মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা কিশোর উপন্যাস আছে। স্কুলের নাম পথচারী। প্লাস্টিক দিয়ে স্ক্রু-ড্রাইভার ঘুরিয়ে আস্ত একটা স্কুল বানিয়ে ফেলা হয় সে গল্পে। ইচ্ছেমতো চাইলে খুলে-টুলে ফেলা যায় পুরো স্কুলটা ভাগে ভাগে। আবার লাগিয়ে ফেলা যায় দরকার মতো। বদলে নেওয়া যায় যথেচ্ছভাবে।
এবারের বিশ্বকাপে ঠিক সেরকম একটা স্টেডিয়াম বানিয়েছে কাতার। গল্পে নয়, বাস্তবে। সেই স্টেডিয়ামে সত্যি সত্যি ফুটবল খেলা হবে। তাও বিশ্বকাপের ম্যাচ। বিশ্বকাপ শেষে, অর্থাৎ মাসখানেক পরে আবার খুলে ফেলা হবে পুরো স্টেডিয়াম! ওই জায়গায় পড়ে থাকবে মরুর ধু ধু বালু। বিশ্বাস হয়?
একটু পেছনে ফিরি। প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের দামামা বেজে ওঠে ১৯৩০ সালে। তারপর প্রায় ৮০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে বসেনি ফুটবলের এই মহাযজ্ঞ। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। ফুটবল খেলার জন্য খুব একটা পরিচিত নয় এ অঞ্চলের দেশগুলো। শুধু কাতারের ফুটবল লিগের কথাই যা একটু শোনা যায়। ইউরোপের ফুটবলাররা ক্যারিয়ারের শেষ সময়টায় কিছু টাকা উপার্জনের আশায় কাতারের এই লিগে খেলেন। এ অঞ্চলে ফুটবল বিশ্বকাপ না হওয়ার আরেকটা বড় কারণ আছে। প্রচণ্ড গরম। মরু অঞ্চল বলে কথা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘চরণ-তলে বিশাল মরু/দিগন্তে বিলীন।’
এই বিশ্বকাপের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি দেশে আরও জনপ্রিয় হবে ফুটবল।
কিন্তু নিজেদের দেশে একটা ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের খুব ইচ্ছে ছিল কাতার ফুটবল ফেডারেশনের। সেজন্য তারা জোর চেষ্টা চালিয়েছে দীর্ঘদিন। অবশেষে ফল মিলেছে ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সে দিন ফিফা ঘোষণা দেয়, ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে কাতার। ফিফার আশা, এই বিশ্বকাপের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি দেশে আরও জনপ্রিয় হবে ফুটবল।
দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোড়জোড় শুরু করে দেয় দেশটি। যে স্টেডিয়ামগুলো আছে, সেগুলো সংস্কার করা, নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করা—শুরু হয় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। শুধু স্টেডিয়াম বানালেই তো হবে না। প্রচণ্ড মরুগরমে যেন দর্শক ও খেলোয়াড়েরা কাবু না হন, নজর দিতে হবে সেদিকেও। ফলে স্টেডিয়ামগুলো বানানোর জন্য নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। যেসব স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, একটি বাদে তার সব কটিই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বলে ঘোষণা দেয় কাতার ফুটবল ফেডারেশন। সব স্টেডিয়ামেই অত্যাধুনিক নানান ব্যবস্থা রেখে ফুটবল বিশ্বকে একের পর এক চমক দিচ্ছিল দেশটি। কিন্তু আসল চমকটা আসে কাতার যখন বিশ্বকাপের সপ্তম ভেন্যু হিসেবে ঘোষণা করে ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’–এর নাম।
বেশ কয়েকটি কারণে স্টেডিয়াম ৯৭৪ এই বিশ্বকাপের অন্যতম জনপ্রিয় ভেন্যু ইতিমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে। একটি কারণ, এর অবস্থান। কাতারের রাজধানী দোহার ‘রাস আবু আবাউদ’ শহরে বানানো হয়েছে মাঠটি। পারস্য উপসাগরের তীরের এই মাঠে বিশ্বকাপের সময়ে থাকবে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। সেজন্য এটিই একমাত্র স্টেডিয়াম, যেটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। খেলোয়াড় থেকে দর্শক, সবাই সমুদ্র বাতাসে আয়েশ করে খেলা উপভোগ করতে পারবেন।
কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোডও ৯৭৪।
তবে প্রধান কারণ অবশ্যই এর ডিমাউন্টিবিলিটি। অর্থাৎ খেলা শেষে এটি পুরোপুরি খুলে ফেলা যাবে। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এরকম কোনো স্টেডিয়ামে খেলা হতে যাচ্ছে। আবার বিশ্বকাপ শেষে এই স্টেডিয়াম সরিয়ে ফেলে এ জায়গা অন্য যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে কাতার।
এই চমৎকার বৈশিষ্ট্যের পেছনে রয়েছে এর নির্মাণশৈলি। প্রথমে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়, এরকম স্টিল বা ইস্পাতের ফ্রেম বসানো হয়েছে সাড়ে চার লাখ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে। তারপর ইস্পাতের ফ্রেমের ফাঁকে ফাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শিপিং কনটেইনার। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই পুরো স্টেডিয়ামটি মূলত শিপিং কনটেইনার দিয়ে তৈরি। বিশাল সব কনটেইনারের ভেতরে দর্শকদের জন্য আসন বসানো হয়েছে, খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি করা হয়েছে ড্রেসিং রুম আর সাংবাদিকদের জন্য মিডিয়া জোন। এ ছাড়াও বাথরুম থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে কনটেইনারের ভেতরে। এসব কনটেইনার বহনযোগ্য। ব্যবহারের পর চাইলে খুলে ফেলা যাবে, সরিয়ে ফেলা যাবে প্রয়োজনীয় স্থানে। শুধু তা-ই নয়। চাইলে অন্য যেকোনো জায়গায় নিয়ে একইভাবে বানিয়ে ফেলা যাবে হুবহু এই স্টেডিয়ামটিই! এ রকম পোর্টেবল, অর্থাৎ বহনযোগ্য স্টেডিয়াম দেখা যায়নি আগের কোনো বিশ্বকাপে।
এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মাঠটির নাম। খানিকটা যান্ত্রিক ধরনের এই নাম কৌতূহল জাগিয়ে তোলে সবার মাঝে। কাতারের অনান্য স্টেডিয়ামের নামগুলোও বেশ রাশভারি। ‘আল জানৌব স্টেডিয়াম, আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম’—এরকম নাম। এসবের পাশে ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ নামটা বেশ বেমানানই শোনায়। আগেই যেমন বলেছি, এর পেছনে রয়েছে স্টেডিয়ামটির নির্মাণ প্রক্রিয়া। পুরো স্টেডিয়ামটা বানানো হয়েছে ৯৭৪টি শিপিং কনটেইনার দিয়ে! আরেকটা মজার বিষয় হলো, কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোডও ৯৭৪। এ দুটি বিষয় মাথায় রেখেই স্টেডিয়ামটির নামকরণ করা হয়েছে ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’।
কাতারের ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ আমাদের শোনাচ্ছে ভবিষ্যতের গান। ভবিষ্যতে হয়তো মাঠ নির্মাণে এত জায়গা আর ব্যয় করা হবে না।
স্টেডিয়ামটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে ব্যবহৃত সব স্টিল বা ইস্পাত রিসাইকেল করা। অর্থাৎ আগে ব্যবহৃত স্টিল থেকে পুনরুৎপাদন করা। অর্থাৎ, দারুণ পরিবেশবান্ধব! সেজন্যই এই স্টেডিয়ামটি গ্লোবাল সাস্টেইনিবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেমের (জিএসএএস) রিভিউতে পাঁচ তারকা পেয়েছে।
সব মিলিয়ে কাতারের ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ আমাদের শোনাচ্ছে ভবিষ্যতের গান। ভবিষ্যতে হয়তো মাঠ নির্মাণে এত জায়গা আর ব্যয় করা হবে না। হয়তো সব মাঠেই রিসাইকেল করা বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের দিকে জোর দেওয়া হবে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে যদি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যোগ হয়, তাহলে বিষয়টা আমাদের সবার জন্যই আশাজনক।
লেখক:
উচ্ছ্বাস তৌসিফ, সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সজিব-উজ-জামান, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়