সিঙ্গুলারিটি

দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মহাজাগতিক পর্যায়েও। ‘বিশাল’ কথাটা তখনই খাটে, যখন আপনি বাইরে থেকে দেখছেন। ভেতর থেকে দেখলে একটা কৃষ্ণগহ্বর তো একটা বিন্দুই। জগতে কোনো বিশাল বা ছোট কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে না, ভেতর থেকে।

আমাদের ছায়াপথের ঠিক মাঝখানে যে একটা ‘ক্ষুদ্র’ কৃষ্ণহ্বর ছিল, এটা কম-বেশি সবার জানা। কিন্তু সেটা যে কালক্রমে পুরো ছায়াপথটাকেই গ্রাস করে এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে, কে অনুমান করেছে! এখন আর প্রশ্ন করে লাভ নেই, কতদিন ধরে এই অবস্থা। ওই প্রশ্নের আর অর্থ নেই। কেননা, এখানে সময় নিজেও নিজের মধ্যে আছড়ে পড়েছে। ভেতর থেকে।

ছায়াপথ গ্রাসের আগের ক্ষুদ্র কিংবা পরের বিশাল কৃষ্ণগহ্বরে তফাৎ করবেন কী করে, উভয়ের কেন্দ্রে যে একই সিঙ্গুলারিটি।

এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ৫২ হাজার ৮৫০ আলোকবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমাদের এই সুবিশাল ছায়াপথ নিজের ভারে নিজের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে যে করুণ পরিণতি বরণ করেছে, ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিতে সেটার নাম ‘বিন্দু’। কেউ যেন দুনিয়াটাকে কাগজের দলার মতো মুঠোয় পাকিয়ে একটা অসীম ক্ষুদ্র জায়গায় এনে ঠেকিয়েছে। এখানে স্থান হারিয়ে ফেলেছে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ, এমনকি সামনে-পেছনে নামক সকল স্থানিক বৈশিষ্ট্য। আর কাল হারিয়ে ফেলেছে আগে-পরের পরম্পরা। ছায়াপথের যাবতীয় বস্তুরাজি এখন একই স্থানে, একই সময়ে বিদ্যমান। জগতের সব ঘটনা ঘটছে একই জায়গায়, একই মুহূর্তে।

কিংবা আরেকভাবে দেখলে, জগতে আর কিছুই ঘটছে না। একটা বিন্দুতে গিয়ে সবকিছু স্থির হয়ে আছে।

জগৎ কি যুগপৎ নাকি ঘটনাহীন – নির্ভর করছে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সেজন্যে বলি, দৃষ্টিভঙ্গিই সব।

আমরা ভেবেছিলাম কৃষ্ণগহ্বর সবকিছুর যবনিকা। এখানে এসে জগত হাত ধুয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের এই ছায়াপথ নিয়ে সব কথা এখনও বলা হয়ে যায়নি।

এক অতিকায় ইভেন্ট হরাইজনের এই পারে, এই তল্লাটে, যেখানে কেউ আর উঁকি দিতে পারে না, পারবে না, যেখানটা সবকিছুর অগোচর, সেই নিঃসীমতার ভিতরে, এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুতে কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে টিকে গেছে সকল তথ্য। আমাদের ছায়াপথের সাড়ে ১২শ কোটি বছরের সকল ঘটনা, সকল বৃত্তান্ত অবিকৃত থেকে গেছে। কে জানত তথ্য এমন অক্ষয়, বিবরণ এমন চিরস্থায়ী! কে কল্পনা করেছিল, জগত ফুরিয়ে গেলেও তার সকল হাসি-কান্না টিকে যাবে!

এখানে এক ক্ষণিক-মুহূর্তের ভেতরে ঠেসে পুরে দেওয়া হয়েছে সমস্ত যুগ-অতিযুগ-মহাযুগ। তাতে ব্যাপার যা দাঁড়িয়েছে, তা হলো: ইতিবৃত্ত থেকে গেছে, কিন্তু মুছে গেছে ইতিহাস। কেননা এই জগতে পারম্পর্য বলে কিছু আর নেই।

সিঙ্গুলারিটি নামক এই বিন্দু-জগতে সকল ঘটনার শুরু ও পরিসমাপ্তি একই সঙ্গে ঘটে গেছে। একজন ব্যক্তি যে মুহূর্তে জন্মেছেন, সেই মুহূর্তেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যে মুহূর্তে তিনি বিয়ে করেছেন, একই লহমায় ঘটে গেছে তার বিয়ে-বিচ্ছেদ। ওখানেই। বিয়ের পিঁড়িতে। কেননা স্থানিক পরস্পরায় বিয়ের পিঁড়িই ডিভোর্স রেজিস্ট্রারের চেম্বার।

এখানে খুনি ধরা পড়ে গেছে হত্যামুহূর্তে, আর হত্যাকালে যখন সে উন্মত্ত ক্রোধে আক্রান্তের বুকে ছুরি চালাচ্ছে, ততক্ষণে ওই খুনের দায়ে বিচার শেষে কার্যকর হয়ে গেছে তার ফাঁসি। খুন আর বিচারের এই ফাঁকহীন অবসরে কালো ওভারকোট আর বোওলার হ্যাট পরা একটা লোককে আমরা ভ্রু কুচকে ঘটনাস্থলে আলামত ঘাঁটতে দেখি, দেখি অতিযত্নে মাটিতে পড়ে থাকা সিগারেটের ছাই সংগ্রহ করতে।

এখানে সকল সুর্যোদয় ঘটেছে সুর্যাস্তের মুহূর্তে। মঞ্চে পরিবেশিত সকল নাটকের পর্দা ওঠার সময় ঘটেছে যবনিকাপাত।

এখানে, এই সিঙ্গুলারিটিতে, দুর্ভিক্ষ আর অতিফলন পাশাপাশি ঘটেছে। কোনটা যে কারণ, আর কে যে কার ফলাফল – নির্ণয় কঠিন। এখানে নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে বিবর্তনের অবকাশহীন, যেনবা একটা কৌটা থেকে খেলনার মতো সকল প্রজাতি একইসঙ্গে ঢেলে দেওয়া। এখানে ডাইনোসরের বিলুপ্তি আর গ্রহাণুর আছড়ে পড়ার মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কারের উপায় নেই। এখানে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে কালো দাসভর্তি পালতোলা জাহাজ আর লিবিয়া থেকে ইউরোপমুখী অভিবাসীদের কাঠের বোট একই ঢেউয়ে পাশাপাশি দুলতে থাকে।

এখানে গৌতম বুদ্ধ আর অ্যামশেল মায়ের রথসচাইল্ড সমবয়সী, তুতেনখামেন সমাহিত হয়েছেন তরুণ গগৈয়ের পাশে। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাইনল্যান্ডে ট্রেঞ্চের ভেতর দিয়ে যখন দুই সৈন্য ছুটছে বোমায় আহত, রক্তাক্ত সহযোদ্ধার স্ট্রেচার কাঁধে করে, ঠিক তখন তাদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছে, হতচকিত হয়ে তারা উঁকি দিয়ে দেখেছে হিরোশিমার আকাশে মাশরুমের মতো জমা হতে থাকা পারমাণবিক মেঘপুঞ্জ। তারা যদি পায়ের পাতায় ভর দিয়ে আরেকটু দূরে উঁকি দিতো, তাহলে দেখতে পেত আলেকজান্দারের অশ্ববাহিনী ছুটে যাচ্ছে ঝিলম নদীর অববাহিকায় পুরু রাজার হস্তিবাহিনীর দিকে।

সিঙ্গুলারিটি এক ব্রাহ্ম-মুহূর্ত। এক তুরীয় দশা। তবে যে কাউকে কৌতুহলী করে তুলবে এই মুহূর্তের ঠিক আগের দশাটি। সেটা সিঙ্গুলারিটি নয়। আমরা তার নাম দেই ‘সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ান’। এখানে স্থান ও কালের ক্রম তখনও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তবে সংকুচিত হতে হতে বিকৃতি ঘটেছে চূড়ান্ত। পর্যুদস্ত পড়েছে সকল বিন্যাস, যাবতীয় পরম্পরা। একটি বিন্দুতে পর্যবসিত হওয়ার আগমুহূর্তে আমাদের ছায়াপথ হয়ে উঠেছে স্থান-কালের এক তুমুল জগাখিচুড়ি, অসীম বিশৃঙ্খলা।

বুদ্ধির কাছে এ এক দুঃস্বপ্ন।

সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ান হলো জগতের সেই বিশেষ দশা, যেখানে কোনোকিছুই সরলরৈখিক নয়। যেখানে হত্যাকাণ্ডের আগেই হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে। ট্রেন ছেড়ে গেছে সেগুলো স্টেশনে ঢোকার আগে। সেখানে তাজমহল তৈরির ৭ বছর পর মৃত্যু হয়েছে মমতাজমহলের। সেখানে ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন টেগোরের ২ বছর আগে আর তিনি নোবেলজয়ী হিসেবেই গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখেছেন আর সেই ভূমিকাসহ পাণ্ডুলিপি নিয়ে টেগোর জাহাজে চেপে রওনা দিয়েছেন লন্ডনের উদ্দেশে, রোদেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে।

সেটা এমন এক ছায়াপথ, যেখানে সকল গ্রন্থ শুরু হয় ২৬ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে, এরপর থাকে ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠা, কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠাটি কোথায় থাকবে, কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আর গ্রন্থগুলো ছাপা হয় লেখা হওয়ারও আগে, আর ছাপা হওয়ার আগে শেষ হয়ে যায় সেগুলোর বাঁধাই।

এটি এমন এক ছায়াপথ, যেখানে ইতিবৃত্ত তছনছ হয়ে গেছে। সেখানে অ্যাথেন্সের প্রধান সংরক্ষণাগার ঘাঁটতে গিয়ে অ্যারিস্টোটলের মেটাফিজিক্স’ গ্রন্থের আবু রুশদকৃত আরবি অনুবাদতাফসির পেয়ে যান প্লেটো। সেখানে শেহেরজাদ তাঁর ৮৮৫তম রাত্রির গল্পটি শুরু করেন রাজা শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ের ১৯ বছর আগে। সেখানে রাজপুত্র হ্যামলেট তাঁর পিতৃব্যের বিরুদ্ধে তীব্র জীঘাংসা নিয়ে ঘুরতে থাকেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না, এই ঘৃণার উৎস কী, কেননা রাজা হ্যামলেট তখনও নিহত হননি।

সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ানের জগতে সবচেয়ে অর্থহীন হয়ে পড়ে আবহাওয়ার পূর্বভাস। কেননা এখানে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার বহু পরে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়, ঘূর্ণিঝড় এসে সবকিছু লন্ডভণ্ড করে দেওয়ার পর দেখাতে বলা হয় সতর্ক সংকেত, প্রথমে দশ নম্বর, এরপর সাত, তারপর চার, ছয় – এই ক্রমে, আর সবার শেষে দেখানো হয় দুই নম্বর দূরবর্তী হুশিয়ারি সংকেত।

বাইরে থেকে কেউ যদি পর্যবেক্ষণ করতে পারত, তাহলে এই ছায়াপথ একটি চূড়ান্ত সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছানোর আগমুহূর্তের একটি দাবা খেলা তাকে সবচেয়ে আনন্দ দিত। কেননা এখানে খেলাটি এমন বিশৃঙ্খল ক্রমে অগ্রসর হয় যে, তা থেকে ঘুটিগুলোর চালের নিয়ম প্রতিপন্ন করার কোনো যৌক্তিক পথ নেই। দাবার বোর্ডে কিস্তি মাতের মুহূর্ত থেকে যদি খেলা অগ্রসর হতো, আর তা যদি কেবলই সরলরৈখিকভাবে সময়ের উল্টোদিকে যেতো, তবু হয়ত যৌক্তিকভাবে ঘুটিগুলোর চাল প্রতিপন্ন করা অসম্ভব হতো না, এমনকি বোর্ডের বাইরে অলস বসে থাকা খেয়ে-ফেলা-ঘুটিগুলো মাঝে মাঝে উঠে এসে ব্যাখ্যাহীনভাবে বোর্ডে বসে পড়া সত্ত্বেও। কিন্তু সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ানের জগতে দাবা খেলা কোনো ক্রম মেনে চলে না। এ এক তুমুল জগাখিচুরি।

তবু আমি বলব, শেষবিচারে দৃষ্টিভঙ্গিটাই সব।

আপনি কিভাবে দেখছেন, তার ওপর নির্ভর করবে, সিঙ্গুলারিটি নাকি সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ানের জগৎ বেশি সহনীয়। আর সবচেয়ে মুশকিল ব্যাপার হলো, সিঙ্গুলারিটির জগৎ কখনও এমন নয় যে, তা বাধ্যতামূলকভাবে সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ানের পরে থাকবে। সেটা আগেও থাকতে পারে। এমনকি কালের ক্রমের যে কোনো পর্যায়ে হতে পারে সেটার অবস্থান। অর্থাৎ সিঙ্গুলারিটি বা সিঙ্গুলারিটি মাইনাস ওয়ান আমাদের ছায়াপথের ভবিষ্যত নাও হতে পারে। এটা হতে পারে আমাদের যে কোনো অতীত। আর শুধু এরকম এক ব্যাখ্যাহীন বিশৃঙ্খলাই হতে পারে জগতের বর্তমান দশার সত্যিকার যৌক্তিক ব্যাখ্যা।

আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি যদি এক যুক্তিশৃঙ্খলরহিত জগাখিচুরি হয়ে থাকে, তাহলে সেই নিয়তিই আমাদের বর্তমান জগতের সমস্ত বিশৃঙ্খলার যৌক্তিক কারণ। কেননা কার্য আর কারণ দাবার চালের মতোই পরস্পর বিনিময়যোগ্য। চিরকাল।