হকিং প্যারাডক্সের সমাধান

বিখ্যাত হকিং প্যারাডক্সের সম্ভাব্য সমাধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ‎সম্প্রতি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক জেভিয়ার ক্যালমেটের নেতৃত্বে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

১৭ মার্চ দ্য ফিজিকস লেটারস রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি, যেখানে তাঁরা তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন যে ব্ল্যাকহোলের ইনফরমেশন প্যারাডক্সের সমাধান।

মহাবিশ্বে তথ্যের বিনাশ নেই। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে এটি একটি। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গোলমাল শুরু হয় গত শতকের সত্তরের দশকে। যখন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্সের সূত্রপাত ঘটান। যেখানে বলা হয়, ব্ল্যাকহোল শুধু সবকিছু শোষণ করে, ব্যাপারটা এমন নয়। ব্ল্যাকহোল নিজেও একধরনের বিকিরণ নিঃসরণ করতে করতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বিকিরণকে হকিং রেডিয়েশন বলা হয়। ব্ল্যাকহোল যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে এর আকর্ষণে আটকা পড়া ইনফরমেশনের কী হবে? হকিংয়ের গবেষণা বলছিল, ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে তথ্যও ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, হকিং রেডিয়েশন সরাসরি কোনো তথ্য বহন করে না। এতেই শুরু হয় সমস্যা। তথ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অর্থ পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতির লঙ্ঘন। সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় এক জটিল ধাঁধা, যেটাকে বলা হয় ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স।

জেভিয়ার ক্যালমেটদের গবেষণায় উঠে এসেছে, ব্ল্যাকহোল আমাদের ভাবনার চেয়ে বেশি জটিল। এগুলোর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র নক্ষত্রের গঠন কীভাবে হয়েছিল, সে–সম্পর্কিত তথ্য ধারণ করে। কোনো পদার্থ একটি ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণে ভেঙে পড়ার সময় ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে তার অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে যায়। এটাকে কোয়ান্টাম হেয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

১৯৬০-এর দশকে পদার্থবিজ্ঞানী জন আর্চিবাল্ড হুইলার প্রথম ‘ব্ল্যাকহোলস হ্যাভ নো হেয়ার’ বা ‘ব্ল্যাকহোলের চুল নেই’ কথাটি বলেন। ব্ল্যাকহোলের মোট ভর, ঘূর্ণন ও চার্জের বাইরে পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই বলেই এই তত্ত্বের অবতারণা করেন হুইলার, যা নো হেয়ার উপপাদ্য হিসেবে পরিচিত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে কোয়ান্টাম হেয়ার তত্ত্বটির নামকরণ করা হয়।

যা–ই হোক, নতুন আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম হেয়ার তত্ত্বটি ব্ল্যাকহোল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি উপায় বাতলে দিচ্ছে। একই সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত অনেক সমস্যার সমাধানও দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম মেকানিকসকে কীভাবে এক করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করার জন্য ব্ল্যাকহোলকে নিখুঁত গবেষণাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অধ্যাপক ক্যালমেট বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন যে প্যারাডক্সটি সমাধানের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে, যার মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিকস ও সাধারণ আপেক্ষিকতাকে এক সুতায় বেঁধে ফেলা যাবে।

ইতালির বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষণাপত্রটির সহলেখক রবার্তো ক্যাসাদিও বলেন, ব্ল্যাকহোলগুলো জটিল বস্তু গ্রাস করে সুগঠিত হয়। আর কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাকহোলের ভেতর ও বাইরের মধ্যে কোনো পরম ব্যবধান নেই। চিরায়ত তত্ত্বে, ব্ল্যাকহোলের ঘটনাদিগন্ত নিখুঁত একমুখী ঝিল্লি হিসেবে কাজ করে। এটা কোনো কিছুকে ভেতর থেকে বের হতে বাধা দেয়। বাইরে থেকে নির্দিষ্ট ভরের সব ব্ল্যাকহোল দেখতে একই রকম। এটা হচ্ছে ক্ল্যাসিক্যাল নো হেয়ার উপপাদ্য। কোয়ান্টাম তত্ত্ব কাজ করে কণা লেভেলে। ব্ল্যাকহোল গঠিতই হয় কোয়ান্টাম কণাগুলোর সমন্বয়ে। এটা ব্ল্যাকহোলের বাহ্যিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। এটাই হলো কোয়ান্টাম হেয়ার তত্ত্বের সারকথা।

তবে এই নতুন উপপাদ্য এখনই ব্ল্যাকহোল বিতর্কের পুরোপুরি ইতি টানছে না। আরও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। অধ্যাপক ক্যালমেট বিশ্বাস করেন যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে আপেক্ষিকতা যুক্ত করার এবং দুটি তত্ত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সে ক্ষেত্রে এটি বিজ্ঞানীদের কাছে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত হবে। বহু গবেষণার পথকে আরও মসৃণ করে তুলবে। তবে নতুন এই গবেষণা ক্যালমেটের একার নয়। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির একদল পদার্থবিজ্ঞানী।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

সূত্র: ফিজিকস ডট ওআরজি, লাইভ সায়েন্স