চাঁদে মানুষ

সম্প্রতি চাঁদে অভিযান চালানোর ধুম পড়ে গেছে নতুন করে।

শুধু চাঁদই নয়, এখন মানুষের চোখ পৃথিবীর বাইরে কলোনি স্থাপনের দিকে। সে লক্ষ্যে মঙ্গলের পথে অনেকটাই এগিয়েছে মানুষ। মানুষের চন্দ্র বিজয়, বহির্জাগতিক মানব কলোনি, এর পেছনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আদ্যোপান্ত...

সে সময়টা আমাদের দেশের তরুণদের জন্য ছিল এক উত্তাল আন্দোলনের দিন। উনসত্তরের গণ–অভ্যুথানে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের পতন ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রদের সামনে তখন একটাই স্লোগান, বাংলা ও বাঙালির অধিকার চাই।

ঠিক সেই সময় ১৯৬৯ সালের ২৭ অক্টোবর মাত্র কয়েক ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসেন নীল আর্মস্ট্রংসহ তিন নভোচারী। তাঁরা সদ্য চাঁদে গিয়েছেন। নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নেমে হেঁটে এসেছেন। আমরা দল বেঁধে মূল সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানাই।

বাঁ থেকে নীল আর্মস্ট্র, মাইকেল কলিন্স ও বাজ অলড্রিন
ছবি: নাসা

কিছু সময়ের জন্য হলেও আমরা স্বপ্নের জগতে চলে যাই। আমরা তো তখন ভাবতেও পারতাম না, মানুষ কখনো চাঁদে যেতে পারে!

আজ ৫২ বছর আগের সে ঘটনার কথা মনে করছি। ভাবছি আরও ৫০ বছর পর কী হতে পারে? সেদিন কি চাঁদে মানুষ গড়ে তুলবে মহাশূন্য অভিযানের একটি স্টেশন? সে সম্ভাবনা কিন্তু এখন মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সক্রিয় বিবেচনায়।

এর আগে ১৯৬১ সালে যখন সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ করে আসেন, তখন থেকেই মানুষ ভাবছে চাঁদে যাওয়া যায় কি না। সেটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে আরও আট বছর পর। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন চাঁদে নামেন।

দুটি গলফ বল অপেক্ষা করছে

আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি চাঁদে এক চরকা বুড়ি সুতা কাটছে। রূপকথা। কিন্তু এখন বাস্তব সত্য হলো, সেখানে অপেক্ষা করছে দুটি গলফ বল। কবে সেখানে মানুষ যাবে। বসতি গড়বে। আর সবুজ ঘাস হবে। গলফ খেলবে। কী, বিশ্বাস হয় না? চাঁদের আঙিনায় এই গলফ বল দুটি রেখে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারী অ্যালান শেপার্ড। তিনি অ্যাপলো–১৪ মিশনে চাঁদে যান। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র মানুষ, যিনি চাঁদের মাটিতে ওই দুটি গলফ বল দিয়ে একটু খেলে, সেখানেই রেখে এসেছেন।

শেপার্ড অবশ্য সেদিন ভাবেননি পরে কোনো দিন মানুষ সেখানে গিয়ে তাঁর বল নিয়ে আবার খেলবেন। সে রকম কিছু যে হবেই, এখনো তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দেখা যাক কী হয়!

চাঁদের পথে মানুষ

৫০ বছর আগে তিনজন গিয়েছিলেন চাঁদে। তাঁদের মধ্যে দুজন চাঁদে পা রাখেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে আরও ১০ সেখানে যান। এরপর ওদিকে মানুষের যাতায়াত আর ছিল না। কিন্তু এখন আবার জোরেশোরে মানুষ চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা এখন তৎপর। শতকোটি ডলারের মালিকেরাও তৈরি। শুরু হয়ে যাচ্ছে যেন আরেক ভূরাজনৈতিক তৎপরতা। তবে এবার সেটা হবে অনেকটা বিজ্ঞানের জন্য। চাঁদে তৈরি হতে যাচ্ছে একটি স্টেশন। যেখানে পৃথিবী থেকে মানুষ যাবে। তারপর ওই স্টেশন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে রওনা হবে মহাকাশের কোনো নতুন ঠিকানায়। সে অর্থে চাঁদ হবে আমাদের মহাকাশ জয়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এই চমকপ্রদ বিষয়টি নিয়ে আইইইই–টেকনোলজি ইনসাইডার ম্যাগাজিনের ২০১৯ সালের জুলাই সংখ্যায় একটি চমৎকার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রজেক্ট মুন বেস নিবন্ধে এলিজা স্ট্রিকল্যান্ড ও গ্লেন জরপিট লিখেছেন, স্পেস স্টেশন দিয়ে তেমন কিছু হলো না। এখন সবাই ঝুঁকছে চাঁদের দিকে। সেখানে হবে ঘাঁটি। নাসা নেতৃত্ব দিচ্ছে। সঙ্গে আছে অন্য মহাকাশ সংস্থাগুলো। নাসা বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে মানুষ আবার ফিরে যাবে চাঁদে। এবার কিন্তু ভালোভাবেই যাবে।

