পড়ছে, যা আগে পড়েনি, যেমন রাস্তাঘাটে, বাজার-সদাইয়ে, টিউবে চলাফেরায় মানুষজন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। প্রত্যেকের মুখই যেন একেকটা পাথরে কোঁদা মুখ। অভিব্যক্তিহীন।

আমার চাকরিটা এমন আহামরি কিছু না। আমি সেন্ট্রালের একজন তালিকাভুক্ত এক্সিকিউশনার—মানে জল্লাদ। সরকারি ঘাতকও বলা যায়, তবে এসব নামের প্রচলন তামাদি হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন কেবল ইতিহাস ঘাঁটলেই এসব নাম পাওয়া যায়।

সেন্ট্রাল জোনে আজ অনেক লোক জড়ো হয়েছে, খেয়াল করতে না চাইলেও চোখে পড়ছে, উপস্থিত লোকজনের মধ্যে প্রায় নিরানব্বই জনের মুখেই চাপা আতঙ্ক, চোখে কেমন উদ্‌ভ্রান্ত, বিহ্বল দৃষ্টি।

জানি, আমার আর এদের হাজির হওয়ার কারণ ভিন্ন।

আমি আজকের ডাকটার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরেই অপেক্ষা করছিলাম। দুই বছর ধরে কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য আমাকে ডাকা হয়নি। সাধারণত প্রতি চৌদ্দ মাস অন্তর একবার ডাক পড়ার কথা, তখন থেকেই একটা উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছি। ডাক এসে উদ্বেগের অবসান হয়েছে, কিন্তু আজ কাপড়-চোপড় পরে তৈরি হওয়ার পর নিজেকে কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগছে। একটা অস্বস্তি।

সকাল নয়টার দিকে জেগে গেছি আজ, নয়তো এমনিতে বরাবর দেরি করি ঘুম থেকে উঠি (পারতপক্ষে খুব জরুরি কিছু না হলে বিছানা ছাড়তে মন চায় না আমার), সে হিসেবে আজ কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়েছি আমি। বিছানায় বসেই রাতের বিশ্রী একটা স্বপ্ন মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে পড়েনি। এখন ঠিক সেন্ট্রাল জোনে ঢোকার মুখেও স্বপ্নটা আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলাম। এ যাত্রায় অস্পষ্ট কিছু জিনিস মনে পড়ল: একটা ছুরি, কোনো একটা অস্ত্রোপচারের টেবিল।

কিন্তু অপারেশনে আমি রোগী না ডাক্তার, মনে নেই।

এখানে এসে ভিড়ের মুখে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আজ যেন অনেক বেশি লোকের ডাক পড়েছে। অপেক্ষা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করারও নেই।

এখানে সবাই সমন পেয়েই হাজির হয়েছে। সামনে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো সবাইকেই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, ফলে লাইনের গতি স্বভাবতই ধীর।

আমি লাইনে না দাঁড়িয়ে লোকজন দেখি। সবুজ পোশাকের প্রক্টর বা রক্ষীদের দেখি। মনে মনে বিরক্তি বাড়ে। বাইরের এই খোলা হাওয়ার চেয়ে আসলে ভেতরে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঘরের ভেতরের স্থির ভোঁতা আবহ, ওই বদ্ধ পরিবেশই যেন আমার পছন্দের, কোনো তাপ-অনুতাপ নেই, শুধু এক ধরনের অসীম তন্দ্রালু সময়ে জেগে থাকা। আর কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে কোনো ব্যাপারেই মনে আর হোলদোল কাজ করে না। বরং বাইরে এলে নিজেকে কেমন পোশাক-পরিচ্ছদহীন, নেংটো নেংটো মনে হয়ে।

সেন্ট্রাল জোনে মস্তিষ্ক-পরীক্ষার স্ক্যানার যত্রতত্র, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, এখানে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা প্রায় নিশ্ছিদ্র। এ রকমই হওয়ার কথা। স্ক্যানারগুলোর কাজ হলো আমাদের মাথার ভেতরে চলা চিন্তার গতিপথ শনাক্ত করা, অনুসরণ করা। স্ক্যানার যত নিকটবর্তী হবে, একেকজনের চিন্তা তরঙ্গ তত লিপিবদ্ধ করবে যন্ত্রটা মেমরিতে, তারপর প্রাথমিক পরীক্ষায় উতরে গেল তো নিশ্চিন্ত, কিন্তু সবার পরিত্রাণ মেলে না। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, প্রাথমিকভাবে যদি কারও চিন্তা–প্যাটার্নে কোনো অসংগতি, বিপথু ভ্রষ্টতা শনাক্ত না হয়, তাহলে কারোরই এখানে ডাক পড়ার কথা নয়।

