কাঁকুড় আকৃতির গ্রহ!

মহাকাশের অন্য সব বিশাল আকারের বস্তুর মতো গ্রহের আকৃতিও গোলাকার বা গোলক আকৃতির। সৌরজগতের দিকে তাকালেই সেটি বুঝতে পারি আমরা। কিন্তু এর বাইরের অন্য তারকাজগতে থাকা গ্রহও কি গোলক আকৃতির? এত দিন সেটিই মনে করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি পাওয়া গেছে প্রোলেট বা রাগবি কিংবা কাঁকুড় আকৃতির গ্রহ।

ক্রমাগত ঘূর্ণন এবং মহাকর্ষের কারণে নির্দিষ্ট কক্ষকথে ঘূর্ণমান বস্তু সাধারণত গোলক আকৃতির হয়। গ্রহের বেলাতেও কথাটি খাটে। তবে সৌরজগতের বাইরে বিস্তৃত মহাকাশে গোলক আকৃতি ছাড়াও গ্রহের দেখা মেলে। বিজ্ঞানীরা যেটাকে উত্তপ্ত বৃহস্পতি (Hot Jupiter) বলেন। নক্ষত্রের খুব কাছের কক্ষপথ ধরে গ্রহগুলো আবর্তিত হয়। তাই এগুলোর তাপমাত্রা যেমন বেশি হয়, তেমনি আকৃতিতেও আসে পরিবর্তন।

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির একদল জোতির্বিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো এ রকমই একটি গ্রহের সন্ধান দিয়েছেন। যার আকৃতি কাঁকুড়ের মতো। ক্যারেক্টারাইজিং এক্সোপ্ল্যানেট স্যাটেলাইট বা CHEOPS টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ আলোকবর্ষ দূরের এই গ্রহের নাম দিয়েছেন WASP-103b। এ–সম্পর্কিত একটি গবেষণা গত ১১ জানুয়ারি অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

উত্তপ্ত বৃহস্পতি—নাম থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের গ্রহগুলো বৃহস্পতির মতো গ্যাসদানি। তবে বৃহস্পতির সঙ্গে অমিল হচ্ছে, এগুলো নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি কক্ষপথে থাকে। ১০ দিনের কম সময়ে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। আর এই কারণেই গ্রহগুলো উত্তপ্ত থাকে।

গঠনের বর্তমান মডেল অনুযায়ী, এ ধরনের উত্তপ্ত গ্রহের অস্তিত্ব বাস্তবে থাকার কথা নয়। গ্যাসীয় দৈত্যাকৃতির কোনো গ্রহ নক্ষত্রের এত কাছাকাছি তৈরি হতে পারে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডল গ্রহটি গ্যাসকে গ্রাস করে নেওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের গ্রহ মহাকাশে রয়েছে এবং এগুলোর সংখ্যা খুব কমও নয়। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় পাঁচ হাজার এক্সোপ্ল্যানেটের মধ্যে তিন শতাধিক উত্তপ্ত বৃহস্পতি ধরনের গ্রহ বলে ধারণা করা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শুরুতে গ্রহগুলো নক্ষত্র থেকে অনেক দূরেই গঠিত হয়। পরে ধীরে ধীরে কাছে চলে আসে।

বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, WASP-103b শুধু আকারেই প্রায় বৃহস্পতির মতো নয়, বরং গঠন এবং কাঠামোর দিক থেকেও এটি বৃহস্পতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সম্ভবত এটা বেশ কিছুটা কম ঘনত্বের। কারণ, ভর বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় ১.৫ গুণ বেশি হলেও এর আকার প্রায় দ্বিগুণ। হতে পারে যে নক্ষত্রের তাপে গ্রহটি ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে।

গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক, পর্তুগালের ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকস অ্যান্ড স্পেস সায়েন্সেস এবং পোর্তো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুসানা ব্যারোস বলেন, ‘যদি আমরা ভবিষ্যতের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে এর অভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি, তাহলে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব কেন এটা স্ফীত হচ্ছে। একই সঙ্গে এক্সোপ্ল্যানেটটির মূল গঠনটি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তা আরও ভালোভাবে জানা যাবে।’

এ ছাড়া গ্রহটি নিয়ে অন্য আরেকটি রহস্যেরও সমাধান প্রয়োজন। তাত্ত্বিকভাবে উত্তপ্ত বৃহস্পতি ধরনের গ্রহগুলোর কক্ষপথ ও আবর্তনকাল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসার কথা। কিন্তু পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, WASP-103b-এর ক্ষেত্রে আবর্তনকাল বাড়ছে।

এর কারণ কী হতে পারে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। হতে পারে অন্য কোনো বস্তু বা কক্ষপথকে এলোমেলো করে দিচ্ছে অথবা কক্ষপথটি আমাদের চেনাজানা কক্ষপথের চেয়ে একেবারে আলাদা। আবার এমনও হতে পারে, বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক হিসাবের মধ্যেই সামান্য কিছুটা ভুল রয়েছে, যেটা এখন বোঝা যাচ্ছে না। যা–ই হোক, সবকিছুর সঠিক উত্তর জানতে আরও অনেক পর্যবেক্ষণ ও সময় প্রয়োজন। গ্রহটি পর্যবেক্ষণের জন্য ভবিষ্যতে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্য নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস ও সায়েন্স অ্যালার্ট