ফ্রাঙ্ক ড্রেক: ভিনগ্রহে প্রাণ-অনুসন্ধানের পথিকৃৎ

বিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম ড্রেক সমীকরণ। E=mc2 যেমন বিখ্যাত, ড্রেক সমীকরণ তেমন না হলেও বলা যায়, এর কাছাকাছিরকম বিখ্যাত। প্রায় সব জ্যোতির্বিজ্ঞান বইতে ভিনগ্রহের প্রাণী নিয়ে কথা হলেই ড্রেক সমীকরণ আসতে বাধ্য। বিখ্যাত এই সমীকরণের জনক ফ্রাঙ্ক ড্রেক গত ২ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন, ৯২ বছর বয়সে।

ফ্রাঙ্ক ড্রেকের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। তাঁর বাবা ছিলেন প্রকৌশলী, আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে কঠোর শাসনে মানুষ হন ড্রেক। কারণ, তাঁর বাবা-মা ছিলেন ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান। ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্ন তাঁর মাঝে প্রথম জন্ম নেয় ছোটবেলায়। যখন তাঁর বাবা তাঁকে প্রথম বলেন, আমাদের গ্রহই মহাবিশ্বে একমাত্র গ্রহ নয়। তাঁর এই চিন্তায় আরও আগুন জ্বলে ওঠে যখন তিনি প্রথম তাঁদের চার্চের পাশে অবস্থিত বিজ্ঞান ও শিল্প জাদুঘর দেখতে যান।

ড্রেক কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রকৌশল-পদার্থবিজ্ঞানের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর মার্কিন নৌবাহিনীর রিজার্ভ অফিসার’স ট্রেনিং কোরস (ROTC) প্রোগ্রামের অধীনে নৌবাহিনীর ক্রুজার ইউ এস এস অ্যালবানিতে তিন বছর কাজ করেন ইলেকট্রনিকস অফিসার হিসেবে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিলিয়া পেইন গ্যাপিস্কিনের (Cecilia Payne-Gaposchkin) অধীনে পিএইচডি সম্পন্ন করেন রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানে। জ্যোতিঃপদার্থবিদ সিসিলিয়া গ্যাপিস্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে বেশ বিখ্যাত। তিনিই প্রথম সঠিকভাবে প্রস্তাব করেন, সব নক্ষত্র আসলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। পিএইচডি সম্পন্ন করার পর গ্রিন ব্যাংকের ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনোমি অবজারভেটরিতে স্টাফ জ্যোতির্বিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন ড্রেক। এখানেই তাঁর সত্যিকার কাজ শুরু হয়।

আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার খোঁজের জন্য ড্রেক বিখ্যাত। কিন্তু এটা তাঁর মাত্র এক ধরনের কাজ। তাঁর আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ড্রেকই প্রথম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের রেডিও ম্যাপ (বেতার তরঙ্গে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের মানচিত্র) তৈরি করেন। যাঁরা প্রথম শুক্র গ্রহের আবহাওয়ার ঘনত্ব ও তাপমাত্রা পরিমাপ করেন, ড্রেক তাঁদের অন্যতম।

তিনটি কাজ তাঁকে সারাজীবন ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবে। সেগুলো হলো, প্রজেক্ট ওজমা (OZMA), অ্যারেসিবো বার্তা ও তাঁর হাতে তৈরি বিখ্যাত সেটি (SETI) ইন্সস্টিটিউট ও সেটি প্রকল্প।

ড্রেক প্রথম তার ভিনগ্রহের সভ্যতার খোঁজ শুরু করেন ১৯৬০ সালে। তিনি এর নাম দেন প্রজেক্ট ওজমা। গ্রিন ব্যাংকে অবস্থিত ৮৫ ফুটের ডিশ দিয়ে আমাদের মোটামুটি কাছের ও প্রায় সূর্যের মতো দুটো নক্ষত্র—টাও সেটি (Tau Ceti) ও এফসাইলন ইরিদানি (Epsilon Eridani) থেকে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর রেডিও সিগন্যাল পাওয়া যায় কি না, তা শনাক্তের চেষ্টা করেন। এর আগে মার্কনি ও নিকোলা টেসলা এমন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল শুধু মঙ্গলে কোনো প্রাণী থাকলে তাদের সিগন্যাল শনাক্ত করা। কিন্তু ড্রেকই প্রথম আন্তঃনাক্ষত্রিক কোনো সভ্যতার রেডিও সিগন্যাল শনাক্তের চেষ্টা করেন। প্রজেক্ট ওজমাতে হয়ত কোনো কিছু শনাক্ত করা যায়নি, কিন্তু তিনি এর মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন এক ধারার জন্ম দেন।

ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমি ও লোনোস্ফিয়ারের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ড্রেক। এই সেন্টারটির অধীনেই ছিল অ্যারেসিবো অবজারভেটরি পরিচালনার দায়িত্ব। অ্যারেসিবো মানমন্দিরকে চিনতে পারেননি?  তাহলে বলি, অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে এটি ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্গেল-অ্যাপারচার বেতার টেলিস্কোপ। কিছুদিন আগে এই বিখ্যাত মানমন্দিরটি ভেঙে পড়ে। ড্রেক এটার সংবেদনশীলতা আরও বাড়িয়ে দেন। তাঁর হাত ধরেই এটি পরিণত হয় সে কালের সবচেয়ে বড় বেতার টেলিস্কোপে।

ড্রেক তাঁর দায়িত্বে থাকা সবচেয়ে বড় এই টেলিস্কোপের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে এই টেলিস্কোপ থেকে একটি এনকোডেড (সংকেতবদ্ধ) বার্তা আমাদের থেকে ২২ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এম৩১ নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ছুড়ে দেন। এর ট্রান্সমিশন ছিল মাত্র তিন মিনিটের, আর এটি ছিল ১৬৭৯ হার্জের বার্তা। বার্তাটিতে ছিল ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স (দ্বিসূত্রক গঠন), মানুষের আকৃতি ও সৌরজগতে মানুষের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য। এই বার্তাটিকে বলা হয় অ্যারেসিবো বার্তা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল হয়তো কোনোভাবে কোথাও কেউ না কেউ বার্তাটি শনাক্ত করবে। মানমন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এই বার্তাটি আজও সম্ভবত মহাকাশের মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এ ধরনের বার্তা অবশ্য এটাই একমাত্র ছিল না। এর আগে ১৯৭২ সালে ড্রেক কার্ল সাগান ও তাঁর তৎকালীন স্ত্রী লিন্ডা সেলজম্যানের সঙ্গে পাইওনিয়ার প্ল্যাক ডিজাইন করেন। পাইওনিয়ার প্ল্যাক নাসার আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশযান পাইওনিয়ার ১০ ও ১১তে থাকা একটি প্লেট। এতে ছিল পুরুষ ও নারীদেহের চিত্র এবং পৃথিবীর অবস্থানের একটি মহাজাগতিক মানচিত্র। এটাই ছিল প্রথম মহাকাশে পাঠানো কোনো ফিজিক্যাল বা ভৌত বার্তা। অর্থাৎ এতে বার্তাটি বেতার বা কোনো তরঙ্গের মাধ্যমে নয়, একটি পাতে খোদাই করে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়াও তিনি ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ড প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ভয়েজার রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত অ্যান ড্রুয়ানের মতে, ফ্রাঙ্ক না থাকলে গোল্ডেন রেকর্ড হতো না। কারণ এটি ছিল তাঁর আইডিয়া—ফোনোগ্রাফিক রেকর্ডে করে বার্তা পাঠানো।

ড্রেকের সবচেয়ে বড় অবদান সেটি প্রকল্প ও ড্রেক সমীকরণ। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে একটি কনফারেন্সে ড্রেক তাঁর এই সেটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা দেন। সেই কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন কার্ল সাগানের মতো বিজ্ঞানী। বলে রাখি, ‘সেটি’র পূর্ণরূপ হলো সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স। পাশাপাশি ড্রেক সেবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে থাকা বুদ্ধিমান প্রাণীর সংখ্যা নির্ণয়ের একটি সমীকরণ দেন। এটাই বিখ্যাত ড্রেক সমীকরণ। তবে এটি সে অর্থে সমীকরণ না। বরং বলা চলে, দিকনির্দেশনা। এটি আমাদের বলে, ভিনগ্রহের প্রাণী শনাক্তের জন্য আমাদের কী কী জিনিস জানতে হবে। ড্রেকই প্রথম এ বিষয়ে এ ধরনের নির্দেশনা দেন। সেটি ইনস্টিটিউট আজও তাঁর সূত্রের চলকগুলোর মান বের করার চেষ্টা করছে।

ড্রেক সমীকরণটি হলো,

N = R* × fp   × × fe   fi × fc × L

এখানে,  N = প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সভ্যতার সংখ্যা

              R* = একটি ছায়াপথে বা গ্যালাক্সিতে তারার জন্মহার

              fp = তারাগুলোর মধ্যে যাদের গ্রহ আছে, তার শতকরা হার

               ne = ওসব গ্রহের মধ্যে যেগুলো প্রাণধারণের যোগ্য, তার শতকরা হার

           fe = প্রাণধারণ ও বসবাসযোগ্য অবস্থানে থাকা গ্রহগুলোর মাঝে যেগুলোতে সত্যি সত্যি প্রাণের অস্তিত্ব আছে, তাদের শতকরা হার

           fi = প্রাণের অস্তিত্ব থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে যেসব গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তাদের শতকরা হার

           fc = বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে যারা তাদের অস্তিত্ব জানানোর জন্য মহাকাশে বেতার তরঙ্গ পাঠাতে সক্ষম, তাদের হার

           L = যেসব বুদ্ধিমান প্রাণী মহাকাশে বেতার তরঙ্গ পাঠিয়েছে, তাদের সভ্যতার আয়ুষ্কাল

অর্থাৎ সমীকরণটিতে ৭টি চলক বা ভ্যারিয়েবল আছে। ড্রেকের এই সমীকরণ থেকে আমরা কোনো গ্যালাক্সিতে  কতগুলো বুদ্ধিমান সভ্যতা রয়েছে, তার একটা সম্ভাব্য মান জানতে পারি।

সেটি ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ সিথ সোস্টাক ড্রেক সমীকরণ সম্পর্কে বলেন, এই সমীকরণের বেশিরভাগ চলকই আমাদের অজানা। আপনি বলতে পারেন এটা অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ এই সমীকরণ আমাদের বলে, ভিনগ্রহের প্রাণীদের খোঁজের সময় অপ্রয়োজনীয় কোন জিনিসগুলো বাদ দিতে হবে।

তিনি মহাকাশে ভিনগ্রহের প্রাণীদের খোঁজার একটি বিশাল ক্ষেত্র গড়ে দিয়ে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আমরা কি কখনো অন্য গ্রহে বা গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ পাব?

তাঁর জবাব ছিল, ‘এটা কেবল শুরু। মানুষের ধারণা, আমরা পুরো আকাশকে সবসময় সব কম্পাঙ্কে পর্যবেক্ষণ করি। বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা যদি সঠিক দিকে সঠিক কম্পাঙ্কেও শোনার চেষ্টা করি, তবু আমরা যা খুঁজছি, তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। আমরা আসলে কিছু টিকিট নিয়ে অনেক বড় লটারি খেলতে বসেছি।’

এক বিরাট ও সফল জীবন অতিবাহিত করেছেন ফ্রাঙ্ক ড্রেক। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন আমাদের। এই দিকনির্দেশনা অনুসারেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধান করবে যুগে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

লেখক:

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, সেটি (SETI)