লোয়েল মানমন্দির ও প্লুটো আবিষ্কারের গল্প

বামন গ্রহ প্লুটো আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমেরিকার লোয়েল মানমন্দিরের। মানমন্দিরটি স্থাপিত হয় ১৮৯৪ সালে। বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লোয়েল অ্যারিজোনা শহরের ফ্ল্যাগস্টাফে মানমন্দিরটি স্থাপন করেন। মানমন্দিরটির নামকরণ করা হয় লোয়েলের নামেই। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মার্স পর্বতের ওপর অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২ হাজার ২১০ মিটার।

১৯৩০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ এই মানমন্দিরে বসে প্লুটো আবিষ্কার করেন। পর্যবেক্ষণের সময় তিনি ব্যবহার করেন ১৩ ইঞ্চি ব্যাসের একটি দুরবিন। প্লুটো আবিষ্কারের পেছনে নেপচুন গ্রহের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ প্রভাব ছিল। ১৮৪৬ সালে নেপচুন আবিষ্কৃত হয়। তারপর নেপচুনের চলার পথ হিসাব করে জ্যোতির্বিজ্ঞানী লোয়েল বলেন, আকাশের একটি নির্দিষ্ট স্থানে একসময় গ্রহটি দেখা যাবে। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি পর্ব, পৃথিবীর সব শক্তিশালী দুরবিন দিয়ে। কিন্তু গ্রহটিকে পাওয়া গেল না। অবশেষে নতুন গ্রহটিকে খুঁজে পাওয়া গেল সেই লোয়েল যেখানে বলেছিলেন, ঠিক সেখানেই। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, লোয়েল তখন আর বেঁচে নেই। লোয়েল মানমন্দিরের তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ ১৯৩০ সালে গ্রহটি আবিষ্কার করেন। পার্সিভাল লোয়েলের স্মরণে তাঁর নামের প্রথম অক্ষর পি এবং এল সংযোজন করে গ্রহটির নামকরণ করা হয় প্লুটো। ২০০৬ সালে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পড়ে প্লুটো। বর্তমানে এটিকে বামন গ্রহের (Dwarf Planets) তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

ক্লাইড টমবাউ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেন তাঁর চাচার ছোট্ট একটি দুরবিন দিয়ে। বড় হয়ে নিজেই একটি দুরবিন বানিয়ে ফেলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করা। কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে কৃষিকাজে লেগে গেলেন। পাশাপাশি রাতের বেলা চলতে থাকে আকাশ পর্যবেক্ষণ। একদিন তিনি মঙ্গল ও বৃহস্পতির অবস্থান দেখে দেখে ছবি এঁকে পাঠিয়ে দেন লোয়েল মানমন্দিরে। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মানমন্দিরে নিয়োগ পান। নিয়োগ পেয়ে মনের আনন্দে পর্যবেক্ষণ কাজে ডুবে গেলেন। লোয়েলের নির্দেশ মোতাবেক, আকাশের যে স্থানে গ্রহটি থাকার কথা, তিনি সেসব স্থানের ছবি নিলেন। অবশেষে ক্যামেরার প্লেটে ধরা পড়ল প্লুটো।

প্লুটো ছাড়াও ১৯১৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেস্টো মেলভিন স্লিফার এ মানমন্দিরে বসেই কুণ্ডলী পাকানো (স্পাইরাল) ছায়াপথের বর্ণালির আলোকচিত্র ও লোহিত সরণ নির্ণয় করেন। ১৯৭৭ সালে আবিষ্কৃত হয় ইউরেনাস গ্রহের বলয়।

গ্রহ হিসেবে প্লুটো বাদ পড়ার বেশ কিছু কারণ আছে। এগুলোর একটা, প্লুটোর কক্ষপথ অনিয়মিত এবং আকার ও আয়তন ব্যতিক্রম। তাই আবিষ্কারের প্রথম থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্লুটোকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন। প্লুটো সৌরজগতের অনেক উপগ্রহের চেয়ে ছোট। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্লুটোর কাছাকাছি যোগ্যতায় অনেক গ্রহাণু বা গ্রহাণুর মতো বস্তুর খোঁজ পাওয়া গেছে। সৌরজগতের একেবারে বাইরের দিকে অবস্থিত এসব গ্রহাণু নিয়ে কুইপার বেল্ট নামে স্বতন্ত্র একটি গ্রহাণু পরিবারের নামকরণ হয়েছে। তাই প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে মেনে নিলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা আরও অর্ধশতাধিক গ্রহের কথা ভাবতে হবে। এই ভেবে শেষ পর্যন্ত প্লুটো আবিষ্কারের সাত দশক পর গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বামন গ্রহের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা জানালেন প্লুটোইড (Plutoids) নামে পরিচিত হবে। এটা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত। তবে এ সিদ্ধন্তে বলা হয়েছে, সূর্য থেকে দূরত্বের হিসেবে নেপচুনের পর যেসব প্রায় গোলাকার বস্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সেগুলোকে এখন থেকে প্লুটোইড বলা হবে।

প্রাথমিকভাবে প্লুটোইড পরিবারে প্লুটো ছাড়াও থাকছে এরিস। এরিস বামন গ্রহের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও এ দুই বামন গ্রহের অনেক মিল আছে। মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহাণু সেরেসও এর অন্তর্ভুক্ত হবে, সেই সঙ্গে অন্য সব বামন গ্রহ। যেমন প্লুটোর বৃহত্তম উপগ্রহ চ্যারন, ম্যাকিম্যাকি ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে ২০০৬ সালে প্লুটো যখন গ্রহ খেতাব হারায়, তখন সাংবাদিকেরা ৯৩ বছর বয়স্ক প্লুটো আবিষ্কারকের স্ত্রীর অনুভূতি জানতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমি এখন এক বামন গ্রহ আবিষ্কারকের স্ত্রী।’ আর আমাদের কাছে প্লুটো শুধুই একটি স্মৃতিময় গ্রহ।

লেখক: শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও সংগঠক