ন্যানোমেডিসিন

মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মানুষের তৈরি রোবট। চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহে রোবট পাঠাচ্ছে মানুষ। এবার বিজ্ঞানীরা রোবট পাঠাবে আপনার শরীরের ভেতর! কী বিশ্বাস হচ্ছে না? অবিশ্বাস্য এ ঘটনাই হয়তো কিছুদিন পর হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এখন যেভাবে ট্যাবলেট গিলে খাচ্ছি, ভবিষ্যতে হয়তো কোনো ক্যামেরা গিলে খেতে হবে। অথবা শরীরে ইনজেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে রোবট!

এসব রোবট হবে আকারে খুবই ছোট। ১০০ ন্যানোমিটারের মতো। ১ ন্যানোমিটার হলো ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ! এদের ন্যানোরোবট না বলে ন্যানোমেডিসিন বলাই ভালো। এরা সহজেই রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এরা সাধারণত গোলাকার হবে। গোলাকার পার্টিকেলের মধ্যে মেডিসিন ভরে দেওয়া থাকবে। এই ন্যানোমেডিসিন মানুষের দেহকোষ বা ব্যাকটেরিয়ার কোষের থেকে ছোট, কিন্তু এক অণু ওষুধ থেকে আকারে বড়। যেহেতু সাধারণ ওষুধ অণু থেকে বড়, তাই রক্তে এরা দীর্ঘক্ষণ কার্যকর থাকবে। আকার অণু থেকে বড় হলেও এরা রক্তনালিকায় জমাট বাঁধবে না। ন্যানোমেডিসিনের বাইরের অংশে অনেক সময় বিজ্ঞানীরা জৈব অণু যুক্ত করে দেন। এই অণুগুলোর কাজ হলো সঠিক জায়গায় মেডিসিনকে কাজ করতে সাহায্য করা। যেমন বাইরে যুক্ত এসব অণু টিউমার কোষকে চিনতে পারে। তাই ন্যানোমেডিসিন কোনো সুস্থ কোষকে আক্রান্ত না করে শুধু টিউমার কোষের বিরুদ্ধেই কাজ করতে পারবে। অনেক ন্যানোমেডিসিন আবার মেশিনের মতো কাজ করতে পারে। তারা কোষপ্রাচীরে গর্ত তৈরি করতে পারে।

টর্চের আলোয় ইনসুলিন!

হাতের ওপর টর্চ ধরলেন, আর টর্চের আলো হাতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ঢুকে গেল মেডিসিন। পুরো কাজটা হলো চোখের পলকে আর কোনো সুচের খোঁচা ছাড়াই! ইনজেকশন যাঁরা ভয় পান নিঃসন্দেহে এ রকম টর্চ তাঁদের খুবই প্রয়োজন। এমন জাদুকরি টর্চ কিন্তু আর কল্পবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ নেই। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ইনসুলিন গ্রহণের ক্ষেত্রে একে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তাঁরা গোলাকৃতি ন্যানোপার্টিকেল তৈরি করেছেন, সেগুলো ত্বকের ওপর রেখে অতিবেগুনি রশ্মি ফেললেই ইনসুলিন শরীরে প্রবেশ করবে। ডায়াবেটিস ছাড়াও ক্যানসার চিকিৎসায় ‘ন্যানোজেনারেটর’ নামে আরেক ধরনের অতি ক্ষুদ্র ওষুধ সরবরাহকারী পার্টিকেল গবেষকেরা তৈরি করেছেন। ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, বিশেষভাবে তৈরি এই ন্যানোজেনারেটর শুধু ক্যানসার কোষগুলোতেই উচ্চমাত্রায় ওষুধ সরবরাহ করে। তাই ক্যানসার কোষের আশপাশের সুস্থ কোষগুলোর কোনো ক্ষতি হয় না। ন্যানোমেডিসিনের কাজ শুধু ওষুধ সরবরাহতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর কস্টাস কস্টারেলস ন্যানো–আকৃতির সুই তৈরি করেছেন। সার্জারিতে এর বিশেষ ভূমিকা আছে। ছোট আকৃতির কোষে সিরিঞ্জ বা স্কালপেল দিয়ে কাজ করা যায় না। ন্যানোসুই সেসব জায়গায় সহজেই ঢুকে পড়ে আর কোষে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন আনে। যে কোষে সার্জারি করতে হবে তাকে চেনার জন্য সুচের আগায় নির্দিষ্ট কোনো পদার্থ যুক্ত থাকে। তাই আশপাশের কোষের ক্ষতি না করে শুধু টার্গেট কোষেই ন্যানোসুই সার্জারি করতে পারে।

‘কোয়ান্টাম ডটস’ নামের আরেক ধরনের ন্যানোপার্টিকেল রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। এর ভেতরের দিকটা ধাতব আর বাইরের দিকটা বিশেষ খোলসে আবৃত। এই বিশেষ ধরনের গঠনের জন্য শরীরে কোনো নির্দিষ্ট রোগ দেখলেই কোয়ান্টাম ডটস ফ্লুরোসেন্ট আলো নিঃসরণ করে। স্ক্যানারের সাহায্যে সেই আলোর উপস্থিতি দেখে কোনো রোগ আছে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।

যা দিয়ে তৈরি ন্যানোমেডিসিন

মোটা দাগে ন্যানোমেডিসিনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। হার্ড ন্যানোমেডিসিন ও সফট ন্যানোমেডিসিন। হার্ড ন্যানোমেডিসিন সাধারণত গ্রাফিন দিয়ে তৈরি করা হয়। গ্রাফিনকে খুব পাতলা শিটে পরিণত করা যায়। এই শিট দিয়ে ফাঁপা নল বা গোলকের মতো গঠন তৈরি করা যায়। হার্ড ন্যানোমেডিসিনে ধাতব পদার্থও থাকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ঝোঁক সফট ন্যানোমেডিসিনের দিকেই বেশি। দেহের ভেতর স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন জটিল জৈব পদার্থ তৈরি হয়, সফট ন্যানোমেডিসিন শারীরিক এই প্রক্রিয়ার দ্বারাই অণুপ্রাণিত হয়ে তৈরি। প্রোটিন, ফ্যাট বা ডিএনএর মতো জৈব অণু দিয়ে সফট ন্যানোমেডিসিনগুলো তৈরি। এদের প্রাকৃতিক ন্যানোমেশিনও বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ডিএনএ অণুর বিশেষ কদর আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। পছন্দমতো ক্ষারকের অণুক্রম সাজিয়ে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ডিএনএ তৈরি করা যায়। ডিএনএ অণুগুলো নিজেরা বিভিন্নভাবে ভাঁজ হয়ে ক্ষুদ্র ত্রিমাত্রিক আকার ধারণ করে। এভাবে বিজ্ঞানীরা পছন্দমতো আকার দিতে পারেন ডিএনএকে।

অরিগ্যামি শিল্পীরা যেমন কাগজকে ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে ফুল-পাখির মতো জটিল সব আকৃতি দিতে পারেন, বিজ্ঞানীরাও ল্যাবে ডিএনএকে এমনভাবে আকার দিতে পারেন। বিভিন্ন আকারের ডিএনএ দেহের বিভিন্ন জায়গায় ওষুধ পরিবহনের কাজ করে। কাজ শেষে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যায়। ডিএনএ অণুর মতো আর কোনো পদার্থ এত নির্ভুল আর স্বকীয়ভাবে কাজ করতে পারে না। ল্যাবে বেস অণুগুলো যেভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়, ডিএনএ শরীরের ভেতর ঠিক তেমনভাবেই ভাঁজ হয়ে যায়। বলা যেতে পারে, বিজ্ঞানীদের কাছে ডিএনএ–ই হলো সবচেয়ে বিশ্বস্ত অণু, এটা দেহের ভেতরেও বিজ্ঞানীদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে ঠিকমতো নিজের কাজ করতে পারে।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং চায়নিজ একাডেমি অব সাইন্সেসের গবেষকেরা ক্যানসার কোষ ধ্বংস করার জন্য ডিএনএ ন্যানোরোবট তৈরি করেছেন। মাত্র ৬০-৯০ ন্যানোমিটার আকারের ন্যানোবটগুলো তৈরি করা হয় চ্যাপ্টা আয়তাকার ডিএনএ শিট দিয়ে। ন্যানোবটের গায়ে থ্রোম্বিন নামের এনজাইম যুক্ত থাকে। ন্যানোবট টিউমার বা ক্যানসার কোষের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে থ্রোম্বিন কাজ করা শুরু করে। যে রক্তনালিকা ক্যানসার কোষকে রক্ত সরবরাহ করত, থ্রোম্বিন তার রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেয়, যাতে কোষে আর রক্ত যেতে না পারে। এতে কোষগুলো মারা যায়। কিন্তু ন্যানোবট সুস্থ কোষের মধ্যে কীভাবে চিনতে পারে ক্যানসার কোষকে? এখানে ন্যানোবটকে সাহায্য করে ডিএনএ অ্যাপ্টামার। ন্যানোবট যদি কোনো ক্যানসার কোষের কাছাকাছি চলে আসে তখন ডিএনএ অ্যাপ্টামারগুলো ক্যানসার কোষের নিউক্লিওলিনের সঙ্গে যুক্ত হয়। নিউক্লিওলিন একধরনের বিশেষ প্রোটিন, যা কেবল ক্যানসার কোষেই প্রকাশ পায়। সুস্থ কোষে এদের দেখা যায় না। ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে এ ধরনের ন্যানোবট ক্যানসার কোষের ওপর মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই কাজ শুরু করে দিতে পারে।

ভাইরাসকে প্রাকৃতিক ন্যানোমেশিন বলে মনে করা হয়। ভাইরাস শরীরের ভেতর ঢুকে মানুষের দেহকোষে গর্ত তৈরি করে নিজেদের ডিএনএ কোষের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এভাবেই ভাইরাস দেহে রোগ তৈরি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অক্ষতিকর ভাইরাসকে ন্যানোমেশিন হিসেবে ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে ভাইরাসের বাইরে এমন একটা কৃত্রিম আবরণ তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে এদের দেখতে শরীরের নিজস্ব কোষের মতো দেখায়। তাই আমাদের ইমিউন–ব্যবস্থা তাকে আর চিনতে পারে না।

দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীদের একটি দল ন্যানোব্যান্ডেজ নামের বিশেষ একধরনের ব্যান্ডেজ তৈরি করেছে, যা রোগীর মাংসপেশির সংকোচন-প্রসারণ বা ত্বকের অস্বাভাবিক অবস্থা বুঝতে পেরে ডাক্তারকে রোগীর জন্য সঠিক মেডিসিন বাছাইয়ে সাহায্য করে।

ন্যানোমেডিসিনের ভবিষ্যৎ

ডিএনএ ন্যানোমেডিসিন যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন চমক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন এই চমককে চমকপ্রদভাবে হাতে–কলমে কাজে লাগানোর চেষ্টায় ব্যস্ত গবেষকেরা। ন্যানোমেডিসিনকে নির্ভরযোগ্য ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। ধাতব পদার্থ ব্যবহার করতে হয় বলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো এটি সামান্য ক্ষতি করতে পারে। তবে সব প্রতিকূলতা পার করতে পারলে ন্যানোমেডিসিন আমাদের দিতে পারে স্মার্ট চিকিৎসাসেবা। রে ক্রুজওয়েলের মতো ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া আশাবাদীরা অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আগামী শতাব্দীতে এই ন্যানোবট নাকি মরণশীল মানুষকে দিতে পারবে অমরত্বের স্বাদ!

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: হেলথ ব্রেকথ্রুস এবং বিবিসি ফোকাস

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়