লোকমানের দিন

আরামবাগ ৯–এর ১২ নম্বরের গলির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ির গেটটা দেখে লোকমান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। দাঁত দিয়ে বার দুয়েক খোঁটার চেষ্টা করে তর্জনীর নখ উঠে আসা চামড়া। শেষে ‘ধুর, আমার আবার ভয় কিসের!’ বলে ফিরে আসে। গেটের দশাসই কলবেলটায় চেপে ধরে জোরসে। কিছুক্ষণ কোনো শব্দ-টব্দ হয় না। মনে হয়, সময় থেমে আছে। তারপরই ভেতরে একটা হল্লা শুরু হয়। দোতলা সিঁড়ি বেয়ে আসছে কে যেন। ঘর্ঘরিয়ে গেটের একপাশটা যখন খোলা হয়, একটা লাল চুলো মেয়ে মুখ বের করে দেয় অমায়িক হাসি। হাসিটা লোকমানের কেমন যেন লাগে। অবশ্য অমন জ্বলজ্বলে সুন্দরী মেয়ের এমন দেঁতো হাসিতে খানিকটা অন্য রকম লাগতেই পারে।

মেয়েটা লোকমানের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে তরল গলায় বলে, ‌‘তুমিই লোকমান! আমাদের মেইল করেছিলে।’

লোকমান কবুল করে সে কথা। গতরাতেই ও মেইল করেছিল। মেয়েটা নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি ক্রিস্টিন মেদুরি। ইওস-এর একজন টেকনিশিয়ান। এসো এসো, ভেতরে এসো।’

লোকমানকে নিয়ে ক্রিস্টিন ভেতরে চলে যায়। ‘আমি খুবই দুঃখিত তোমার জীবনে এমন খারাপ কিছু ঘটেছে।’ লোকমান সেটার জবাবে কী বলবে, ভেবে পায় না। ‘শোনো লোকমান, তুমি একদম ভাববে না। আমরা তোমাকে একটা সুন্দর জীবন বেছে দেব।’ লোকমান হেসে ফেলে এবার।

‘আমি এখনো নিশ্চিত না, এটা করা আমার ঠিক হচ্ছে কি না,’ বলে লোকমান।

‘কেন নয়! তোমার তো এখানে ক্ষতির কিছু নেই।’ ক্রিস্টিন আশ্বস্ত করে।

‘তা ঠিক, সেটা হয়তো নেই।’

গত সপ্তায় লোকমানকে ডাক্তার বলে দিয়েছে, ওর রক্ত শ্বেতকণিকায় ভরে যাচ্ছে। বড়জোর আর তিন মাস আয়ু আছে ওর। লোকমানের নতুন করে আর ক্ষতির কিছু নেই, এটা ক্রিস্টিনও জানে ইতিমধ্যে।

কিউবিকলের মতো একটা রুমে বসানো হয় লোকমানকে। আরাম করে বসার মতো একটা চেয়ার আছে সেখানে। বেশ কিছু মানুষ ক্লিপবোর্ডের মতো একধরনের স্ক্রিন হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।

ক্রিস্টিন লোকমানের সামনাসামনি এক চেয়ারে বসে। তারপর সরাসরি চলে যায় মূল বক্তব্যে।

‘তুমি হয়তো জানো, আমরা আসলে লাইফ এক্সেটনশন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের কাজ দুবছর আগে পর্যন্ত ছিল সত্যিকারের এক্সটেনশন, এ বছর থেকে আমরা সেটা ভার্চুয়াল এক্সটেনশনেও ভাবছি। তুমি চাইলে আমাদের রেকর্ডকৃত যেকোনো একটা দীর্ঘজীবন কাটাতে পারবে।’

লোকমানের হাসপাতালে ইওসের বিজ্ঞাপনটার কথা মনে পড়ে: ‘আপনার আয়ু কি ৬ মাসের কম, তাহলে আমরাই পারি আপনাকে দীর্ঘ জীবনের সত্যিকারের স্বাদ দিতে।’

