কোয়ান্টাম মহাকর্ষের পথে

বিজ্ঞানচিন্তায় এর আগে কৃষ্ণগহ্বরের ওপর বেশ কয়েকটা লেখার মধ্যে আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল ভিত্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এই তত্ত্বে মহাকর্ষ বলকে স্থান–কালের বক্রতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই বক্রতার মান নির্ণয় করা যায় বস্তু বা শক্তির অবস্থান দিয়ে। ছবি দিয়ে প্রকাশ করলে অনেকটা এ রকম দাঁড়াবে পরের পাতার প্রথম ছবির মত।

বিশেষায়িত গণিত ব্যবহার না করে সমীকরণ আকারে লিখলে আইনস্টাইনের সমীকরণকে এভাবে লেখার পর:

স্থানকালের বক্রতা = ধ্রুবক X শক্তির ঘনত্ব

সাধারণ জীবনে আমরা এই বক্রতাকে অনুভব করতে পারি না, কারণ এই ধ্রুবকের মান অত্যন্ত নগণ্য। এসআই একক ব্যবহার করলে এর মান 8πGN/c2 10-28, কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের কাছাকাছি শক্তির ঘনত্বের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। তাই এই বক্রতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যে সমস্যার দিকে আজ দৃষ্টি ফেরাব, তা এটা নয়।

সমস্যাটা হলো শক্তির ঘনত্ব জিনিসটাকে কীভাবে প্রকাশ করছি, তা নিয়ে। নিউটনীয় কাঠামোর মধ্যে বসে থাকলে ওপরের আইনস্টাইনের সমীকরণের কাঠামোতে কোনো সমস্যা নেই। গন্ডগোলটা বাধে যখন আমরা প্রকৃতির দিকে তাকাই। এক শ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা জেনে চলেছি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে মহাবিশ্ব কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। আর বলবিদ্যার কাঠামোটা অনেক বেশি গণিতনির্ভর—আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে কোয়ান্টামজগতের নিয়মগুলো অনুধাবন করতে চাওয়াটা একধরনের গোয়ার্তুমি ছাড়া আর কিছু না। সে জন্যই পদার্থবিজ্ঞানীরা এই জগত্টাকে গাণিতিক ভাষা ব্যবহার করেই প্রকাশ করেন। সুতরাং একটা প্রশ্ন খুব বেশি ওঠে, কোন গণিত এখানে ব্যবহার করতে হবে? উত্তরটা সহজ—রৈখিক বীজগণিত (Linear Algebra)। কিন্তু এভাবে বললে মনে হতে পারে, আমরা তো স্কুলেই বীজগণিত শেখাই—সেখানেই তাদের কোয়ান্টামজগতের নিয়মাবলি সেখালেই তো পারি। আসলে সমস্যাটা শুধু গণিতের ভাষায় নয়—এর সঙ্গে রয়েছে এই সংকেতগুলো কী অর্থ বহন করছে, তা বোঝানোর মধ্যেও। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম একটা স্বীকার্য হচ্ছে যে আমরা যে সিস্টেমকে বর্ণনা করতে চাচ্ছি তার যে ‘অবস্থা’ থাকতে পারে, তার প্রতিটিই একেকটি ভেক্টর। এখানে একটা ব্যাপার খোলাসা করা প্রয়োজন—ভেক্টর মানেই যে তার দিক লাগবে, তা কিন্তু নয়। গণিতবিদেরা ভেক্টরকে একটু অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। সেটার সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়— ভেক্টরদের যোগ করা যায় এবং তাদের সাধারণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে আবার যোগ করা যায়।

ধরা যাক, X ও Y<6 কে আমরা ভেক্টর হিসেবে দেখতে চাচ্ছি। সেটা তখনই সম্ভব হবে যদি যেকোনো সংখ্যা α ও β–এর জন্য আমরা Z = αX + βY পাই, যার ধর্ম ঠিক X ও Y–এর মতোই হবে। আমরা তাহলে দেখছি, এখানে দিক জাতীয় কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। একটা সহজ উদাহরণ দিই, আমরা জানি, যেকোনো রং আমরা নীল, সবুজ ও লাল রং মিলিয়ে তৈরি করতে পারি। অতএব, রঙের জগৎ হচ্ছে একটা ভেক্টরের জগৎ এবং একেকটি রং একেকটি ভেক্টর—এখানে আমরা যাকে দিক বলতে অভ্যস্ত তার কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না। কোয়ান্টামজগতে আরও একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো আমরা যা কিছু দেখি বা মাপি তার কারণে সিস্টেমের পরিবর্তন হতে পারে। নিউটনীয় কাঠামোতে এ ব্যাপারটা কখনোই ধর্তব্যের ভেতর আসে না। আর দেখতে গেলে আমাদের সিস্টেমের ওপর ‘কিছু একটা’ করতে হয়। এই ‘কিছু একটা’ সাধারণত আমরা আমাদের পরিমাপের যন্ত্রপাতি দিয়ে করি। যেমন, আমরা যদি একটা লাল ফুল দেখি তাহলে তার ওপর আমাদের আলো ফেলতে হবে। সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে প্রবেশ করলেই তখন ফুলটা দেখতে পাব। ছবিতে প্রকাশ করলে—

এখানে ফুলটি আলোর কণার অবস্থা (এই ক্ষেত্রে বেগের দিক) পরিবর্তন করছে। সমীকরণ আকারে আমরা লিখতে পারি—

আলো = (ফুল) আলো

এখানে তিরচিহ্ন দিয়ে আলোকে আমরা যে ভেক্টর হিসেবে গণ্য করছি, তা বোঝাতে চাইছি। জরুরি যে ব্যাপারটা, তা হচ্ছে যা দেখতে চাইছি তাকে একটা গাণিতিক সংকেত দিয়েই প্রকাশ করা হচ্ছে, যা একটা ভেক্টরকে অন্য একটি ভেক্টরে পরিবর্তন করে গণিতবিদেরা এ ধরনের জিনিসগুলোকে (যারা এক ভেক্টরকে একই বা অন্য ভেক্টরে রূপান্তরিত করে) অপারেটর বলে। তার মানের দাঁড়াল, যেকোনো পর্যবেক্ষণে আমরা ভেক্টরের ওপর অপারেটর প্রয়োগ করে আরেকটি ভেক্টর পাই যা কিছু আমরা পর্যবেক্ষণ করি তা তাহলে কোয়ান্টামজগতে একেকটি অপারেটর আকারে প্রকাশ করতে হবে। এর মানে আইনস্টাইন সমীকরণের ডান পাশে যে শক্তির ঘনত্ব রয়েছে, তা একটি অপারেটর হিসেবে প্রকাশ করতে হবে। এটা কোনো সমস্যা নয়—কারণ, কণা পদার্থবিজ্ঞানীরা যাঁরা কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা এটা লিখতে জানেন। সমস্যা হলো সমীকরণের বাঁ পাশ নিয়ে। কারণ, বক্রতা মাপতে গেলে আমাদের দূরত্ব জানতে হবে—সবকিছুকে অপারেটর হিসেবে প্রকাশ করতে হলে দূরত্বকেও অপারেটর হিসেবে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু দূরত্ব এবং চক্রতাকে কীভাবে অপারেটর আকারে প্রকাশ করতে হবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতৈক্য আসেনি। এর পাশাপাশি, আইনস্টাইন সমীকরণকে অপারেটর আকারে প্রকাশ করতে হলে আরও যে জিনিসটা খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো দুই পাশের অপারেটর যেন একই ভেক্টর সমাহারের ওপর কাজ করে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করাটা চাট্টিখানি কথা না।

অভয় আশতেকার (Abhoy Ashtahar) এবং তাঁর সহযোগীরা ১৯৯০ সাল থেকে দাবি করে আসছেন যে তাঁরা এ সমস্যার একটা সমাধান বের করেছেন। এটা সম্বন্ধে আমরা ভবিষ্যতের সংখ্যায় আলোকপাত করব। তবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ (Quantum Gravity) বাগে আনার একমাত্র প্রয়াস নয়, আমাদের চোখ–কান সব দিকের জন্যই খোলা রাখতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফিজিকেল সায়েন্সেস, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি