অনুপ্রবেশের দরজা

যেভাবে কোভিড-১৯ মাবকোষে প্রবেশ করে

করোনা ভাইরাস আমাদেরকে আক্রমণ করছে বলে চারিদিকে দুশ্চিন্তা যখন তুঙ্গে, তখন প্রশ্ন জাগে এই ক্ষুদ্র ভাইরাস আমাদেরকে ঠিক কিভাবে আক্রমণ করে। আকারে আমাদের ও ভাইরাসের মধ্যে পার্থক্য তো বিশাল। ধরুন, একটা হাতির সঙ্গে, যা আমাদের থেকে ভরের দিক দিয়ে প্রায় ১০০ গুণ বড়, খালি হাতে লড়াই করে পেরে ওঠা কঠিন। সেখানে করোনা ভাইরাস থেকে আমরা প্রায় ১০,০০০ বিলিয়ন বিলিয়ন গুন বড়। কি করেই বা এ জিনিস আমাদের কে কাবু করে? করোনা ভাইরাসের আকৃতি যদি একজন মানুষের মত হত, তাহলে একজন মানুষের আকৃতি হত প্রায় তিনটা বাংলাদেশের সমান। এতবড় প্রাণীকে এত ক্ষুদ্র কীট জব্দ করে কী করে?

নভেল করোনা ভাইরাসের আক্রমণের কাহিনি ভাল করে বুঝতে গেলে, আমাদের আগে নিজেদের কোষ সম্পর্কে একটু বোঝা উচিত। মানব শরীরের কোষ এক বৈচিত্র্যময় স্থান। আকারে মনে করুন খুব সূক্ষ্ম এক বালুকণার মত, ভাল করে দেখতে গেলে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ লাগবে।

সমস্ত কোষেরই বর্ম হিসাবে একটা দেয়াল থাকে। এই বর্ম ভেদ করে কোন কিছুর ঢোকা খুব মুশকিল। কিন্তু কেন মুশকিল? ধরুন আমাদের রাষ্ট্রপতির বাসভবন, বঙ্গভবন। চারপাশে দেয়াল। ভেতরে ঢুকতে গেলে আমন্ত্রণপত্র নিয়ে নিশ্ছিদ্র দেয়ালের যেখানে প্রবেশ দরজা আছে, সেখানে প্রহরীর সাথে বলতে হয় কথা। আর এই দেয়ালও তৈরি ইট দিয়ে, দরজা লোহার আর প্রহরী একজন মানুষ।

কোষের দেয়ালকে বলে মেমব্রেন। এই মেমব্রেনের ইট হলো লিপিড নামের এক অণু। মাঝে মাঝে আছে দরজা, যা তৈরি প্রোটিন নামের আরেক অণু দিয়ে যাদেরকে বলে মেমব্রেন প্রোটিন (আরও হরেকরকম প্রোটিন আছে শহরের ভেতর, তা ধীর প্রকাশ্য)। তবে কোন প্রহরী নেই। কারণ কোষের রাজ্যের নিয়ম কানুন খুব সোজা। এক অণুর আরেক অণুকে পছন্দ হলে, তারা বাঁধে গাঁটছড়া। পছন্দ না হলে দুজনে দেখে দুজনের পথ। বাবা, মা, গোষ্ঠী, পরিবারের পরিচয় বা টাকা, বাড়ি, গাড়ি কোন কিছুর লোভ দেখিয়েই অপছন্দের দুই অণুকে একত্র করা যায় না।   

এই পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটাই বা কী? মানুষের মন দেওয়া-নেওয়া হয় বুঝি। অণুদের তো আর মন নেই, তো তারা কি দেয়া নেয়া করে? তাদের দেয়া নেয়ার মুদ্রা হলো চার্জ। এক একটা অণুতে আছে অনেক পরমাণু, যেমন ধরুন এক একটা ইটে আছে অনেক মাটির কণা, যা পুড়িয়ে তৈরি করা হয় একটা ইট। তা এরকম কিছু কিছু পরমাণুর কাছে চার্জ বেশি থাকলে সে ধনাত্মক, কম থাকলে ঋণাত্মক। এই ধনাত্মক আর ঋণাত্মক পরমাণুরা যদি অণুর বাইরের দিকে থাকে আর কাছাকাছি আসলে, তাদের মধ্যে শুরু হয় মন দেওয়া-নেওয়া।

ধনাত্মক আর ঋণাত্মকের বাইরেও আরেকধরনের আকর্ষণ কাজ করে। আসলে এটা কোন রকমেরই আকর্ষণ নয়। এর মূলে হলো পানি। কোষের ভেতর ৭০ ভাগ পানি। আর পানির একটা দিক একটু ধনাত্মক, অন্য দিকটা একই পরিমাণে ঋণাত্মক। এমন খেলোয়াড়ি অণুর প্রেমে পড়তে অন্য সব অণুই বাধ্য, সে তাদের ধনাত্মক আর ঋণাত্মক যে পরমাণুই থাকুক না কেন বাইরের পৃষ্ঠে। এখন কোন অণুর বাইরে যদি কোন চার্জ না থাকে, সে হবে জলে উদাসী। সেইসব অণুদের কোষের মধ্যে কি হয়?

কোষের মধ্যে পানির ধনাত্মক আর ঋণাত্মক সমুদ্রের মাঝখানে, উদাসী অণুরা একত্রে জোট বাঁধে, তবে বিশেষ কোন আকর্ষণের জন্য নয়, বরং পরিসংখ্যানগত স্বম্ভাবনার জন্য। একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। শান্তিনিকেতনে পড়ারর সময়, সন্ধ্যাবেলায় আড্ডার ব্যাপারে খুব স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে যেত। মেয়েদের হস্টেল ৮টায় বন্ধ হয়ে যায় বলে, যেসব ছেলেদের তাদের মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে চাইত, তারা জড়ো হত হস্টেলের সামনে আম্রকুঞ্জে। আর যেসব ছেলে বা মেয়ে সময় সন্ধ্যাটা কাটাতে চাইত একাকী, তারা জড় হত নবদ্বীপদার দোকানে। তাদেরকে কেউ যে জোর করে টেনে আনত নবদ্বীপদার দোকানে তা নয়, আম্রকুঞ্জের সমস্ত আম্র এবং বিদ্যালয়ের অঙ্গনের অন্য সমস্ত বৃক্ষেই যখন ভিড় বন্ধু এবং বান্ধবীদের, তখন একাকী ছাত্রছাত্রীদের বাঁকি ফাঁকা জায়গাতেই জড়ো হবার স্বম্ভাবনা বেশি। অণুদের মধ্যেও উদাসী অণুরা এই কারণে একত্রে জড়ো হয়।  এদেরকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে হাইড্রোফোবিক বা জলে-আতঙ্ক। যাকে আমরা বলছি জল-উদাসী। আর জলের প্রেমে হাবুডুবু অণুদেরকে বলা হয় হাইড্রোফিলিক, যার বাংলা করলাম জল-ভালবাসি। এই জল-ভালবাসি আর জল-উদাসীরা সহজে এক অন্যের কাঁছে ঘেঁষতে চায় না। কোষের কাজকর্মেও এঁর গুরুত্ব অনেক বেশি।

তাহলে আমাদের কোষের মধ্যে অণুদের পছন্দ অপছন্দের মূল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি। হয় এটা ধনাত্মক-ঋণাত্মকের ব্যাপার, অথবা উদাসী-ভালবাসার (হাইড্রোফোবিক-হাইড্রোফিলিক) ব্যাপার। এবার ফেরা যাক কোষের মেমব্রেনে।

কোষের মেমব্রেন তৈরি লিপিড অণু দিয়ে। মেমব্রেনে তৈরি হয় দুই সারির প্রায় এক বিলিয়ন লিপিড অণুর লম্বা মানববন্ধন দিয়ে। এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি লিপিড অণুর যদি দরকার হয় ক্ষুদ্র বালি কণার মত একটা কোষকে ঘিরে রাখতে, তাহলে কিছুটা হলে আন্দাজ করা যায় কতটা ছোট্ট তারা। সেই ছোট্ট লিপিড অণুর আরও ছোট্ট মাথাটা জল-ভালবাসির দলে। আর তুলনামূলক ভাবে লম্বা লেজটা জল-উদাসীর দলে।  সারিবদ্ধ লিপিড অণুগুলোর লেজগুলো থাকে মেমব্রেনের ভেতরের দিকে, এঁর মাথা গুলো থাকে বাইরে। তাতে যে জল ভালবাসি-উদাসী-ভালবাসির (হাইড্রোফোবিক-হাইড্রোফিলিক-হাইড্রোফোবিক) স্যান্ডউইচ তৈরি হয়, সে নাটক পেরিয়ে ছোটখাটো দু-একটা অণু ঢুকে পড়তে পারলেও ভাইরাসের মত বস্তুর পক্ষে ঢোকা মুশকিল। তাহলে ভাইরাস ঢোকে কী করে? ভাইরাস ঢোকে সিঁধ কেটে।

সিঁধ যখন কাটতেই হবে, ফেরা যাক বঙ্গভবনে। অতিথিদের আগমনের ব্যাবস্থা ছাড়াও বঙ্গভবনের দরজার প্রয়োজন আছে আরও এক বিশেষ কারণে। রাষ্ট্রপতি মহাশয়ের জন্য দরকার বাজার সদাই করার জন্য। সেই বাজারের আনাগোনার জন্যেও দরকার দরজা। সেরকম দরজা বঙ্গভবনে অল্প কয়েকটা হলেই চলে যায়, কিন্তু ওই যে বললাম, কোষেতে অণুদের পারস্পরিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে আছে অনেক গোঁয়ারতুমি। তাই কোষের প্রয়োজনীয় বিশেষ রকমের বাজারের জন্য আছে বিশেষ বিশেষ রকমের দরজা বা মেমব্রেন প্রোটিন। বঙ্গভবনের দেয়াল যদি হয় ৫ মাইল লম্বা, তবে তার গায়ে একেকটি মেমব্রেন প্রোটিনের তলুনামুলক আকার হবে বুড়ো আঙুলের মত। এই মেমব্রেন প্রোটিনগুলো এক-একটা দরজা তৈরি করে শুধু মাত্র পছেন্দর ছোটখাটো অণুগুলোকে লিপিড মেমব্রেনের মধ্যে যাতায়তের সুবিধা করে দেয়। বিভিন্ন রকমের অণু নিয়ে আসার জন্য, দেয়ালটা ভরা থাকে সারি সারি  বুড়ো আঙুলের মত মেমব্রেন প্রোটিনে। বাইরে থেকে দেয়ালের বদলে আঙুলই দেখা যায় বেশি। বুড়ো আঙুলের মত দরজা দিয়ে তো আর গাড়ি ঢোকানো যায় না, তাই দরজা-প্রোটিন বড় অণুগুলোকে ধরে কোষের ভেতর নিয়ে যায় লিপিড মেমব্রেনেকে বাঁকিয়ে। এরকমই এক দরজার প্রোটিনের নাম ACE2 যার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সিঁধ কাটা শুরু করে করোনা ভাইরাসের। ACE2 প্রোটিন  সবথেকে বেশি পাওয়া যায় হৃদযন্ত্রে, শিরা-উপশিরা-ধমনীতে, কিডনিতে, অন্ত্রে আর  ফুসফুসে। করোনা ভাইরাস তাই এর যেকোনো জায়গাতেই বাসা বাঁধতে পারে। ফুসফুসের সঙ্গে বাইরের পরিবেশের সবথেকে বেশি আদান-প্রদান হয় বলে, যখন শরীরে ঢোকে, ফুসফুসের ACE2 এর সাথেই ভাইরাসের বন্ধনটা হয় সবার আগে আর রোগের লক্ষণ শুরু হয় সেখান থেকেই।

লেখক: পদার্থবিদ ও কম্পিউট্যাশনাল বায়োলজিস্ট, হ্যামিলটন, যুক্তরাষ্ট্র

ইলাস্ট্রেশন: রায়ান কিসিঞ্জার, মেডিক্যাল ইলাস্ট্র্যাটর এবং আনিম্যাটর, হ্যামিলটন, যুক্তরাষ্ট্র