লোভনীয় বিজ্ঞাপন। প্রচুর ব্যয়বহুল এই সার্ভিস ইওস টার্মিনাল স্টেজে থাকা রোগীদের বিনা মূল্যে দিচ্ছে।

‘এর মধ্যে আমাদের হাতে এসব রেকর্ড আছে,’ ক্রিস্টিন লোকমানের সামনে একটা মেনু তুলে ধরল। হাতের ইশারা করতেই স্ক্রিনে ক্রমান্বয়ে বেশ কজন বিখ্যাত মানুষের মুখ উঁকি দিয়ে যায়। জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রত্যেকের মুখের পাশে তারকা চিহ্ন দেয়া আছে। পাঁচ তারকা দেওয়া মুখগুলোর প্রায় সব কটিকেই লোকমান চিনতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ।

ক্রিস্টিন জানায়, ‘ব্যাপারটা কিছুটা স্বপ্ন দেখার মতো, তোমার কাছে সময়টা এক্সপ্যান্ড হয়ে যাবে। কয়েক মিনিটে তুমি আমাদের ডেটাবেসের যে কারও জীবনের একটি দিন কাটিয়ে আসতে পারবে। আমরা এর মধ্যে বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছ তাদের স্মৃতি কিনেছি!’

লোকমান ইতস্তত করে বলে, ‘আমি কি সে সময় বুঝতে পারব যে এসব সত্যি নয়, আমি আসলে অন্য একজনের জীবন যাপন করছি?’

‘ভালো প্রশ্ন করেছ। শুরুর দিকে তোমার মনে থাকবে। তারপর একসময় ভুলে যেতে শুরু করবে। মনে করবে ওই জীবনটাই বুঝি আসল।’

‘কিন্তু এটা তো জীবন কাটানো হলো না, বরং সিনেমার মতো কোনো রেকর্ডকৃত জীবন দেখার মতো হয়ে গেল না?’

ক্রিস্টিন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা কিছুটা স্মৃতি রোমন্থনের মতো। কিন্তু সেটা অত্যন্ত বাস্তব বলে মনে হবে। সে সময়কার দুঃখ-কষ্ট যেমন অনুভব করবে, ভালবাসা-সুখও সত্যিকার জীবনের মতোই অনুভব করবে।’

‘যদি জীবনটা অসহ্য মনে হয়?’

‘ভয় নেই। এর দৈর্ঘ্য এক দিনের বেশি হবে না। এর বেশি আমরা অনুমতি পাইনি। তা ছাড়া আমরা যাদের কাছ থেকে স্মৃতি নিয়েছি, তাদের থেকেও একটা নির্দিষ্ট দিনের পুরো স্মৃতিটা আমরা নিতে পেরেছি সহজে। এর বেশি হলে স্মৃতিটা নিখুঁত হতো না।’

‘কিন্তু এক দিনের স্মৃতি থেকে দীর্ঘ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা কেন হবে?’

ক্রিস্টিন প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুতই ছিল, ‘তুমি যখন আমাদের ডেটাবেসের ৪০ বছর বয়সী কারও স্মৃতিতে একটা দিন কাটাবে, তুমি তার পুরো চল্লিশ বছরের জীবনকে অনুভব করতে পারবে। ঠিক এখন যেমন তুমি, তোমার যে বয়স...’

‘২২ বছর!’ লোকমান ক্রিস্টিনকে কাগজে ওর বয়স খুঁজতে দেখে সাহায্য করে।

‘হ্যাঁ, তোমার ২২ বছরকে অনুভব করতে পারো। বয়স্ক কারও স্মৃতিটা যাপন করার পর তুমি ওই প্রোফাইলের দীর্ঘ জীবনটাও অনুভব করতে পারবে।’

লোকমান কথাটা শুনে স্বস্তি বোধ করে। ‘আচ্ছা, তাহলে আমি ট্রাই করতে রাজি।’