এত অল্প সময়ে সম্ভব কি না, এ নিয়ে অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু নাসা ইতিমধ্যেই প্রচুর টাকা ঢেলেছে এই প্রজেক্টে। বিস্তারিত পরিকল্পনাও নিয়েছে। তবে এই খেলার মাঠে আরও খেলোয়াড় আছে। চীন এসে গেছে মাঠে। এই তো গত এপ্রিলে চীনের ন্যাশনাল স্পেস এজেন্সির পরিচালক জানিয়েছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

মঞ্চে রাশিয়ার প্রবেশ

অবশ্য চীনের আগেই রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে তারা ২০৩১ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। সেখানে একটি স্টেশন (মুন–বেস) নির্মাণের কাজ শুরু করবে ২০৩৪ সালে। ওদিকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান বলছেন, তাঁরা একটি নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। একটি ‘চান্দ্রগ্রাম’ (মুন ভিলেজ) তৈরি করা হবে। এটা হবে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা (ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট), যা চাঁদে বিজ্ঞান গবেষণা, ব্যবসা–বাণিজ্য ও পর্যটনে সহায়তা দেবে।

বাণিজ্যিক শিল্প

ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ব্যতিক্রমী শিল্পোদ্যম। মাহাকাশভিত্তিক বাণিজ্যিক শিল্প গড়ে উঠছে। ইলন মাস্কের কথা আমরা জানি। সৃজনশীল শিল্পোদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেটে এখন মহাকাশ ভ্রমণ খুব কম খরচে সম্ভব। আর কী চাই? চাঁদের উঁচু কক্ষপথে একটি ছোট মহাশূন্য স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা হবে চাঁদের প্রবেশদ্বার (গেটওয়ে)। চাঁদের পথে একটি বহুমাত্রিক স্টেশন। এখানে থাকবে যন্ত্রপাতির কক্ষ বা স্টোরহাউস, সংযোজন–সুবিধা এবং যারা চাঁদে যাওয়া–আসা করবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও গবেষণাগার।

মঙ্গল গ্রহের পথে

এ ধরনের গেটওয়ের প্রয়োজন আছে কি না? নাসা বলছে, হ্যাঁ, আছে। কারণ, এখন যেসব স্পেসশিপ রয়েছে, ওগুলো চাঁদের নিম্ন কক্ষপথে সরাসরি যেতে পারে না। তারা আরও বলছে, এ ধরনের গেটওয়ে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার পথে মহাকাশচারীদের জন্য দরকার। তারা মহাশূন্যের গভীরে প্রবেশের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। অবশ্য এ ধরনের যুক্তি নিয়ে বিতর্কও আছে। অনেকে মনে করেন, এর কোনো প্রয়োজন নেই। এটা হবে বাড়তি ব্যয় মাত্র।

মহাশূন্যে মানব অভিবাসী

তাহলে আগামী ৫০ বছর পর যখন আমরা চাঁদে মানুষের প্রথম পদার্পণের শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করব, তখন হয়তো একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে। মানুষ হয়তো মঙ্গল গ্রহে যাবে। সেখানে গড়ে উঠবে নতুন আবাস। আর সেটা যদি হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি আজ চাঁদে স্টেশন নির্মাণের সব চেষ্টা এক স্রোতোধারায় মিলিত হবে। বিগত যুগের ঠান্ডা লড়াই (কোল্ড ওয়ার) নয়, সেখানে স্থান করে নেবে বিশ্বের সব দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের সমবেত প্রচেষ্টা। শুরু হবে মানবসভ্যতার এক নতুন অধ্যায়।

আমরা সেই সোনালি দিনের অপেক্ষায় আছি।

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা