হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপ – মাইক্রোসকপির নতুন দিগন্ত

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের যুগান্তকারী আবিস্কার এবং এর অভূতপূর্ব সাফল্যের পর থেকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্বভাবতই একটি ধারণা জন্মালো যে ইলেকট্রনের পরিবর্তে যদি আয়ন ব্যবহার করা হয়, তাহলে মাইক্রোস্কোপের অপটিক্যাল রেজুলেশন আরও বিবর্ধিত করা সম্ভব। কারণ আয়নের ভর ইলেকট্রনের ভরের তুলনায় বেশি হবার ফলে আয়নের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম হবে। ডি ব্রগলির কণা-তরঙ্গ দ্বৈতবাদ অনুসারে, কণা ও তরঙ্গ অভিন্ন। প্রতিটি কণা তরঙ্গের মতো আচরণ করবে এবং প্রতিটি তরঙ্গ কণার মতো আচরণ করবে। অর্থাৎ, এই তত্ত্ব অনুসারে, কোনো তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের একই সঙ্গে তরঙ্গ ও কণার অনুরূপ আচরণ করার প্রবণতা থাকবে এবং কোনো একটি কণার একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গের অনুরূপ আচরণ করার প্রবণতা থাকবে। তরঙ্গ-কণা দ্বৈতরূপের ধারণাটি সম্পূর্ণভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধারণা। এটি একটি মাইক্রোস্কপিক কণার আচরণকে পুরোপুরি বর্ণনা করার জন্য সনাতন বলবিদ্যার শুধু ‘কণা’ বা ‘তরঙ্গ’ এর ধারণার অক্ষমতাকে প্রকাশ করে। লুই ডি-ব্রগলি তাঁর সমীকরণের সাহায্যে কণা ও তরঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। এই সমীকরণ অনুযায়ী, কোনো একটি কণার ভরবেগ যদি p হয়, এবং তার সাথে সম্পৃক্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি λ হয়, তাহলে λ = h/p, যেখানে h হচ্ছে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। এখন, যেহেতু p = mv, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে কণাটির ভর বেশি হলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হবে। সুতরাং, ইলেক্ট্রনের তুলনায় আয়নের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হবে।

এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারা যায়, আয়নরশ্মিকে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রতর পরিসরে আবদ্ধ করা যাবে। অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর আকারের বস্তুর ওপর আয়নরশ্মিকে আপতিত করা সম্ভব, ফলে অনেক সূক্ষ্মবস্তুর প্রতিবিম্ব বা image গঠন করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রনের সাপেক্ষে একটি আয়ন বস্তুর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেশি পরিমাণে সংঘর্ষ ঘটাতে সক্ষম। ফলে সেকেন্ডারি ইলেকট্রন বেশি তৈরি হয়। এর ফলে অনেক দ্রুত প্রতিবিম্ব গঠন করা সম্ভব। আয়নের এই সুবিধাগুলি মাথায় রেখে প্রথম বাণিজ্যিক সাফল্য এসেছিল তরল ধাতুর আয়ন উৎস নির্মাণে। কিন্ত এর প্রয়োগে কয়েকটি অসুবিধা দেখা যায়। যেমন Sputtering; যা দিয়ে বস্তুর উপরিতল কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। Sputtering হচ্ছে খানিকটা এরকম।

যদি কোনো বস্তুর উপরিতলে একটি গতিপ্রাপ্ত আয়নরশ্মি আপতিত হয়, সেই আয়নগুচ্ছ বস্তুটির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার পথে বস্তুটির অসংখ্য পরমাণুকে ধাক্কা দিতে থাকবে। এই ধাক্কা খাওয়া পরমাণুগুলি নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে বস্তুটির মধ্যে অগণিত পরমাণুকে গতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসে। বস্তুর ভেতরে একটা জায়গাজুড়ে এই গতিশীল পরমাণুদের সংঘর্ষ চলতেই থাকে, যতক্ষণ না সমস্ত পরমাণুগুলো শক্তিক্ষয় হতে হতে একেবারে থেমে না যায়। (একটা কথা মনে রাখতে হবে যে বস্তুর ভেতরের ল্যাটিসের একটা নিজস্ব কম্পন আছে, যার শক্তিও বিচ্ছিন্ন বা কোয়ান্টাইডজ। এই শক্তির কোয়ান্টামগুলোকে বলা হয় ফোনন।) গতিশীল পরমাণুগুচ্ছের একটি অংশ যদি বস্তুটির ভেতর থেকে উপরের দিকে ধাবিত হয়ে পরিশেষে বস্তুর উপরিতল থেকে কয়েকটি পরমাণুকে ছিটকে বাইরে বার দিতে পারে, সেই প্রক্রিয়াকেই আমরা বলবো Sputtering। আর তাতে কণাগুলি ছিটকে বেরিয়ে এলে তাদের বলা হয় sputtered particles। স্বভাবতই এই sputtered-এর ফলে বস্তুর উপরিতলের কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হবে।

তরল ধাতুর আয়ন উৎস থেকে নির্গত আয়ন রশ্মি ব্যবহারের এই অসুবিধা প্রথম দূর হলো হিলিয়াম আয়ণ ব্যবহার করে। হিলিয়াম আয়ন দিয়ে কোনো বস্তুর Sputtering হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এছাড়া হিলিয়াম আয়নের আরও কয়েকটি বিশেষ সুবিধা আছে। হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তুলনায় অনেক গুণ বেশি উপযোগী করে তুলেছে। সুবিধাগুলো আলোচনা করা যাক। প্রথমত অপটিক্যাল বাধা যেকোন মাইক্রোস্কোপির একটি প্রধান অন্তরায়। এক্ষেত্রে হিলিয়াম মাইক্রোস্কোপ সেই বাধা অনেকটা অতিক্রম করতে পেরেছে। একটি বিশেষ শক্তিসম্পন্ন হিলিয়ান আয়নগুচ্ছের মধ্যে পারস্পরিক শক্তির তারতম্য বা বিস্তৃতি এতটাই কম যে এক্ষেত্রে বর্ণজনিত বাধা বা ক্রোমাটিক অ্যাবারেসন একরকম নেই বললেই চলে।

হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপের নিচে

দ্বিতীয়ত ইমেজের উচ্চ রেজুলেশন এবং শক্তিশালী বৈষম্য ছাড়াও হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপের ইমেজে ফিল্ডের গভীরতা অনেক বেশি। তৃতীয়ত, ডিফ্র্যাকশন এফেক্ট কম হওয়ার কারণে হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে অরাগানিক বা অন্তরক বস্তুর সহজেই ইমেজ পাওয়া সম্ভব।

হিলিয়াম পরমাণু নিস্ক্রিয় হওয়ার ফলে এর আয়নাইজেসন পটেনশিয়াল খুব বেশি (২৪.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট)। তাই একে আয়নাইজ করা খুব শক্ত। এক বিশেষ পদ্ধতিতে হিলিয়াম পরমাণুকে আয়নাইজ করা হয়। হিলিয়াম গ্যাসের পরিমণ্ডলে একটা টাংস্টেন টিপ রাখা হয়, যাতে অত্যাধিক উচ্চ ভোল্টেজে ইলেকট্রিক ফিল্ড আরোপ করা হয়। এই ভোল্টেজ যদি V হয় এবং টিপের বক্রতা যদি r হয়, তাহলে ইলেকট্রিক ফিল্ড F = V/5r হবে। এই সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে টিপের বক্রতা যদি বেশি হয়, তাহলে r ছোট হবে এবং ইলেকট্রিক ফিল্ড তত বেশি হবে। এই উচ্চ ভোল্টেজে টাংস্টেন টিপ থেকে ফিল্ড এমিশনের প্রভাবে ইলেকট্রন নির্গত হবে। এই ইলেকট্রন কারেন্টের পরিমাণ বেশকিছু প্যারামিটার যেমন টাংস্টেনের ওয়ার্ক ফাংশন, ফার্মি এনার্জি ও প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। এই নির্গত ইলেকট্রন হিলিয়াম পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে হিলিয়ামকে আয়নাইজ করবে। এর বেশি এখানে আলোচনা নিস্প্রয়োজন।

জার্মানীর বিখ্যাত Carl Zeiss SMT AG কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে হিলিয়াম আয়ন মাইক্রোস্কোপ তৈরিতে সফল হয়েছে। বস্তুর দ্বারা পশ্চাৎমুখী বিচ্ছুরিত হিলিয়াম আয়নের গতিশক্তি বিভিন্ন হবার ফলে প্রতিবিম্বের বিভিন্ন অংশে বৈপরীত্য সহজেই ধরা যায়।

হিলিয়াম মাইক্রোস্কোপ দিয়ে বায়োলজিক্যাল ম্যাটিরিয়ালের বিশেষ কিছুর ইমেজ পাওয়া সম্ভব যা ইলেকট্রন ইমেজ দিয়ে সম্ভব নয়। যেমন রক্তের মধ্যে ক্রোমোজোম, ইত্যাদি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রফেসর, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা, ভারত