চন্দ্রগ্রহণ আর মঙ্গলের কাছে আসা

২০১৮ সালের জুলাই মাসকে বলা হয়েছিল আকাশপ্রেমীদের জন্য একটি উত্তেজনাকর মাস। প্রথমে আমরা দেখলাম শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ। এরপর পৃথিবীর এক পাশে সূর্য, অন্য পাশে মঙ্গল গ্রহ এসেছিল এক সরলরেখায়, যেটাকে বলা হয় মার্স অপজিশন (Mars opposition)। এটুকুই শেষ নয়। এর দুই দিন পরই ২০০৩ সালের পর মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে। এই ব্যাপারগুলো ঘটার জন্য আলাদাভাবে আমাদের বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এবার এক মাসেই দেখা গেল এমন সব দৃশ্য।

২৭ জুলাই ২০১৮, চন্দ্রগ্রহণ দিয়ে শুরু করা যাক। ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট দীর্ঘ ছিল এই পূর্ণগ্রহণ। আংশিক গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হিসাব করলে সময়টা ছিল প্রায় চার ঘণ্টা। চার ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক শো যখন চলছিল, তখন চাঁদকে দেখা যাচ্ছিল রক্তিম। যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ব্লাড মুন।

চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণ নিয়ে একটু বেশিই কুসংস্কার দেখা যায়। এ সময় সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে চোখে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলেই একে মানুষ ভয় পায়। কিন্তু চন্দ্রগ্রহণের ব্যাপারটা ভিন্ন। চাঁদের দিকে তাকালে স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি হয়। আর চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া যখন পূর্ণিমার চাঁদকে ঢেকে দিয়েছিল, এই স্নিগ্ধতা বেড়ে গিয়েছিল বহু গুণ। আর চাঁদ পুরো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার বদলে লালচে এক আভায় ছেয়ে গিয়েছিল। এর কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর ধার ঘেঁষে আলো যাওয়ার সময় সেটি চাঁদের দিকে বেঁকে যায়। এই আলোর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অংশ (যেমন নীল, সবুজ) বিক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে যায়। আমাদের চোখে এসে পড়ে বেশি কম্পাঙ্কের লালচে আলো। তাই আমরা চাঁদকে দেখতে পাই রক্তিম সৌন্দর্যে।

চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে, আর পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে বাধা পাওয়ায় অন্য পাশে ছায়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ণিমার রাতে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর প্রচ্ছায়ার (ছায়ার গাঢ়তম অংশ, যে অংশে আলোক উৎসের কোনো পাশ দিয়েই আলো যেতে পারছে না) ভেতর চলে এলেই আমরা চন্দ্রগ্রহণ দেখি।

চন্দ্রগ্রহণ কতক্ষণ ধরে হবে, তা নির্ভর করে চাঁদ প্রচ্ছায়ার কোন অংশ দিয়ে অতিক্রম করবে, তার ওপর। সূর্য আর পৃথিবী যে তলে অবস্থান করে, তার থেকে একটু হেলে থাকা একটি তলে অবস্থান চাঁদের। পৃথিবীর কোণক আকৃতির প্রচ্ছায়ার ঠিক মাঝখান দিয়ে গেলে প্রচ্ছায়ার মধ্যে অবস্থানকাল সবচেয়ে বেশি হয়। আর প্রচ্ছায়ার ধার ঘেঁষে চাঁদ গেলে চন্দ্রগ্রহণ হয় অল্প সময় ধরে। আরও একটি ব্যাপার হলো পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব। ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ অবস্থান করছিল সবচেয়ে দূরের বিন্দুতে। আর এ জন্য চাঁদকে লাগছিল আরও ছোট। এটি ছায়াকে অতিক্রম করতে সময় নিচ্ছিল বেশি, তাই চন্দ্রগ্রহণের ব্যাপ্তিকাল বেড়ে গিয়েছিল আরও একটু।

একটা পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হতে পারে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট। প্রচ্ছায়ার একদম মধ্যবিন্দু দিয়ে চাঁদ গেলে এমনটা হতে পারে। সর্বোচ্চ সময়ের মাত্র ৪ মিনিট কম সময় নিয়েছিল জুলাইয়ের এই গ্রহণ। আর ২০০০ সালে দেখা গিয়েছিল ১ ঘণ্টা ৪৬.৮ মিনিটের চন্দ্রগ্রহণ। সেটিই ছিল গত শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ।

যখন পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ছিল, তখন মঙ্গল গ্রহ ছিল চাঁদের পাশেই। আর মঙ্গল গ্রহ তখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছিল। কাছে থাকার ফলে মঙ্গল গ্রহের উজ্জ্বলতা প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে তখন। মঙ্গল আর পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে আলাদা কক্ষপথে। ঘোরার বেগও আলাদা। তাই গ্রহ দুটির একবার কাছাকাছি আসতে প্রায় দুই বছর লাগে। যখন সূর্য, পৃথিবী আর মঙ্গল একই সরলরেখায় আসে, তখন সেটাকে বলে মার্স অপজিশন। এবার সেটি ঘটে ২৭ জুলাই রাতে। অবশ্য এটি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই, কারণ পৃথিবীর এক পাশে সূর্য, আরেক পাশে মঙ্গল। আমরা শুধু মঙ্গলই দেখতে পেয়েছি সে সময়। তখন মঙ্গল আর পৃথিবীর দূরত্ব ছিল প্রায় ৫৭.৮ মিলিয়ন কিলোমিটার। এর তিন দিন পর ৩১ জুলাই মঙ্গল চলে এসেছিল ২০০৩-এর পর নিকটতম অবস্থানে। তখন এর উজ্জ্বলতাও চলে যায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সে সময় দূরত্ব কমে এসে পৌঁছায় ৫৭.৬ মিলিয়ন কিলোমিটারে। আর ২০০৩ সালে পৃথিবীর মাত্র ৫৫.৮ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে ছিল লাল গ্রহটি। মনে করিয়ে দিতে হয়, পৃথিবী থেকে মঙ্গলের গড় দূরত্ব ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। ৬০ হাজার বছর পর গ্রহ দুটিকে এত কাছে দেখা গিয়েছিল। এর পরেরবার এত কাছে আসতে অবশ্য হাজার বছর লাগবে না। এত কাছে দেখা যাবে ২২৮৭ সালের আগস্ট মাসেই।

২০১৮ সালের অপজিশন আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেবার অপজিশন ঘটছে মঙ্গলের কক্ষপথের এমন এক অবস্থানে, যেটি সূর্য থেকেও সবচেয়ে কাছের একটি জায়গা। এতে উজ্জ্বলতা বেড়ে যাচ্ছে আরও। আর অপজিশনের যে ব্যাপারটা আমরা দেখতে পাই, সেটা হলো ঠিক সূর্যাস্তের সময় মঙ্গল উদয় হয় এবং সূর্যোদয়ের সময় মঙ্গল অস্ত যায়। এর কারণ মঙ্গলের সূর্যের একদম বিপরীত পাশে অবস্থান।

জুলাই থেকে শুরু হয়েছে মঙ্গলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি। এখনো তা বেড়েই চলছে, কারণ ক্রমেই এটা কক্ষপথ ধরে এগিয়ে চলছে সূর্য থেকে সবচেয়ে নিকটতম জায়গায়। তবে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কথায় বিভ্রান্ত হয়ে লাভ নেই। মঙ্গল বড় হতে হতে চাঁদের কাছাকাছি আকার ধারণ করবে, সেটা ডাহা মিথ্যা। সবচেয়ে উজ্জ্বল অবস্থায়ও মঙ্গলের আকার দেখা যাবে চাঁদের ৭৫ ভাগের ১ ভাগ মাত্র!

লেখক: শিক্ষার্থী, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: স্পেস ডট কম