সার্কাস

এটাই তো সে জায়গা?

হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। নিতু একটা ছবি বের করে পেছনের বুনো গাছপালায় মোড়া পাহাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিল। আমিও ছবিটা হাতে নিয়ে মিলালাম। হুম, কোনো সন্দেহ নেই। এই সে জায়গা।

বান্দরবান শহর থেকে জায়গাটা প্রায় তিন মাইল দূরে, গাড়ির পথ শেষ হয়েছে বেশ আগেই। দুর্গম বুনো পথে ট্র্যাকিং করে বাকি রাস্তা আসতে হলো। শহর থেকে গাইড উথাং বাহাদুরকে নিয়ে এসেছিলাম, অবশ্য রাজি করাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। উথাং বলছে, ওই এলাকায় দেখার মতো কিছু নেই, পথঘাটও সুবিধের না, পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস না থাকলে বিপদে পড়ব আমরা। আমার সঙ্গে নিতু ছিল বলে বোধ হয় আরও ভরসা পাচ্ছিল না। নিতুই অবশ্য পরে রাজি করিয়েছে, আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি সেটা জানার পর উথাং বাহাদুরের না করার উপায় ছিল না।

শেষ মারমা গ্রামটা পেরিয়ে এসেছি আরও অন্তত দেড় কিলোমিটার আগে। এতক্ষণ পর্যন্ত পায়ে হাঁটা পথের একটা ট্রেইল ছিল, সেটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসের তপ্ত বাতাস অনেকটাই শীতল হয়ে এসেছে ঘন অরণ্যে, মাঝে মাঝে কুলকুল শব্দে জানান দিচ্ছে পাহাড়ি ঝরনা।

নিতুর বেশ কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু একবারের জন্যও থেমে বিশ্রাম নেয়নি। পাহাড়ি পথ ক্রমেই ওপরে উঠছে, হয়ে উঠছে আরও দুর্গম। উথাং আমাদের দুজনকে দুটো বাঁশের কঞ্চি ধরিয়ে দিয়েছে হাঁটাচলায় সুবিধের জন্য। পিঠের ব্যাগটা যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্বও কমে আসছে, জায়গাটা কত উঁচু কে জানে!

‘আর কত দূর!’ নিতু শেষমেশ এক পাথরের ঢিবিতে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্নটা করল।

‘এই তো আরেকটু দিদি। সামনের টিলাটা পার হলেই!’

‘ঠিকঠাক পথে এসেছি তো বাহাদুর, এমন দুর্গম জায়গায় কেউ সার্কাস দেয়?’ আমি প্রশ্নটা না করে পারি না।

‘কী আক্কেলে দিল কে জানে!’ বাহাদুর আর কথা বাড়ায় না।

নিতুর বড় বড় চোখ দুটোতে লক্ষ করলাম সমস্ত ক্লান্তি ছাপিয়েও একধরনের ঔজ্জ্বল্য। রকিবকে খুঁজে পাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা এত দিন পর এসেছে। যদিও আমি আশাবাদী হতে পারি না। গত সপ্তাহে ‘অদ্ভুত সার্কাস’ নামে এক দৈনিকে একটা খবর বেরোয়। বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে নিউ বেঙ্গল সার্কাস নামে এক সার্কাস কোম্পানি সার্কাসের আসর বসিয়েছে। প্রতিবেদক জানিয়েছেন, এমন অদ্ভুত সার্কাস তিনি আগে দেখেননি। কেননা একে তো এত দুর্গম অঞ্চলে সার্কাস বসাটাই আশ্চর্যের, তার ওপর শোর খেলাগুলোও অদ্ভুত। শুধু ভালুকের খেলা। খবরটা বেশ অনুল্লেখযোগ্য বিষয়ের মতো করে ছাপিয়েছে দৈনিকে, দেশের আনাচকানাচের খবর নিয়ে প্রকাশিত পাতায় বেশ ছোট করেই। কিন্তু প্রতিবেদকের বিস্ময়ের কোনো কমতি ছিল না লেখাটায়। সঙ্গে একটা ছবিও তিনি দিয়েছেন—নিউ বেঙ্গল সার্কাসের তাঁবুর ছবি। বিশাল এক তাঁবুর সামনে ছোট একটা কাউন্টারে এক লোক বসে, সম্ভবত সার্কাসের কর্মচারী। সেই ছবির লোকটির সঙ্গে আমাদের রকিবের আশ্চর্য মিল রয়েছে।

রকিবের সঙ্গে নিতুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল প্রায় মাস ছয়েক আগে। সবকিছু ঠিকঠাক, কিন্তু হঠাৎ করেই বিয়ের দুই সপ্তাহ বাকি থাকতে ও লাপাত্তা হয়ে যায়। এমনিতেই ঘোরাঘুরির বাতিক ছিল ওর, অফিস থেকে এক-দুই দিনের ছুটি পেলেই একা একা নানা দুর্গম অঞ্চলে ঘুরে না বেড়ালে ওর স্বস্তি হতো না। নিতুকে না জানিয়ে আগে কখনো গিয়েছিল কি না, সেটা অবশ্য নিতুরও জানা নেই।

তারপর রকিবের খোঁজ নেই তো নেই, কোথাও নেই। অফিসের কেউ কিছু জানে না, বাসার কেউও না। ওর অবশ্য বুড়ো বাপ-মা ছাড়া কেউ নেই বাড়িতে। কাছের বন্ধু বলতে আমিই ছিলাম। আমি আর নিতু মিলে ছয় মাস ধরে নানা জায়গায় ওকে খুঁজে চলছি। কান্নাকাটির পর্ব শেষ হয়েছে আগেই, আশাও ছেড়ে দেওয়ার সময় এসে গিয়েছিল। এমন সময় পত্রিকার খবরটি ছাইচাপা আশাটা আবার উসকে দিয়েছে।

ফের যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যার আগে আগে টিলাটায় পৌঁছালাম। এপাশটায় কোনো পথই নেই, বন-জঙ্গল মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে। যেখানে একটা সার্কাস বসেছে জলজ্যান্ত, সেখানে এমনটা তো কিছুতেই হওয়ার কথা নয়, নিশ্চয়ই উথাং বাহাদুর সঠিক পথটা চেনে না। টিলা থেকে নামার পথে তাঁবুটা প্রথম চোখে পড়ল। বেশি উঁচু না হলেও বেশ বড় জায়গাজুড়ে পাতানো তা ঠাহর করতে পারলাম। আরেকটু যেতেই পুরো অবয়বটা আন্দাজ করা গেল। ছোটখাটো একটা ইনডোর স্টেডিয়াম এঁটে যাবে ওটাতে, গাছপালা এবং টিলার একটা অংশ নিশ্চয়ই কাটতে হয়েছে তাঁবু পাতার জন্য। এরা কি প্রশাসন থেকে ঠিকঠাক অনুমতি নিয়ে এখানে সার্কাস বসিয়েছে? বিশ্বাস হয় না।

উথাং জানাল, সার্কাসটা এখানে বসেছে প্রায় বছরখানেক। আশপাশের কিছু গ্রাম থেকে লোকজন আসে আর কেউ যদি ঘুরতে এসে আসে—দর্শক বলতে এরাই। দর্শক হোক বা না হোক, প্রতি সন্ধ্যায় নাকি একটা শো হয়। ভাল্লুকেরা নানা কসরত করে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর খেয়াল করলাম একটা নরম হলুদ আলো জ্বলছে তাঁবুজুড়ে। একপাশে একটা গেটের মতো, ওটাই বোধ হয় এন্ট্রি।

নিতু সতর্ক চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে, আশপাশে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে, এক-দুজন স্থানীয় আদিবাসী, সার্কাসের কর্মচারীরা কয়েকজন মিলে একপাশে কী যেন করছে। একটা গম্ভীর গমগম আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। শো হচ্ছে নাকি?

টিকিট কাউন্টারের মতো একটা কাপড়ে মোড়া স্টল পাওয়া গেল। সেখানে গিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারতেই হঠাৎ করে এক লোক যেন অন্ধকার থেকে উদয় হলো। লোকটার বয়স আনুমানিক চল্লিশ, ফরমাল শার্ট-প্যান্ট পরনে, মাথায় অদ্ভুত রকমের একটা টুপি, সামনে-পেছনে দুই দিকেই ছাদ আছে। লোকটা এসেই হাসিমুখে বলল, ‘নিউ বেঙ্গল সার্কাসে আপনাদের স্বাগত, আর কিছুক্ষণ পরই আমাদের শো শুরু হবে। আপনাদের কয়টা টিকিট লাগবে?’

নিতু হড়বড় করে বলল, আমরা আসলে একজনকে খুঁজতে এসেছি। রকিব নামে কেউ কি এখানে আছে?

কথাটা সে বুঝতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না, আবার বলল, কিছুক্ষণ পরেই আমাদের শো শুরু হবে। আপনাদের কয়টা টিকিট লাগবে।

নিতু আবারও কথাটা বলল যে আমরা আসলে টিকিট কাটতে আসিনি। কিন্তু লোকটা মনে হয় কানে কিছু শোনে না, রোবটের মতো টিকিটের কথা বলে গেল। আমি এবার গিয়ে বললাম, ঠিক আছে, দুইটা টিকিট দিন।

সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে কাউন্টারের ড্রয়ার থেকে দুটো টিকিট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। তার মানে কান ঠিকই আছে।

কত?

কুড়ি টাকা করে মোট চল্লিশ টাকা।

আমি দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের বাকি লোকজন কই? তাদের সঙ্গে একটু কথা ছিল। কিন্তু এ কথাটাও বোধ হয় ওর কানে ঢুকল না। অপরিচিত জায়গা না হলে নিশ্চিত লোকটার কলার ধরে বসতাম আমি এতক্ষণে। কোনোমতে রাগ সামাল দিয়ে নিতুর দিকে ফিরে বললাম, চলো ভেতরে গিয়ে দেখা যাক। কাউকে পাই কি না।

বাহাদুরকে আমাদের ব্যাগগুলো গছিয়ে দিয়ে বললাম, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। তুমি এগুলো নিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করো বাইরে।

তাঁবুর দিকে এগোতে গিয়ে লক্ষ করলাম, তাঁবুটার আশপাশে বেশ কিছু ভালুকও বসে আছে গা এলিয়ে। এগুলো দিয়েই খেলা দেখায় ওরা? বিশাল আকৃতি একেকটার, দেখেই গা কেমন শিরশির করে উঠল, এ রকম দুর্গম জায়গায় ওদের নিয়ে এলই বা কীভাবে?

একটা সরু এন্ট্রি দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি। ভেতরের গমগম আওয়াজটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে বেড়ে গেল আরও।

কী হচ্ছে!

গলি শেষ হলো বিশাল এক হলরুমের মতো জায়গায়। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ভেতরে প্রচণ্ড ঠান্ডা, অথচ বাইরে অসহ্য গরম, মনে হচ্ছে পুরো জায়গাটা শীততাপনিয়ন্ত্রিত, কিন্তু সেটা কি এই জায়গায় সম্ভব?

সারি সারি আসন ক্রমেই নিচে নেমে গেছে। সামনে ছোট একটা মঞ্চের মতো। হলুদ মৃদু আলোয় সমানভাবে পুরো জায়গা আলোকিত হয়ে আছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখি অল্প কিছু মানুষ দর্শকের সিটে বসে আছে।

মাঝামাঝি জায়গায় সিট নিয়ে আমরা বসে পড়ি। সামনে ভালুকের কী খেলা হচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না মোটেও, বরং আশপাশটা খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম। পুরো হলরুমটা দেখে মনে হচ্ছে ষাটের দশকে যে ধরনের সার্কাস আমরা সিনেমায় দেখেছি, ঠিক সে রকমই কেউ বানিয়েছে। এর ইন্টেরিয়র যে করেছে মনে মনে তাঁর প্রশংসা না করে পারি না। উঁচু ছাদ থেকে রিং ঝুলছে, বেশ কয়েকটা তার চলে গেছে এক পাশ থেকে অন্য পাশে।

হঠাৎ প্রায় দশটা ভালুক মঞ্চে চলে এল, আর শুরু করল বিচিত্র এক নাচ। ওদের নিয়ন্ত্রণ করছে দেখলাম শীর্ণকায় এক লোক, ভালুকগুলোর তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র আর দুর্বল—এত শক্তিশালী প্রাণীগুলোকে হাতের ভঙ্গিতে নাচিয়ে নিচ্ছে ব্যাপারটা বেমানান, অবশ্য সব সার্কাসেই এই দস্তুর। খেয়াল করে বুঝলাম সার্কাসের সবার ড্রেস কোড একই, মঞ্চের লোকটিও বাইরের কাউন্টারের লোকটির মতো শার্ট আর ঢোলা প্যান্ট পরেছে, মাথায় দুছাদঅলা টুপি।

ইচ্ছে না থাকলেও কীভাবে যেন ভালুকের নাচে তন্ময় হয়ে ছিলাম, সংবিৎ ফিরে পেলাম কিছুক্ষণ পর। দেখি পাশে নিতু নেই। কই গেল?

নিশ্চয়ই রকিবকে খুঁজতে একাই বেরিয়ে গেছে। ও কি আমার ঔদাসীন্যে বিরক্ত, না হলে আমাকে না বলে একাই গেল কেন? নাকি আমাকে ঝামেলা করতে অনুরোধ করতে পারছে না। ব্যাপারটা ভেবে অবশ্য কিছুটা রাগও হলো, এত দূর আসার পরও যদি এমনটা ও ভাবে, তাহলে ব্যাপারটা খুব মর্মান্তিক!

মঞ্চের ডান পাশে একটা ছোট দরজার মতো আছে সেটা আগেই খেয়াল করেছি। ওখান দিয়ে সার্কাসের লোকেরা যাতায়াত করছিল। আমার মনে হলো, নিতুও ওখান দিয়েই ভেতরে ঢুকেছে। বসে থাকার যুক্তি নেই, আমি চুপিচুপি উঠে ওই দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ওই পর্যন্ত যেতে খুব বেশি কসরত করতে হলো না। একটা পার্টিশনের মতো থাকায় চোখে পড়ার সম্ভাবনা বেশ কম। দরজাটা খুলে চট করে ঢুকে পড়লাম। ঢুকতে আরও একটু চমকালাম, এখানে তাপমাত্রা মনে হলো আরও কম। আর পায়ে ফ্লোরটা কেমন ধাতব ঠেকল। একটা নীল আলোর ট্রেইল চলে গেছে মাথার ওপর দিয়ে। এই নিউ বেঙ্গল সার্কাস তো যে সে সার্কাস টিম নয়। যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি!

গলিটা সরু, একটু সামনে গিয়ে ভাগ হয়ে দুই দিকে চলে গেছে। নিতু কোন দিকে গেছে খোদা মালুম! আমি এত না ভেবে ডান দিকে চলে গেলাম। গিয়ে আরেকটা দরজা পেলাম। এটা দেখলাম আবার গোল! যেন জাহাজের দরজা। ওপাশে কে বা কারা আছে কে জানে, এতক্ষণে আমার ভেতর কেমন এক শঙ্কা ঢুকে গেছে। জায়গাটাতে আরও কোনো বড় কাণ্ড ঘটছে বলে মনে হলো। আমি আস্তে করে সামান্য খুলে প্রথমে উঁকি দিলাম।

উঁকি দিতেই আমার আত্মা পাঁজর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

কী দেখছি আমি!

দেখলাম দরজার ওপাশে এক বিশাল গহ্বর, নীল আর হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত। তাতে সিঁড়ির মতো খাঁজকাটা অনেক স্তর, যেন কোনো কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে, জায়গায় জায়গায় ধাতব বিম আর তার বেরিয়ে আছে। আর প্রতিটি স্তরে কাজে ব্যস্ত অন্তত তিন-চার শ ভালুক। পুরো গহ্বরটা ধাতব আর যান্ত্রিক। গমগম আওয়াজটার উত্সও এ জায়গাটাই।

আমি আঁতকে দরজা থেকে সরে এসেছি।

আমার মনে হলো, এই ভালুকগুলো আমার চেনা ভালুকগুলোর মতো নয়। এদের কেউ লুকিয়ে রাখতে চাইছে, এরা অন্য কিছু করছে। তাই সার্কাসের তাঁবু টানিয়ে রেখেছে, যাতে কারও চোখে পড়লেও অস্বাভাবিক না ঠেকে।

আমি দ্রুত পায়ে পিছিয়ে এলাম। গলির অন্য প্রান্তে এসে যেই মোড় ঘুরতে যাব, তখনই শুনলাম নিতুর চিত্কার। এটা আসছে দুমুখী রাস্তার বাঁ পাশ থেকে। দৌড়ে আমি ওখানে গিয়ে দেখি, নিতু একটা ছেলেকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে।

রকিব, এই রকিব। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না।

তার মানে রকিবকে পেয়েছে? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি দৌড়ে ওদের কাছে পৌঁছে যাই।

নিতু আমাকে দেখে কেঁদে বলল, দেখেন তো, ওর কী হয়েছে। আমাকে চিনতে পারছে না।

আমি নিতুর দিকে ফিরে ফিসফিস করে বললাম, নিতু দ্রুত ফিরতে হবে। এখানে বড় কোনো ঝামেলা আছে। তারপর আমি রকিবকে টানতে টানতে গলি দিয়ে বেরোনো শুরু করি।

কিন্তু গলির মুখে আসতেই বুঝতে পারি ওখানে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিশালকায় ভালুক, আমরা ঢুকেছি সেটার খোঁজ পেয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কয়েকজন মানুষও রয়েছে। সবার পরনে একই পোশাক। রকিবের পরনেও তাই। মাথায় দুই ছাদের ক্যাপ, সাদা শার্ট আর ঢোলা প্যান্ট। সবারই চোখ কেমন ভাবলেশহীন!

বুঝতে পারলাম আমরা আটকা পড়ে গেছি, বেশ বড় কোনো ঝামেলায় পড়ে গেছি। এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে ভেতরে ভেতরে আমি শিউরে উঠি।

ওদের একজন হাতে করে কী যেন নিয়ে এসেছে। দুটো প্যাকেটের মতো। প্যাকেট দুটো বাড়িয়ে দিল আমাদের দিকে। আমি বুঝতে পারছিলাম ওতে কী আছে।

দুই সেট পোশাক, সাদা শার্ট, ঢোলা প্যান্ট আর একটা করে দুই ছাদঅলা টুপি।

***

উথাং বাহাদুর বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন প্রায় বিরক্ত হয়ে তাঁবুতে ঢুকতে যাবে, তখনই দেখল ওরা বেরিয়ে আসছে। উথাং ওদের কাছে গিয়ে তাড়া দিয়ে বলল, চলেন এখনই রওনা হতে হবে দিদি! আজকে রাতে এক মারমা গ্রামে থাকতে পারবেন, কিন্তু এখনই না গেলে সেই ব্যবস্থাও করা যাবে না।

নিতু জবাবে ওর দিকে ফিরে অমায়িক হাসি দিয়ে বলল, ‘নিউ বেঙ্গল সার্কাসে আপনাকে স্বাগত!’

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত