লাই ডিটেক্টর

থ্রিলার মুভিতে আমরা প্রায়ই লাই ডিটেক্টর যন্ত্র ব্যবহৃত হতে দেখি। সম্ভবত প্রথম এই আইডিয়া ব্যবহৃত হয় ১৯২৬ সালে, হলিউডের সিনেমা অফিসার ৪৪৪-এ। এই ছবিতে দেখা যায়, বিশ্বখ্যাত ক্রিমিনোলজিস্ট ভলমার একজন মাস্টার মাইন্ড ক্রিমিনালের ওপর লাই মেশিন ব্যবহার করছেন সত্য উদ্ঘাটনের আশায়। সে সময় এটা একটা আনকোরা আশ্চর্য ব্যাপার ছিল বৈকি। মিথ্যা নির্ণয়ক যন্ত্র বা লাই ডিটেক্টরের ধারণা তার কিছুদিন আগেই বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে। তখনো হলিউডের দর্শকেরা জানেন না যে লাই ডিটেক্টর বা পলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এর কিছুদিন আগেই, ১৯২১ সালে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সাবিজ্ঞানের ছাত্র জন অগাস্টাস লারসন, যিনি পরে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি নেন, তিনিই আবিষ্কার করেন এই যন্ত্র। তবে উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভিত্তোরিও বেনুসি এবং বার্ট নামে দুজন বিজ্ঞানী প্রমাণ করেন যে মিথ্যা বলার সময় মানুষের শ্বাস–প্রশ্বাসের ধরন ও রক্তচাপের কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়। ১৯১৩ সালে মার্সটন নামের একজন বিজ্ঞানী প্রথম সন্দেহভাজন ক্রিমিনালদের ওপর সফলভাবে রক্তচাপের তারতম্য পর্যবেক্ষণ করে মিথ্যা ‘ধরা’র চেষ্টা চালান। এরই ধারাবাহিকতায় অবশেষে ১৯২১ সালে জন অগাস্টাস লারসন প্রায় ৪ হাজার ক্রিমিনালের ওপর স্ফিগমোগ্রাফ যন্ত্র ব্যবহার করেন তাদের হৃদ্‌স্পন্দন ও রক্তচাপের তারতম্য লক্ষ করে মিথ্যা নির্ণয়ের জন্য। আর এভাবেই লাই ডিটেক্টরের জন্ম।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মিথ্যা বলার সময় আমাদের কেবল হৃদস্পন্দন, শ্বাস–প্রশ্বাস বা রক্তচাপই নয়, বডি জেসচার বা বডি ল্যাংগুয়েজেরও পরিবর্তন হয়। মিথ্যা বলার সময় মানুষ বেশি সোজা হয়ে বসে, চোখের মণির আকৃতি পরিবর্তিত হয়, তারা চোখে চোখ রেখে কথা বলে কম, প্রায়ই ঠোঁট কামড়ায় বা চেপে ধরে। বারবার চোখের পাতা ফেলা এবং কম রিলাক্স পজিশনও মিথ্যাবাদীর লক্ষণ। পল এইকম্যান নামে এক বিজ্ঞানী এর ওপর ভিত্তি করে ফেসিয়াল অ্যাকশন কোডিং সিস্টেম (FACS) নামে একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন এবং দাবি করেন যে এ পদ্ধতি প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যকর। পরে কথা বলার ভঙ্গি, বাক্য চয়ন ও লিখিত বয়ান নিয়েও নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়। এই লিস্টের সর্বশেষ সংযোজন হলো আসামির কগনিটিভ ইন্টারভিউয়ের কম্পিউটার অ্যানালাইসিস। এ ছাড়া একেবারে আধুনিক পদ্ধতি হলো ফাংশনাল ট্রান্সক্রেনিয়াল ডপলার টেকনিক। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন এলাকায় রক্ত প্রবাহের গতি নির্ণয় করতে পারে। দেখা গেছে যে সত্য বলার সময় মস্তিষ্কের একদিকে রক্ত প্রবাহের রেসপন্স পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু মিথ্যা উত্তর দেওয়ার সময় দ্বিমুখী রেসপন্স দেখা যায়। বলা হচ্ছে এটি প্রায় নিখুঁত ফলাফল দিতে সক্ষম। যদিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এই কগনিটিভ পলিগ্রাফির ব্যবহার এখনো শুরু করেননি।

আগেই বলা হয়েছে যে মিথ্যা নির্ণয় করতে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার নাম পলিগ্রাফ। এই যন্ত্র বক্তার হৃদ্‌স্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস–প্রশ্বাসের হার, মাংসপেশির নড়াচড়া ও শিরা-উপশিরার সংকোচন–প্রসারণ নির্ণয় করতে থাকে। বক্তার হাতে একটি রক্তচাপ মাপার যন্ত্র লাগানো হয়, বুকে লাগানো হয় নিউমোগ্রাফ আর হাতের আঙুলে লাগানো থাকে ইলেকট্রোড। এরপর একজন বিশেষজ্ঞ তাঁকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন। প্রশ্নগুলো হয় নিয়ন্ত্রিত বা কন্ট্রোলড প্রশ্ন। অবশ্য এই পলিগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা যথাযথ ও সম্পূর্ণ সঠিক না–ও হতে পারে বলে এর ফলাফল সাধারণত আদালত গ্রহণ করে না। কেননা শারীরবৃত্তীয় এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন নানা কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যেমন ভয়, আতঙ্ক, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ক্রোধ ইত্যাদি আবেগ পাল্টে দিতে পারে ফলাফল। কেউ উদ্বেগ কমানোর ওষুধ বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে প্রতিক্রিয়া কম দেখাতে পারে। খুব চতুর ও বডি ফিট বা অ্যাথলেটদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হওয়া বিচিত্র নয়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত রুশ গুপ্তচর অ্যালড্রিচ অ্যামসের উদাহরণ টানা যায়। সিআইএতে লুকিয়ে থাকা এই স্পাই দু–দুবার পলিগ্রাফ যন্ত্রকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে কীভাবে তিনি এ কাজ করতে পারলেন, সে প্রশ্নের উত্তরে এই অতি ধূর্ত প্রশিক্ষিত গুপ্তচর কেবল হেসে বলেছিলেন, ‘এতে কোনো ম্যাজিক নেই। যা দরকার, তা হলো আত্মবিশ্বাস। তার সঙ্গে চাই পরীক্ষক বা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সঙ্গে একটা বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে তোলা, আর তারপর আপনি তাঁকে যা বোঝাবেন, তিনি তা–ই বিশ্বাস করবেন!’

তাই আদালতে এই যান্ত্রিক ফলাফলের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু অনেক উন্নত দেশের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স, কাস্টম অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনের মতো সংস্থা হরদম এই যন্ত্র ব্যবহার করে চলেছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতে ২০০৮ সালে একজন নারীকে খুনের কথা স্বীকার করাতে ব্রেন ইলেকট্রিক্যাল অসিলেশন প্রোফাইলিং টেস্ট ব্যবহার করা হয়। পরে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিতর্কের মুখে ২০১০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সন্দেহভাজন আসামির ওপর নারকোঅ্যানালাইসিস, ড্রাগ বা ওষুধের ব্যবহার ও পলিগ্রাফি অবৈধ ঘোষণা করে।

মিথ্যা ধরার আরও নানা পদ্ধতি নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা চলছে। যেমন ভয়েস স্ট্রেস অ্যানালাইসিস, আই ট্র্যাকিং, ফাংশনাল এমআরআই, ইইজি, ইনফ্রারেড স্প্রেকটোস্কপি ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে ট্রুথ সিরাম বা সত্য বলার ওষুধ। এতে সোডিয়াম থায়োপেন্টাল ব্যবহার করে অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে দিয়ে সত্য বলানো হয়। ইতিহাসে ক্যানাবিস এবং ইথানল ব্যবহার করে সত্য বের করার কথাও শোনা যায়। তবে এ ধরনের ওষুধ প্রয়োগের ফলে সত্য-কল্পনা-ফ্যান্টাসি মিলেমিশে কথা বলে চলার ঝুঁকি রয়ে যায়।

মিথ্যা ধরার যন্ত্র বা লাই ডিটেক্টরের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক, গবেষণা, বাদ–প্রতিবাদ হয়েই চলেছে। প্রকাশ্যে একে চ্যালেঞ্জ করে দেখানো হয়েছে নানা টিভি শো। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল মিথবাস্টার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে কেন এলডার লাই ডিটেক্টর: দ্য হিস্ট্রি অব অ্যান আমেরিকান অবসেশন নামে একটি বই লেখেন, যা বেস্ট সেলার হয়ে ওঠে।

লেখক: চিকিৎসক, গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা