ফেসবুকে গণ্ডগোল

গত রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায় ফেসবুক। ফেসবুক মানে শুধু ফেসবুক না। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ ফেসবুকের সব প্রতিষ্ঠান। আসলে, ফেসবুকের পুরো সার্ভার-ই নেই হয়ে গিয়েছিল অন্তর্জাল থেকে। পৃথিবীজুড়ে সাড়ে তিনশ কোটির বেশি মানুষ আক্ষরিক অর্থেই থমকে গিয়েছিল। শুধু সাধারণ ব্যবহারকারীরা নয়, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এফ-কমার্স (ফেসবুক কমার্স) ব্যবসায়ীরা। ই-কমার্স ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গ্রাহকের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। ফেসবুকের নিজের-ই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা! কিন্তু কীভাবে হলো এমনটা?


সেজন্য আমাদের অল্প-স্বল্প টেকনিক্যাল কিছু জিনিস বুঝতে হবে। ব্রাউজারে আমরা যেটা লিখি, তার নাম ইউআরএল। যেমন, www.facebook.com একটি ইউআরএল। এর মধ্যে www হলো একটি সাবডোমেইন। এটা বর্তমানে আর জরুরি কিছু না। আগে এই সাবডোমেইন ব্যবহার করে বোঝানো হতো, সাইটটা অন্তর্জালের সঙ্গে যুক্ত। আর facebook.com এখানে ডোমেইন। মানে, ওয়েবসাইটের নাম। এই যে নাম আমরা ইংরেজিতে লিখি, কম্পিউটার তো আর ইংরেজি বোঝে না। সে বোঝে সংখ্যায়, ০ আর ১ এ। শূন্য-একের এই নামকে বলা হয় আইপি অ্যাড্রেস। কিন্তু আমাদের বোঝার সুবিধার্থে বা মনে রাখার সুবিধার্থে আমরা আইপি অ্যাড্রেসকে লিখি ডটেড ডেসিমেল সিস্টেমে। আইপি অ্যাড্রেস হয় ৩২ বিটে। এই ৩২ বিটের প্রতি ৮ বিট পরপর একটি করে ডট দেওয়া হয় এবং বাইনারি বিটগুলোকে ডেসিমেল করে ফেলা হয়। এটাই ডটেড ডেসিমেল। ৩২ বিটের একটা আইপি অ্যাড্রেস হয় এরকম­—01111111.00000000.00000000.0000000। এর ডটেড ডেসিমেল রূপ হলো 127.0.0.1। আমরা বলার সুবিধার্থে এই ডটেড ডেসিমেল রূপটিকেও আইপি অ্যাড্রেস-ই বলি।

আরও পড়ুন

ঘটনা হলো, কোন ডোমেইন নেম বা নাম বললে অন্তর্জালে কোন আইপি অ্যাড্রেসকে বোঝানো হবে, সেটা বোঝার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, এর নাম ডিএনএস বা ডোমেইন নেম সিস্টেম। বিষয়টা খানিকটা ফোনবুকের মতো। আপনি যেমন ফোনবুকে কারো নাম ধরে সার্চ করে কল দিলে কলটা তার নাম্বারে যায়, এখানেও তাই। ডিএনএস আপনার ব্রাউজারের তথ্যানুসারে, ডোমেইন নেম থেকে আপনাকে বলে দিবে যে সাইটটা আপনি খুঁজছেন, সেটা (মানে সেটার আইপি অ্যাড্রেস) কোথায় আছে। সোমবার রাতে (৪ অক্টোবর) হঠাৎ দেখা গেল, ফেসবুকের ডিএনএস কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। যেন গায়েব হয়ে গেছে অন্তর্জাল থেকে রাতারাতি!

কেউ কিন্তু ফেসবুক হ্যাক করেনি। তাহলে হয়েছে কী? এটা বোঝার জন্য আমাদের আরেকটু টেকনিক্যাল জিনিস বুঝতে হবে। বিষয়টা এমনিতে জটিল, আমরা তাই এক্ষেত্রে অতিসরলীকরণের আশ্রয় নেব। আমাদের ব্রাউজারে যখন ফেসবুকের নাম লিখে এন্টার চেপে দিই, তখন এই সিগন্যাল বা তথ্যটা যায় আমাদের সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে, যাদের থেকে আমরা ইন্টারনেট সার্ভিস নিই। তার রাউটারের মাধ্যমে এই তথ্যটা যায় অন্তর্জালের অন্য কোনো রাউটারে। এভাবে এক রাউটার থেকে আরেক রাউটার, সেখান থেকে আরেক রাউটার হয়ে হয়ে আমি যে আইপি অ্যাড্রেস বা সাইটটাকে খুঁজছি, তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কোন রাউটার থেকে সিগন্যাল কোন রাউটারে যাবে, সেটা ঠিক করে একটা স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম, রাউটিং টেবিলের নাম্বার ধরে। সহজে ভাবুন, আপনার কাছে একটা মানচিত্র আছে। সেখানে বলে দেওয়া আছে, কীভাবে আপনি লক্ষ্যে পৌঁছাবেন। কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় যেতে হবে। পথিমধ্যকার এই একেকটি জায়গা একেকটি রাউটার। আর মানচিত্রটা হলো বর্ডার গেটওয়ে প্রটোকল বা বিজিপি। এই বিজিপির মাধ্যমেই অন্তর্জালের একেকটি নোড, মানে মানচিত্রের একেকটি বিন্দু অন্যদের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

ধরুন, আপনার লক্ষ্য একটি রেস্তোরাঁ। এখন, হুট করেই যদি রেস্তোরাঁটি মানচিত্রে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে না পারে, গুগল ম্যাপসে তাকে না দেখা যায়, তাহলে আপনি কি ওটাকে খুঁজে পাবেন? ঠিক এটাই হয়েছিল ফেসবুকের। নিজের উপস্থিতি আর কাউকে জানাতে পারছিল না। ফলে কেউ আর তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না।

এক বিবৃতিতে ফেসবুক জানিয়েছে, একটি কনফিগারেশন বদলাতে গিয়ে এই সমস্যা হয়। রাউটিং ও বিজিপির সমস্যার জন্য হারিয়ে যায় ফেসবুক অন্তর্জাল থেকে। পাশাপাশি ফেসবুকের সার্ভারও ডাউন হয়ে যায়। ফেসবুকের অনেক কর্মী ছিলেন বাইরে। তাঁরা এ সময় অফিসে এসে ঢুকতেও পারেনি। দরজার সিকিউরিটি তাঁদের আইডি কার্ড শনাক্ত করতে পারছিল না।

অবশেষে ৬ ঘন্টা পর ফেসবুক ফিরে আসে। মার্ক জাকারবার্গ এক টুইটে এ নিয়ে ব্যবহারকারীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।