আমি দীর্ঘ লাইন ছেড়ে একটা ছোট লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে পাঠানো দায়িত্বসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের প্রিন্টআউট কপিটা এক ঝলক দেখাতেই দায়িত্বরত চেকার হাতের ইশারায় পথ ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিল। আমি ‘আই’ সেকশনে গিয়ে আমার জন্য সংরক্ষিত আসনটা খুঁজে নিলাম।

মোটা মখমলের আরামদায়ক চেয়ারে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে সেন্ট্রাল জোনের বিশাল কসমিক ফাইবারের চারপাশটায় নজর বোলালাম একবার। এই বিশাল হলঘর একসময় নাটকের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। নিয়মিত মঞ্চনাটক অভিনীত হতো এখানে। পরে কিছু সময় সস্তা বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীও হয়েছে। সে এক সময় গেছে বটে, তখনো জনপ্রতিনিধির শাসনামল ছিল, তারা যা হোক, অন্য অনেক সত্যি আমাদের চোখ থেকে আড়াল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর অনেক জল গড়িয়েছে, কত বদল ঘটে গছে দুনিয়াজুড়ে। অর্জিত নিয়মতান্ত্রিক শাসন, শান্তি—সব হারিয়ে গেছে বিস্তৃতিতে। এখন পুরোনো কিছুর আর বালাই নেই। এই হলঘর—সেন্ট্রাল জোন—শুধু অতীত স্মারক, আর যারা এ ব্যবস্থাবিরোধী, এ অবস্থা থেকে পালাতে চায় কিংবা নস্যাৎ করতে চায়, তাদের জন্যই এই মৃত্যুমঞ্চ। আর আমি তার একজন জল্লাদ।

ঠিক যে জায়গায় নাটকের মঞ্চ ছিল, সেখানে রাখা চেয়ারগুলো সব ভরে গেছে। মুহূতের্র জন্য মনে হলো, চুপচাপ বসে থাকা এই লোকগুলোর সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নেই, কিছুক্ষণের জন্য হলেও এক ধরনের অদৃশ্য ঐক্য যেন টের পাই আমি। কিন্তু কেন?

আমি আবারও আগ্রহ নিয়ে চেহারাগুলো দেখি, কোনো কোনো সময় অদৃষ্টপূর্ব কিছু ব্যাপারও সব আগ্রহ কেড়ে নিতে পারে, উপস্থিত লোকগুলোর বেশির ভাগের বয়স পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের ঘরে, তার মানে আগের বয়স হিসাবে এরা সবাই বিশ-পঁচিশ বছরের তরুণ।

বয়স যা–ই হোক, এরা সবাই অভিযুক্ত, বিদ্রোহী। সরকারি ভাষ্যে সমাজবিরোধী। এদের অনেকেই হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি, কেন তাদের এখানে ডেকে আনা হয়েছে। ওরা হয়তো জানেই না, ব্রেন স্ক্যানার ওদের মস্তিষ্কের গতিপথে নজর রাখছে বহু দিন ধরেই, ‘মারাত্মক বুদ্ধিভ্রংশের উপাদান’ শনাক্তের সব বিপদসীমা অতিক্রম করে গেছে বলেই আজ তাদের এখানে জড়ো করা হয়েছে। আজও সেন্ট্রাল জোনে ঢোকার পর থেকেই চারপাশে বসানো উচ্চক্ষমতার শক্তিশালী সব পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন রোবটিক কম্পিউটারে ফলাফলের চূড়ান্তভাবে বিশ্লেষণ চলছে। তবে এ পরীক্ষায় কদাচিৎ কেউ রেহাই পায়।

বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভার হয়ে আসে। কী ঝকঝকে তরুণ একেকজন... কখন ওদের মাথায় বিপজ্জনক ওই পোকা ঢুকে গেল, কখন ওদের মধ্যে মনোবৈকল্যের ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটল, কবে অমন বিপথগামী হয়ে গেল ওরা!

হঠাৎ মূল ফটকের কাছে একটা ধস্তাধস্তির দৃশ্যে চোখ আটকে গেল আমার, এক তরুণকে তিন রক্ষী প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসছে, তরুণ সমানে হাত–পা ছুড়ছে। কিন্তু ওদের ব্যূহ ছেড়ে বেরোতে পারল না সে। মঞ্চের আলোয় আসার পর ভুলটা ভাঙল আমার, আমি প্রায় বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার মতো চমকে উঠে দেখলাম ধস্তাধস্তি চালানো বিদ্রোহীটি একজন তরুণী।

প্যান্ট-শার্ট পরলেও তার মাথার অবাধ্য, মলিন কেশরাজি স্পষ্টত বিশ্বাসঘাতকতা করছে, ফর্সা মুখ আর প্রায় কোমর ছাপানো চুল—মুহূর্তের জন্য আমি স্থানকালের হিসেব হারিয়ে ফেললাম। পুরোনো এক স্মৃতি যেন ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে এল...

জোর-জবরদস্তির অবসান হলো মেয়েটাকে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার পর। তার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়েছে, নরম চামড়ার বেল্ট আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ফেলেছে তাকে চেয়ারের সঙ্গে, দুই পা–ও স্ট্র্যাপে বাঁধা পড়ল। বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি আরও এক সেট চামড়ার বেল্ট বেঁধে দেওয়া হলো, এই বেল্টের বুকের কাছটায় চারকোনা একটা পাতের মতো এসে বুকের ওপর চেপে বসেছে, বেল্টের একটা অংশে সংযুক্ত মোটা এক ইলেকট্রোড কেবলের সঙ্গে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগল মাত্র পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড।

তারপরই মেয়েটা একা।

আমি খুঁটিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। প্রথমে চুল থেকে শুরু হলো, তারপর চোখ কুঁচকে তাকালাম ওর চোখের দিকে। অদ্ভুত চোখ; হালকা বাদামি চোখের মণি, তার চারপাশে গাঢ় একটা বলয়ের মতো: খয়েরি আর যেন হলুদের। চকচক করছে চোখ দুটো।

কাঁদছে মেয়েটা। টলমল চোখের পানি উপচে পড়ে নামছে গাল বেয়ে। মুহূর্তের জন্য আমি আমার নিজের চেয়ারের কথা, এখানে আসার কথা সব বিস্মৃত হলাম... মেয়েটা পুরোই অধিকার করে নিল আমাকে। আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে আছে ও।

তখনই—ওর চোখ জোড়া হঠাৎ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল, আমাকে চিনতে পেরেছে ও।

‘সৌরভ!’

‘এলা?’

‘আমি জানতাম, তুমিও থাকবে এখানে।’

‘কত দিন পর দেখা হলো আমাদের, আমি তো ভুলেই যাচ্ছিলাম প্রায়।’

‘না। কক্ষনো ভুলো না, কক্ষনো না।’

মনে হলো আমি ঢেউয়ে ভেসে ভেসে যাচ্ছি। একটা বোট ট্রিপ ছিল, এক ফসিল দ্বীপে বায়োলজির এক্সপিডিশন, এলা ছিল আমার গ্রুপে। সবাই আগে আগে ফিরে গেছে। আমি আর এলা ইচ্ছে করেই রয়ে গিয়েছি, একটু পর দুজনে ফিরব বলে। পেছনে সূর্য তখন অস্ত যাওযার আগের অপার্থিব এক কমলা রং ছড়িয়ে দিয়েছে চরাচরজুড়ে, আমি যেন সেই প্রাচীন গল্প-উপন্যাসে পড়া কনে দেখা আলোর বিভ্রম নিয়ে এলাকে দেখলাম। কী সুন্দর!

আমি ছেড়ে দেওয়ার পর এলা ডান হাতে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তুমি একটা বর্বর।’

‘উঁহু, এটা প্রেমের প্রথম পাঠ!’

হলঘরের বাতির তীব্রতা কমে এল একবার, বাড়ল, আবার কমানো হলো। এবার নীল বাতি জ্বলল। আমার হাত স্ট্র্যাপের ওপর এনে রাখলাম, মধ্যমার নিচেই বোতাম। শরীর টান টান হয়ে গেছে। সামান্য সামনে ঝুঁকে এলাম।

এখনই লাল বাতি জ্বলবে।

তলপেটে মনে হলো নাড়িভুঁড়ি সব জট পাকিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে।

সামনের লাল বাতিটা ঠিক তখনই যেন দপ করে জ্বলে উঠল। ডান হাতলের ডান হাতের মধ্যমার নিচের লাল বোতামটায় যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চেপে বসল আঙুল। টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে এল পুরো হলরূম, সঙ্গে কতগুলো গগনবিদারী আর্তচিত্কার। মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমি বধির হয়ে গেছি।

মনে হলো, আমার গলা দিয়েও যেন একটা চিত্কার বেরিয়ে এসেছে। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঝটিতে ডান হাত সরিয়ে আনলাম লাল বোতামের ওপর থেকে...আঙুলে আগুনের সেঁকা লেগেছে যেন।

অবাক হয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিজের প্রতিক্রিয়ায় নিজেই স্তম্ভিত, হয়ে যাচ্ছি। বোতাম টেপার এ ঘটনা আমার জন্য এবারই প্রথম তো নয়। তাহলে? দরদর করে ঘাম বেয়ে নামছে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে।

এলার ওপর চোখ পড়ল; খোলা চোখ, রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

হঠাৎ অস্ফুটে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি, ঠোঁট কামড়ে ধরে গলা বেয়ে উঠে আসা কান্নার তীব্র দমকটা কোনোরকমে সামলে নিলাম।

কিন্তু ঝাঁপিয়ে এল আতঙ্ক। আমার ফুঁপিয়ে ওঠা কি কারও চোখে পড়েছে বা শুনেছে? গলার ভেতরে তখনো কাঁপন টের পাচ্ছি।

প্রক্টরদের পাথুরে মুখগুলো দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। ওরা কোনো কিছু বোঝেনি।

আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, পা কাঁপছে আমার থরথর করে। লাল বোতামে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চামড়ার বেল্ট আর বুকের ধাতব পাত থেকে তীব্র বিদ্যুত্প্রবাহ কীভাবে ওদের শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কল্পনা করতেই শিউরে উঠলাম আমি।

ধীর পদক্ষেপে, নিজের ভেতরে চলমান ঝড় গোপন করে বাইরে বেরিয়ে এলাম হলঘরের। বাইরে ঝাঁ চকচকে রোদ। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে হাতের মধ্যমার রিং-ঘড়ির দিকে তাকালাম।

এগারোটা পনেরো। দশটা চল্লিশে জোনে ঢুকেছিলাম।

এতগুলো প্রাণ বিনাশে কয় সেকেন্ড লেগেছে?

আমার কাজ শেষ। আবার এক বছর কি চৌদ্দ মাস কি আরও বেশি সময়ের অপেক্ষায় থাকা শুরু হল। নাকি এবার দ্রুতই ডাক পড়বে? অনেক দিন পর একটা সিগারেট ধরানোর তীব্র ইচ্ছে হলো। বুকের তোলপাড়টা কমাতেই যেন লম্বা করে একটা নিশ্বাস নিলাম। হলঘরের সামনে থেকে সরে এসে চকচকে সিরামিক ফুটপাতে উঠে এলাম। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, তুমি আর চিন্তা করে কী করবে! নিজেকে বোঝালাম। তুমি তো হুকুমের দাসমাত্র। এলাকে তুমি হারিয়েছ আরও পনেরো বছর আগে, এলার কারণেই তুমি এই গ্রহ ছেড়েছিলে না! মনে নেই? তাহলে আর তার জন্য শোক কেন...

ফুটপাত থেকে সামনে মোড় ঘুরলেই টিউব, বাঁকটা ঘুরব—ঠিক তখনই কাঁধে একটা হাত পড়ল, ঘাড় ঘুরিয়েই দেখলাম, হলঘরের প্রক্টরদের একজন, সঙ্গে আরও দুজন পোশাকধারী। কাঁধের হাত সরিয়ে নিয়ে প্রক্টর বলল:

‘দুঃখিত, ভাই। একবারে সুনির্দিষ্ট রিপোর্ট...। পুরো ডিসঅর্ডার কেস। যন্ত্র এখন সব পড়ে ফেলে...’ শেষদিকের কথাগুলো ফিসফিসানির মতো শোনাল তার।

দুজন পোশাকধারী ততক্ষণে দুই পাশ থেকে এগিয়ে এসে আমার বগলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে জাপটে ধরেছে।

আবার হলঘরের দিকে নিয়ে চলল আমাকে।