বাজিমাতের দশ প্রযুক্তি

গবেষকদের মত অদূর ভবিষ্যতে আমাদের প্রযুক্তির দক্ষতা এমন অবস্থায় চলে যাবে যে এখনকার দুনিয়ায় আমরা যে দেখি সামনের দুনিয়া, তার থেকে একদময় ভিন্ন হয়ে দেখা দেবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আসতে পারে এমন নাটকীয় পরিবর্তন। অবাক করা যেসব প্রযুক্তি খুব অল্প সময়ে, প্রত্যাশার চেয়েও কম সময়ে হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে, সেগুলোর এক তালিকা বানিয়েছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান। খুব অল্প দিনেই হয়তো বাজিমাত করবে, এমন ১০ প্রযুক্তি নিয়েই বানানো হয়েছে এই তালিকা। তালিকা করেছে যে স্টিয়ারিং গ্রুপ, তার নেতৃত্বে ছিলেন সায়েন্টিফিক আমেরিকানের এডিটর ইন চিফ ম্যারিয়েট ডাইক্রিশ্চিয়ানা। বাজিমাতের ১০ প্রযুক্তির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, জীবন-ঘনিষ্ঠ অনেকগুলো প্রযুক্তিই আছে। তালিকায় পাবেন পরিবেশ বাঁচাতে বায়োপ্লাস্টিক, স্মার্ট ওষুধ, যুগান্তকারী সার, ফুড প্যাকেজিং বা ডিএনএ স্টোরেজের মতো জৈব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। সামাজিক রোবট, টেলিপোর্টেশন, ক্যামেরায় বিপুল উন্নতি, ব্যাটারি এগুলোও আছে।

সামাজিক রোবট

আগের সংখ্যায় আমরা বাজিমাতের ১০ প্রযুক্তিতে আলোচনা করেছিলাম সামনে আসতে যাচ্ছে সামাজিক রোবট। কেমন হবে সামাজিক রোবট?

সামাজিক রোবট আমাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হলো সঙ্গ দেবে। যে জায়গাগুলোতে মানুষের সঙ্গ পেয়ে আমরা রিলাক্সড হতে পারি, সে জায়গাগুলোতেই সামাজিক রোবট সহায়তা করবে।

যেমন একটা রেস্টুরেন্টের কথা চিন্তা করুন। সন্ধ্যায় আপনি যাবেন প্রিয় মানুষকে নিয়ে ডিনারে। আপনি চাইবেন রেস্টুরেন্টের গেটে যাতে আপনাকে কেউ হাসিমুখে সম্ভাষণ জানায়। আপনার বুক করে রাখা টেবিলটা আন্তরিকতার সঙ্গে দেখিয়ে দেয়। ওয়েটার এসে আপনার কাছে হাসিমুখে জানতে চায়, কী লাগবে। কী মেনু নিলে ভালো হবে, সে ব্যাপারে আপনাকে সহায়তা করবে। তারপর খাবার আসবে। খাওয়া শেষে শুধু বিলটা ধরিয়ে দেবে না, বরং হাসিমুখে জানতে চাইবে, কেমন লেগেছে। তারপর শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দেবে। গেটের কাছে দাঁড়ানো কেউ আবারও আপনাকে বিদায় দেবে। এসব করলেই না আপনার ওই রেস্টুরেন্টকে মানবিক লাগবে। মনে হবে কী আন্তরিক আতিথেয়তা। আপনি আবারও ওই রেস্টুরেন্টে যেতে চাইবেন।

সামনে যে রোবটের দিন আসছে, তখন তো এসব উঠে যাবে। কিন্তু চিন্তা করেন, রোবটিক একটা সন্ধ্যা কি আপনি আগ্রহ নিয়ে কাটাতে চাইবেন?

ধরা যাক, আপনি গেলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলে গেল। আধো অন্ধকার রুমে দেখলেন, আপনারা ছাড়া এক কোনায় আরেক দম্পতি আছেন। একটা টেবিলে দেখলেন আপনার নাম লেখা কোনো একটা ডিসপ্লে দেখা যাচ্ছে। আপনি টেবিলে বসলেই দেখলেন, মেনু কী কী আছে, তা ভেসে উঠল। সঙ্গে রেটিং দেওয়া আছে। রেটিং দেখে সিলেক্ট করে ফেললেন, কোনটা খাবেন। কিছুক্ষণ পর একটা রোবটিক ট্রলি এল, যাতে খাবারগুলো সুন্দর করে সাজানো। আপনারা নিয়ে খেয়ে ফেললেন। এবার বের হওয়ার সময় আপনার কার্ডটা টেবিলের কোথাও সোয়াপ করলেন, বিল রাখা হয়ে গেল। ফেরার সময় দরজা খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বের হয়ে গেলেন।

দ্বিতীয় সিনারিওতে যে আমাদের ভালো লাগবে না, তা সবাই জানে। তাই একদিকে যেমন চলছে রোবটিকসের গবেষণা, অন্যদিকে চলছে রোবটকে কীভাবে সামাজিক বা মানবিক করা যায়, তার গবেষণাও। এই খাতে বড় বড় কোম্পানি বিপুল টাকা বিনিয়োগ করছে।

যেমন জাপানের সফটব্যাংক রোবটিকসের ৪৭ ইঞ্চি হিউম্যানয়েড রোবট পেপার (Pepper)। এই রোবট মানুষের চেহারা দেখে আনন্দ-দুঃখ বুঝতে পারে। বুকে আছে একটা টাচস্ক্রিন, মানুষের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করতে পারে। সফটব্যাংক প্রায় ১৫ হাজার পেপার বিক্রি করেছে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে, হোটেলের চেক ইনে, এয়ারপোর্টের সার্ভিস সেন্টারে, সেলসে এই রোবটগুলো কাজ করছে।

এমনই আরেক রোবট লুমো। এই রোবট একটা পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। গুগলের হোম বা আমাজনের ইকোর মতোই। কিন্তু লুমোকে আপনি নির্দেশ দিলেই পরিণত হবে স্কুটারে। আপনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাবে, লোকেশন বললেই। আপনার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করতে পারবে।

সামাজিক রোবটের আরেক বড় চাহিদা বৃদ্ধদের কাছে। বৃদ্ধদের একাকিত্ব কাটাতে, থেরাপিতে সহায়তা করতে বিভিন্ন রোবট বানানোর কাজ চলছে। অনেক ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সঙ্গ দিচ্ছে, এমন অনেক রোবটই এখন বাজারে আছে। যেমন আছে জাপানে তৈরি পারো নামে একটা রোবট। সিল মাছের মতো দেখতে এই রোবট শুধু সঙ্গই দেয় না, কাঁদতেও পারে! কুকুর বা বিড়ালসদৃশ এমন রোবটও আজকাল পাওয়া যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিগত রোবটের বিশাল একটা বাজার তৈরি হচ্ছে। অনেক বড় বড় কোম্পানি এই খাতে বিনিয়োগ করছে। আর মানুষও কিনতে শুরু করেছে। ইন্ডাস্ট্রি, অফিস বা বাসার কাজের বাইরে ব্যক্তিগত সহকারী বা সঙ্গ দেওয়ার জন্যও রোবট চলে আসছে ঘরে ঘরে। ২০১৮ সালে কনজ্যুমার রোবটের বাজার ছিল প্রায় ৬৫০ কোটি ডলারের। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে এই বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে হবে অন্তত ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। বছরে রোবট বিক্রি হবে সাড়ে ছয় কোটি এবং এই হার উঠতির দিকেই থাকবে। অর্থাৎ খুব বেশি দিন বাকি নেই, যখন আপনি সঙ্গে একটা রোবট নিয়ে ঘুরবেন!

ছোট্ট আলোকযন্ত্র

দিনে দিনে কম্পিউটার ছোট হচ্ছে। মুরস ল মেনে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের গতিও বাড়ছে। কিন্তু সমস্যা বাধাচ্ছে অপটিক্যাল ডিভাইসগুলো। একটা দামি ফোন কিনলেন, আপনি সবার আগে দেখছেন ফোনের ক্যামেরাটা কেমন। আধো অন্ধকারে কত সুন্দর ছবি তুলতে পারবে, সেলফি ক্যামেরা ভালো হবে কি না। গোল বাধছে এ জায়গাতেই। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে হলে যে বস্তুর ছবি তুলবেন, সে বস্তুর বিম্ব গঠন হতে হবে আপনার ক্যামেরার সেন্সরে। এ জন্য আলোকে পাঠানো হয় লেনক্সের মধ্য দিয়ে। ঠিক আপনার চশমাটার মতো। আপনার চশমা কাজ করে একোটা লেন্স হিসেবেই।

ঠিকঠাকমতো আলো আপনার ক্যামেরার সেন্সরে ফেলতে গেলে একটা বড় আকারের লেন্স চাই। কিন্তু বড় আকারের কাচের লেন্স দিতে গেলে আপনার মুঠোফোনটাও হবে ঢাউস আকারের। একবার চিন্তা করুন তো নাইকনের একটা লেটেস্ট মডেলের ক্যামেরার মতো কোয়ালিটি ছবি তোলার সুযোগ দিতে চাইলে আপনার আইফোনের শেষ মডেলের সেটটা কত বড় হবে!

এ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়? আলোর ধর্ম তো আর পাল্টে ফেলা যাবে না। লেন্স ছোট হলে ওই কোয়ালিটিও পাওয়া সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধানে প্রকৌশলীরা এর মধ্যে একটা সমাধান বের করে ফেলেছেন। তাঁরা প্রস্তাব করছেন মেটালেন্সের। খুব ক্ষুদ্র আকৃতিতেও কাজ করতে পারবে মেটালেন্স। মেটালেন্স ব্যবহার করেই হয়তো ক্ষুদ্র আকৃতির অপটিক্যাল ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব হবে।

মেটালেন্সে থাকে একটা সমতল তল। এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের (মাইক্রন) চেয়েও পাতলা এই সারফেসের ওপরে থাকবে বিভিন্ন ন্যানো সাইজের বস্তু। কোনোটা ন্যানো সাইজের সরু পিলার, কোনোটা ন্যানো সাইজের গর্ত। এই পিলার বা গর্তে যখন কোনো আলো পড়বে, তখন তাতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন আলো তার পোলারাইজেশন, তীব্রতা, ফেজ, দিক ইত্যাদি পরিবর্তন করে। গবেষকেরা ইতিমধ্যে নিখুঁতভাবে ন্যানো বস্তুগুলো পজিশন করতে পেরেছেন, যাতে আলোর এই পরিবর্তন খুব ভালোভাবে দেখা যায়।

মূল ব্যাপার হলো এই মেটালেন্স এতই পাতলা যে চাইলে কয়েকটা মেটালেন্স একটার ওপর আরেকটা দিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে আকারে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। এর মধ্যেই এমন কতগুলো সারফেস একটার ওপর একটা রেখে গবেষকেরা স্পেকট্রোফটোমিটার বা পোলারিমিটারের মতো আলোকযন্ত্র বানিয়ে দেখিয়েছেন।

লেন্সের জন্য খুব কঠিন বিষয় হলো এবেরেশন। লেন্সের বক্রতার জন্য সুষমভাবে আলো বিম্ব গঠন করে না। যেমন সাদা আলো একটা লেন্সের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন রঙের আলোর প্রতিসরাঙ্ক ভিন্ন হওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে বাঁকে। ফলাফল স্পষ্ট বিম্ব পাওয়া যায় না। একে বলে ক্রোম্যাটিক এবেরেশন। কাচ দিয়ে বানানো লেন্সে এই সমস্যার সমাধান করা হয় একাধিক লেন্স একসঙ্গে বুদ্ধি করে ব্যবহার করে।

মেটালেন্সের গবেষকেরা এই সমস্যার সমাধান করেছেন। ইতিমধ্যে দেখিয়েছেন, একটা মেটালেন্স দিয়েই তাঁরা আলোকে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফেলতে সক্ষম। শুধু যে ক্রোম্যাটিক এবেরেশনই সমাধান করেছেন তা নয়, কমা বা অ্যাস্টিগমাটিজম নামে যে অন্য এবেরেশন আছে, যে এবেরেশনের কারণে ছবি বিকৃত বা ঝাপসা হয়ে যায়। এই এবেরেশনের সমাধানও করতে সক্ষম হয়েছেন।

মেটালেন্স যে শুধু আকৃতিই ছোট করবে তা নয়, আলোকযন্ত্রগুলোর দামও কমিয়ে দেবে। কারণ, মেটালেন্স তৈরি করতে কাচের লেন্সের মতো আলাদা ব্যবস্থা দরকার হবে না। অন্য ইলেকট্রনিক চিপগুলো যে যন্ত্র দিয়ে বানানো হয়, সেগুলো দিয়েই বানানো যাবে। এই যন্ত্র সব চিপ নির্মাতার কাছে ইতিমধ্যেই আছে। তাই মেটালেন্স চালু হয়ে গেলে দেখা যাবে এক রুমেই ইলেকট্রনিক চিপ এবং অপটিক্যাল লেন্স তৈরি হবে।

কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ হচ্ছে না। কারণ, এখনো মেটালেন্স বানাতে প্রয়োজন হচ্ছে অনেক টাকা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই খরচ নিঃসন্দেহে কমে যাবে। আরেকটা সমস্যা হলো মেটালেন্স এখনো কাচের লেন্সের মতো কার্যকর নয়। এই লেন্স দিয়ে স্বাভাবিক আকারে হাই কোয়ালিটির ছবি এখনো তোলা সম্ভব নয়। সব রং এখনো এই লেন্স রেন্ডার করতে পারে না।

তারপরও সব গবেষক মনে করেন, কয়েক বছরের মধ্যেই মেটালেন্স বাজারে চলে আসবে। ক্যামেরা থেকে শুরু করে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্র, গবেষণাগারে ব্যবহৃত বিভিন্ন স্পেকট্রোমিটার, অপটিক্যাল ফাইবার ইত্যাদি চলে আসবে। মেটালেন্সের গুরুত্ব বুঝে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থা এই খাতের গবেষণায় টাকা দিচ্ছে। গুগল, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগ করেছে। মেটালেন্স নামে একটা স্টার্টআপ ঘোষণা দিয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তারা বাজারে আনবে মেটালেন্সের আলোকযন্ত্র।

অর্থাৎ সামনের দিনগুলোতে আরও চমৎকার কিন্তু খুব ছোট আকারের আলোকযন্ত্র পেতে যাচ্ছি আমরা। কনজিউমার লেভেলে এটা যতটা খুশির খবর, এর চেয়ে অনেক বেশি খুশির খবর হবে গবেষণাগারগুলোর জন্য। ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্সে গবেষণা করে এমন ল্যাবগুলোকে এখন স্পেকট্রোমিটার কিনতে হয় কোটি কোটি টাকা খরচ করে। ভালো মানের উন্নত গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় স্পেকট্রোমিটার আছে আমাদের দেশে, খুব অল্প কয়েকটিই আছে। তাই মেটালেন্স শুধু আমাদের প্রতিদিনের ক্যামেরার জন্যই সুখবর নয়, বিভিন্ন গবেষণা ও ব্যয়বহুল রোগ নির্ণয়ের সহজলভ্য করার ব্যাপারেও সুখবর।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান