আন্তছায়াপথীয় সংঘর্ষে নতুন তারার জন্ম

মানুষের মতোই জন্ম-মৃত্যু ঘটে নক্ষত্রেরও। জন্মস্থানকে বলা হয় নীহারিকা বা নেবুলা। নীহারিকার উপাদান হলো গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিসহ সব গ্যালাক্সিতেই রয়েছে নীহারিকার উপস্থিতি। সাধারণত এক একটি নীহারিকা বহু আলোকবর্ষ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। একটি নীহারিকায় যে পরিমাণ গ্যাস থাকে, তা দিয়েই আমাদের সূর্যের মতো কয়েক হাজার নক্ষত্রের জন্ম হতে পারে। নীহারিকার অধিকাংশ উপাদানই হচ্ছে বিভিন্ন হালকা গ্যাস। বিশেষ করে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অণু। এসব গ্যাস ও ধূলিকণা ঘনীভূত হয়ে যথেষ্ট পরিমাণ মহাকর্ষ তৈরি করতে পারলে নিজস্ব মহাকর্ষের চাপেই সংকুুচিত হতে থাকে।

সংকুচিত হতে হতে গ্যাসগুলোর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সংকোচনশীল গ্যাস বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে একেকটি আলাদা নক্ষত্র তৈরি হয়। একসময় এ নক্ষত্রের তাপমাত্রা প্রায় ২ হাজার কেলভিনে পৌঁছায়। এ অবস্থায় হাইড্রোজেন অণু ভেঙে গিয়ে মৌলটির পরমাণুতে পরিণত হয়। এর তাপমাত্রা একসময় উঠে যায় ১০ হাজার কেলভিনে। সংকুচিত হয়ে সূর্যের প্রায় ৩০ গুণ আয়তন লাভ করলে এই নবসৃষ্ট তারকাকে বলে প্রোটো স্টার বা ভ্রূণ তারা (Protostar)। এবার এতে হাইড্রোজেন পরমাণু জোড়া লেগে লেগে হিলিয়ামে পরিণত হতে থাকে। এই নিউক্লীয় বিক্রিয়াটির নাম ফিউশন।

ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেই তারকায় একটি ভারসাম্য তৈরি হয়। নক্ষত্রের মহাকর্ষ একে গুটিয়ে আরও ছোট করে ফেলতে চায়। অন্যদিকে ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে এটি বাইরের দিকে প্রসারিত হতে চায়। বিপরীতমুখী এ দুই চাপই ভারসাম্য তৈরি করে। ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি হাইড্রোজেনে অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত চলতে থাকে এভাবেই। সাধারণত এটাই হলো নক্ষত্রের জন্মের মূল প্রক্রিয়া। এর পরবর্তী জীবনে কী ঘটে, সেটা আপাতত আমরা আলোচনা করছি না।

তবে সম্প্রতি নক্ষত্র সৃষ্টির আরেকটি প্রক্রিয়ার কথা জানা গেল। এটা ঘটল বিভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে সংঘর্ষে। আমাদের সৌর পরিবারের বসবাস মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। এর একটি প্রতিবেশী গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হলো লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউড। এর পাশেই আছে আরেকটি ছোট ছায়াপথ। নাম ছোট ম্যাজেলানিক ক্লাউড। সম্প্রতি বড় ছায়াপথের চারপাশে একগুচ্ছ নতুন নক্ষত্রের একটি বলয় আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এদের জন্ম হয়েছে দুটো ছায়াপথের সংঘর্ষে।

বড় ও ছোট ম্যাজেলানিক ক্লাউডকে ছায়াপথ বলা হলেও এরা আমাদের মিল্কিওয়েকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। গ্রহরা যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, অনেকটা তেমনই। বড়টির দূরত্ব আমাদের থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার আলোকবর্ষ। আর ছোটটি আছে ২ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। এর মানে, পৃথিবী থেকে আলোর বেগে রওনা দিলেও এতে পৌঁছাতে সময় লাগবে ২ লাখ বছর!

বর্তমানে এরা একে অপর থেকে ৭৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে আছে। কিন্তু ২০ কোটি বছর আগে এরা ছিল আরও অনেক কাছাকাছি। আবার এমনো হতে পারে যে ছোটটি বড়টির পেটের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি বড় ছায়াপথটির প্রান্তের দিকে ছয়টি নবতারা দেখা গেছে। আবিষ্কারটি করেছেন চিলির জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান মনি বিডিন ও তাঁর সহকর্মীরা। এ ছয়টি তারার মধ্যে মাত্র একটিকে পাওয়া গেছে নতুন তারার জন্মস্থানের মধ্যে। বাকি পাঁচটির অবস্থান হলো এমন জায়গায়, যেখানে শুধু পুরাতন তারকাদের উপস্থিতি আছে।

মনি বিডন বলেন, এটা খুবই বিস্ময়কর ঘটনা। অঞ্চলটিতে সাম্প্রতিককালে নতুন তারা তৈরির কোনো লক্ষণই ছিল না।

হতে পারে দুটো গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এদের গ্যাস সংকুচিত হয়ে নতুন তারার উদ্ভব ঘটেছে। নতুন এ তারাদের বয়স ১ থেকে ৫ কোটি বছরের মধ্যে। সাধারণ নক্ষত্রের হিসাবে এ বয়স খুব সামান্য। মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন নক্ষত্রের বয়স মহাবিশ্বের বয়সেরই কাছাকাছি। মানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর। ফলে নতুন এ তারাগুলোকে ছায়াপথ দুটোর সংঘাতের ফলাফল বলে ধরে নেওয়া খুবই যৌক্তিক। বিডিনের মতে, এ অঞ্চলে আরও এমন নতুন তারা পাওয়া যেতে পারে। হতে পারে সেগুলো তুলনামূলকভাবে অনুজ্জ্বল।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, বিশ্ব ডটকম, অ্যাস্ট্রোনমি ডটকম