ইলেকট্রনিক পাঠশালা-৬

পর্ব-৬: কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সের সার্কিট কীভাবে কাজ করে?

গত সংখ্যার পর

গত পর্বে কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সার্কিটের বর্ণনা দিয়েছিলাম। এ পর্বে এ সার্কিটের দুটি বিশেষ অংশ—জেনার ডায়োড ও ট্রানজিস্টরের কার্যকারণ আলোচনা করব। পাশাপাশি কীভাবে থার্মিস্টরের মধ্য দিয়ে কনস্ট্যান্ট কারেন্ট দিতে পারে, তা নিয়েও বলব। ছবি ১-এ আগের পর্বে আলোচিত সার্কিটটি আবারও তুলে ধরা হলো। সেখানে বলা হয়েছিল, জেনার ডায়োডটি ট্রানজিস্টরের গ বিন্দুর ভোল্টেজকে কনস্ট্যান্ট রাখে। কীভাবে সেটা হয়? ছবি ২-এ জেনার ডায়োডের চারিত্রিক গ্রাফ বা Characteristic Curve দেখানো হলো (লাল রেখা)। এর আনুভূমিক অক্ষটি ডায়োডের দুই প্রান্তের ভোল্টেজ V এবং উলম্ব অক্ষটি কারেন্ট I নির্দেশ করছে (কালো রেখা দুটি)। গ্রাফে দুটি অক্ষের সংযোগস্থলটিকে 0. 0 দিয়ে দেখানোর অর্থ হলো, এ বিন্দুতে ভোল্টেজ ও কারেন্ট দুটির মানই শূন্য। জেনার ডায়োডের দুই প্রান্তের ভোল্টেজের দিকের ওপর নির্ভর করে এর এক দিককে বলা হয় ফরোয়ার্ড বায়াস ও অপর দিককে বলা হয় রিভার্স বায়াস।

ফরোয়ার্ড বায়াসের ভোল্টেজ ও কারেন্টকে + চিহ্ন দিয়ে এবং রিভার্স বায়াসের ভোল্টেজ ও কারেন্টকে - চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়ে থাকে। ছবি ২-এ তা দেখানো হয়েছে। জেনার ডায়োডকে সব সময় রিভার্স বায়াস দিয়ে ব্যবহার করা হয়। ছবি ১-এর সার্কিটে জেনার ডায়োডটিকে ব্যাটারির পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রান্তের সাপেক্ষে যেভাবে সংযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে রিভার্স বায়াস সংযোগ। রিভার্স বায়াসে অল্প ভোল্টেজে কারেন্টের পরিমাণ খুবই কম থাকে। প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। সেটিই দেখানো হয়েছে ছবি ২-এ। তবে ভোল্টেজ বাড়াতে থাকলে একটি মানে (VZ বিন্দুতে) হঠাত্ কারেন্ট খুব বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু সেখানে ভোল্টেজ তেমন বাড়ে না, বলতে গেলে প্রায় একই থাকে। একে বলা হয় রিভার্স ব্রেকডাউন (Reverse breakdown) ভোল্টেজ। জেনার ডায়োডের জন্য একে জেনার ভোল্টেজও বলে।

ছবি ১: কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্স ও থার্মিস্টর

এ রিভার্স কারেন্টকে সীমিত না রাখলে ডায়োডটি অত্যধিক গরমে হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কারেন্টের মান খুব অল্প মানে (কয়েক মিলি-অ্যাম্পিয়ারে) সীমিত রাখতে পারলে ডায়োড নষ্ট হবে না। বরং এ ধর্মটিকে ব্যবহার করে ভোল্টেজকে একই মানে (VZ) ধরে রাখা যাবে। ছবি ১-এর ব্যাটারি ও জেনার ডায়োডের সার্কিট লুপে কারেন্টকে সীমিত রাখার কাজটি রেজিস্টর ১-এর মাধ্যমে করা হয়েছে। এখানে জেনার ডায়োডের ওপরের গ বিন্দুর ভোল্টেজ VZ মানে (গ্রাউন্ডের সাপেক্ষে) কনস্ট্যান্ট থাকবে।

এখানে একটি বাড়তি তথ্য দিয়ে রাখি। তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে জেনার ভোল্টেজের সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়। তবে যেসব জেনার ডায়োডের ভোল্টেজ ৫ ভোল্টের কাছাকাছি, সেগুলোতে এ পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। কেন এটি হয় পরে সুযোগ হলে আলোচনা করা যাবে। এ জন্য ৫ ভোল্টের কাছাকাছি জেনার ডায়োড ব্যবহার করে সার্কিট ডিজাইন করা ভালো। তবে বাজারে ৪.৭ এবং ৫.৬ ভোল্টের জেনার ডায়োড পাওয়া যাবে, ৫ ভোল্টের নয়। এ দুটোর যেকোনো একটি ব্যবহার করলেই চলবে। জেনে রাখা ভালো, একই মান লেখা জেনার ডায়োডের ভোল্টেজে শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত হেরফের পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া জেনার ডায়োডটি উল্টো করে লাগালে ফরোয়ার্ড বায়াস হয়ে যাবে, তখন ভোল্টেজ ০.৭ ভোল্ট হয়ে যাবে। কারণ ছবি ২-এ ফরোয়ার্ড বায়াসে যে VF দেখানো হয়েছে, এর পরিমাণ সাধারণত ০.৭ ভোল্ট হয়ে থাকে (সিলিকন দিয়ে তৈরি ডায়োডের জন্য)। এ জন্য সার্কিটে লাগানোর পর একটি মাল্টিমিটার দিয়ে ভোল্টেজটি মেপে নেওয়া উচিত। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরছি। ভোল্টেজকে V দিয়ে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু কারেন্টকে ও দিয়ে কেন নির্দেশ করা হয়েছে? এটি ঐতিহাসিকভাবে এসেছে Intensity of current কথাটির প্রথম অক্ষর থেকে।

এখন আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন, ছবি ১-এ গ বিন্দুর ভোল্টেজ কনস্ট্যান্ট রাখা গেল, কিন্তু তাতে থার্মিস্টরের কারেন্ট কীভাবে কনস্ট্যান্ট থাকবে? এ জন্য আমাদের ট্রানজিস্টরের চরিত্র জানতে হবে। ছবি ১-এর ট্রানজিস্টরটিকে বলা হয় এনপিএন (npn) ট্রানজিস্টর। ছবি ৩-এ এটির সাংকেতিক চিহ্নের সঙ্গে এর ৩টি প্রান্তের নাম যথাক্রমে, বেইজ (Base), এমিটার (Emitter) ও কালেক্টর (Collector) দেখানো হয়েছে। ছবিতে এমিটারের তিরচিহ্নের দিকটি খেয়াল করতে হবে। এটি উল্টিয়ে আঁকলে সেটি হবে পিএনপি (pnp) ট্রানজিস্টরের সাংকেতিক চিহ্ন। ট্রানজিস্টরের চরিত্র হলো বেইজ থেকে এমিটারের দিকে যে পরিমাণ কারেন্ট যাবে, কালেক্টর থেকে এমিটারের দিকে এর থেকে অনেক গুণ (কয়েক গুণ থেকে কয়েক শ গুণ) কারেন্ট যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কত গুণ হবে, সেটি ট্রানজিস্টর-ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এ গুণিতকের নাম হচ্ছে ট্রানজিস্টরের ফরোয়ার্ড কারেন্ট গেইন (Forward current gain)। এটিকে সাধারণত গ্রিক অক্ষর বিটা (β) নামে অভিহিত করা হয়। আর অপর যে চরিত্রটি এখানে কাজে লাগবে সেটি বেইজ-এমিটার অংশটির। এটি মূলত একটি ডায়োড, যাকে সার্কিটে সব সময় ফরোয়ার্ড বায়াস করে রাখা হয়। ছবি ১-এ তাই করা হয়েছে। ছবি ২-এ দেখানো জেনার ডায়োডের চারিত্রিক গ্রাফের ফরোয়ার্ড বায়াস অংশটি এর জন্যও প্রযোজ্য। কারেন্ট একটি ন্যূনতম মানের বেশি হলেই বেইজ-এমিটার ডায়োডের ভোল্টেজ VF মানে প্রায় কনস্ট্যান্ট হয়ে যায় (সিলিকন ট্রানজিস্টরের জন্য প্রায় ০.৭ ভোল্ট)।

ছবি ২: জেনার ডায়োডের চারিত্রিক গ্রাফ

এখন ছবি ১-এ ফিরে আসি। মনে করি, জেনার ডায়োডটির ভোল্টেজ হলো ৫.৬ ভোল্ট। তাহলে গ বিন্দুর ভোল্টেজ সব সময় ৫.৬ ভোল্টে স্থির থাকবে। যেহেতু বেইজ-এমিটারের ভোল্টেজও ০.৭ ভোল্টে স্থির থাকবে, তাই রেজিস্টর ২-এর ওপরের প্রান্ত, অর্থাত্ ঘ বিন্দুতে থাকবে এ দুটি ভোল্টেজের বিয়োগফল, অর্থাত্, ৪.৯ ভোল্ট (=৫.৬-০.৭)। অর্থাত্, ঘ বিন্দুর ভোল্টেজটিও কনস্ট্যান্ট থাকছে। হিসাবের সুবিধার জন্য এখন থেকে ঘ বিন্দুর এ ৪.৯ ভোল্টকে ৫ ভোল্ট বলব।

রেজিস্টর-২-এর মান মনে করি ১০০০ ওহম, বা ১ কিলোওহম (গ্রিক ভাষায় কিলো অর্থ হাজার)। তাহলে ওহমের সূত্র (I=V/R) অনুযায়ী রেজিস্টর ২-এর ভেতর দিয়ে কারেন্টের পরিমাণ হবে ৫ মিলিঅ্যাম্পিয়ার (=৫ ভোল্ট/১ কিলোওহম)। যেহেতু ঘ বিন্দুতে ভোল্টেজ কনস্ট্যান্ট থাকছে, তাই রেজিস্টর ২-এর ভেতর দিয়ে যাওয়া কারেন্টও সব সময় কনস্ট্যান্ট থাকবে। আর ট্রানজিস্টরের β-এর মান ১০০-এর বেশি হলে আমরা বলতে পারি, রেজিস্টর ২-এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫ মিলিঅ্যাম্প কারেন্টের প্রায় পুরোটিই আসছে ওপরের থার্মিস্টর হয়ে ট্রানজিস্টরের কালেক্টর-এমিটার পথে। বেইজ-এমিটারের কারেন্টের ১০০ ভাগের ১ ভাগেরও কম হওয়ায় এটিকে উপেক্ষা করা যায়। যেহেতু রেজিস্টর ২-এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কারেন্টের মান কনস্ট্যান্ট, অতএব থার্মিস্টরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কারেন্টের মানও কনস্ট্যান্ট থাকবে। থার্মিস্টরটি এ সার্কিটের লোড বা বোঝা। লোডটি থার্মিস্টর ছাড়া অন্য যেকোনো রেজিস্টর হলেও কারেন্ট একই থাকবে।

তবে ওপরের কাজগুলো ঠিকঠাক হওয়ার জন্য দুটি শর্ত আছে। শর্তগুলো হলো (ক) কালেক্টর-এমিটারের মধ্য দিয়ে এ পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহিত হওয়ার জন্য বেইজ-এমিটার সার্কিটে পর্যাপ্ত কারেন্ট থাকতে হবে (এ ক্ষেত্রে ৫ মিলিঅ্যাম্পের ১০০ ভাগের ১ ভাগ থেকে বেশি) এবং (খ) ব্যাটারির ভোল্টেজ যথেষ্ট বেশি হতে হবে, যেন লোডে যে থার্মিস্টর বা রেজিস্টর থাকবে তার ভেতর দিয়ে এ পরিমাণ (৫ মিলিঅ্যাম্প) কারেন্ট আসার সুযোগ থাকে। লোড রেজিস্টরের মান অনেক বেশি হয়ে গেলে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই ব্যাটারির কত ভোল্টেজে রেজিস্টরের ঊর্ধ্বসীমা কত হবে, তা হিসাব করে বের করে বলে দেওয়া উচিত। যেমন ছবি ১-এ ব্যাটারির ভোল্টেজ (ক বিন্দুতে) ১২ ভোল্ট এবং এমিটারের ভোল্টেজ (ঘ বিন্দুতে) ৫ ভোল্ট হলে থার্মিস্টর এবং ট্রানজিস্টরের কালেক্টর-এমিটারের মধ্যকার মোট ভোল্টেজ হতে পারবে বাকি ৭ ভোল্ট (ছবি ১-এ ক ও ঘ বিন্দুর মধ্যকার ভোল্টেজ)।

ছবি ৩: npn ট্রানজিস্টর

ট্রানজিস্টরের কালেক্টর-এমিটারের ভোল্টেজ খুবই কম রাখা যায় (প্রায় শূন্যের কাছাকাছি)। তাই বলতে পারি, ৭ ভোল্টের প্রায় পুরোটাই থার্মিস্টর পাবে। যেহেতু কারেন্টের পরিমাণ ৫ মিলিঅ্যাম্প তাই থার্মিস্টরের সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স কত হতে পারবে তা-ও ওহমের সূত্র থেকে বের করা যাবে।

সূত্রটিকে একটু ঘুরিয়ে লিখলে আসবে, R=V/I=৭ ভোল্ট/৫ মিলিঅ্যাম্প=১.৬ কিলোওহম। এটিই হবে থার্মিস্টর বা যেকোনো লোড রেজিস্টরের সর্বোচ্চ মান। এর বেশি হলে কারেন্ট আর কনস্ট্যান্ট থাকবে না। তবে এর থেকে বেশি লোড রেজিস্টর হলে কী করব? খুব সোজা, হয় রেজিস্টর ২-এর মান বাড়িয়ে কনস্ট্যান্ট কারেন্টের পরিমাণ কমিয়ে দেব, না হয় ব্যাটারির ভোল্টেজ বাড়িয়ে দেব। তবে কারেন্ট যত দূর সম্ভব কমিয়ে রাখা ভালো, কারণ এ কারেন্ট থার্মিস্টরকে গরম করে দেবে। যে বস্তুর তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে তার থেকে যদি থার্মিস্টরের নিজের তাপমাত্রা বেশি হয়ে যায়, তবে বোঝাই যাচ্ছে পরিমাপটি ঠিক হবে না।

আগামী পর্বে ডায়োড ও ট্রানজিস্টর কীভাবে কাজ করে, ভেতরের এসব তথ্য তুলে ধরে ইলেকট্রনিকসের আরও বিভিন্ন দিক ও প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।

লেখক: অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ১

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ২

ইলেকট্রনিক পাঠশালা- ৩

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ৪

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ৫