ক্রিস্টিন মাথা নেড়ে স্ক্রিনের মতো ক্লিপবোর্ডটা বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। ‘এখানে তোমার একটা স্বাক্ষর লাগবে তাহলে। আর একটা ছোট শর্ত আছে আমাদের। সেটা হচ্ছে, তোমাকে আমরা এই ব্যয়বহুল সার্ভিসটা ফ্রি দেব, এর বিনিময়ে তুমি তোমার আজকের স্মৃতিটা আমাদের ডেটাবেসের জন্য দেবে।’

লোকমান হেসে ফেলে। বলে, ‘কী বলছ? আমার জীবন খুবই নিরানন্দের। আজীবন কষ্ট করেছি। যখন একটু ভালোভাবে বাঁচতে শুরু করেছি, তখনই এই ক্যানসার বাধিয়ে বসলাম। আমার জীবন কে কাটাতে চাইবে!’

ক্রিস্টিন লোকমানের হাত ধরে বলল, ‘সেটা আমরা জানি, লোকমান। কিন্তু আমরা হিসেব করে দেখেছি, সুদূর ভবিষ্যতে তোমার জীবনও আমাদের জন্য মূল্যবান হতে পারে।’

লোকমান আর কথা বাড়ায় না। স্বাক্ষর করে ক্লিপবোর্ডটা ক্রিস্টিনকে ফেরত দেয়।

‘এবার তুমি একটা জীবন বাছা শুরু করো। তবে চাইলে তুমি সময় নিতে পারো।’ ক্রিস্টিন মৃদু হেসে আশ্বস্ত করে। ‘আমাদের ডেটাবেসের জনপ্রিয় প্রোফাইলের যেকোনোটা তুমি নিতে পারো। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আছেন, সফল চিত্রতারকা আছেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও আছেন। তুমি অন্য জেন্ডারের কারও জীবনও বেছে নিতে পার। অনেকেই সেটা ট্রাই করে।’

লোকমান সময় নষ্ট না করে অপশনগুলোতে আবার মনোযোগ দেয়। একজন পরিচিত অ্যাথলেটকে নির্বাচিত করে সে।

‘দারুণ পছন্দ।’ বলে ক্রিস্টিন কোনো একটি বাটন প্রেস করে টেবিলের। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে একটা মসৃণ গোলাকার ডিভাইস নেমে এসে লোকমানের মাথার খুব কাছে স্থির হয়।

ক্রিস্টিন এগিয়ে এসে ডিভাইসটা থেকে বের হওয়া একটা ইলেকট্রোড লোকমানের কপালে লাগিয়ে পেছনে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে বলল। সেটা করার পর লোকমান অনুভব করে, খুব ধীরে ধীরে ওর চেনা জগত্টা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

ইয়ুয়ান মাথা থেকে হেলমেট সরিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে বলে, ‘এটা ভালো। গত মাসেরটার চেয়ে ভালো। আমি আগের চেয়ে একটু বেশি জীবন সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছি। এগুলো আমাকে আগে দেখতে দেওয়া হয়নি কেন? এটা কেমন কথা?’

‘স্যার, সাধারণত বয়স ৫০০ পেরোবার পর এই সার্ভিস আমরা প্রভাইড করতে পারি। আপনি জানেন, এ ব্যাপারে কড়া আইন আছে। ৫০০ বছরের আগে কেউ যদি তার জীবনের দীর্ঘায়ু নিয়ে আপত্তি করে, তাহলে তার অন্য চিকিত্সা নিতে নির্দেশনা আছে।’

ইয়ুয়ান ব্যাপারটা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।

গত মাসে এক ফাঁসির আসামির শেষ দিনটি ও কাটিয়ে এসেছে। জীবনের জন্য যে আকুতি ও অনুভব করেছে, ওটা কাটানোর পর বেশ কিছুদিন আত্মহত্যার কথা মাথায়ই আনেনি। আজ লোকমানের দিনটি দেখার পর জীবনটাকে কত মধুরই না মনে হচ্ছে।

কিউবিকল থেকে বের হয়ে ইয়ুয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গত কয়েক দশক ও কী নিরুত্সাহিত জীবন যাপন করেছে, অথচ ইওসের এই চমত্কার সার্ভিসটা নিতে পারেনি কম বয়সের কারণে। এসব আইনের কোনো মানে হয়!