আবিষ্কারের নেশায়

‘উদ্ভাবন’ ও ‘আবিষ্কার’ প্রায় একই অর্থ বহন করে। যদিও তাদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। অনেকেই এভাবে মনে করেন যে প্রকৃতিতে তো সবকিছুই আগে থেকেই ছিল। আমরা শুধু বেশি গবেষণা করে লুকানো ব্যাপার-স্যাপার খুঁজে বের করছি। কাজেই লুকানো কোনো বিষয়কে প্রকাশ্যে আনাই আবিষ্কার। তবে মুখের কথায় আমরা অবশ্য ‘উদ্ভাবন’ শব্দটা ব্যবহার করি। এর মানে অনেকটা এ রকম: কেউ যাহা জানে নাই, কেউ যাহা বলে নাই, সেটাই খুঁজে বের করা। ‘উদ্ভাবন’ হলো নতুন কিছু তৈরি করা, ‘আবিষ্কার’ হলো কোনো কিছু প্রকাশ করা। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন।

চাকা বা বলপয়েন্ট আবিষ্কারকে আমরা বলতে পারি ‘উদ্ভাবন’। কারণ এ রকম কোনো জিনিস মানবসভ্যতার ইতিহাসে কদাচিত্ ছিল না। কিন্তু ডিজিটাল ঘড়ি আবিষ্কার ‘আবিষ্কার’ই। কারণ চিরন্তন ঘড়ির ধারণা থেকেই ডিজিটাল ঘড়ি তৈরি হয়েছে। এখানে প্রযুক্তি আরও শাণিত হয়েছে। এ জন্য ‘আবিষ্কার’ সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আর মনুষ্যসৃষ্ট কিছুর ক্ষেত্রে ‘উদ্ভাবন’ শব্দটি লাগসই। তবে আমাদের দৈনন্দিন কথায় এ দুটোর এমন বিভাগ কখনো আমরা চিন্তা করে বলি না।

কিন্তু আবিষ্কারের নেশা যাঁদের একবার চেপে বসে, তাঁদের আর নিস্তার নেই। দুঃসাহসিক অভিযাত্রী বলি, আর দুঁদে বিজ্ঞানী বলি, কিংবা অসমসাহসী নভোচারী—এঁরা সবাইই এই নেশায় আক্রান্ত। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার দুর্বার কৌতূহলই আবিষ্কারের নেশার পেছনে কাজ করে। যদি পদার্থবিজ্ঞানীদের কথাই বলি, আবিষ্কারের নেশা একবার চেপে বসলে দিন-রাত গবেষণাগারেই সময় কাটে। শয়নে, স্বপনে, ধ্যানে-জ্ঞানে শুধু ওই সমস্যাই তাঁর মাথায় ঘোরে। কোনো একটা সমস্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করলে তখন ওই সমস্যার মধ্যেই ডুবে যেতে হয়। এভাবেই যুগান্তকারী উদ্ভাবনগুলো সম্পন্ন হয়েছে। ‘গবেষণা’ শব্দটাই এসেছে গরু খোঁজাখুঁজির মূল থেকে।

আবিষ্কারের নেশা এক আশ্চর্য নেশা। সেই সব মানুষই ভাগ্যবান, যাঁরা এই নেশার স্পর্শ পেয়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে, গবেষকের জীবন শুধু ল্যাব-আবিষ্কার-নেশা-ল্যাব এ রকম চক্রে সীমাবদ্ধ নয়। খেয়াল রাখতে হবে, ১০ বার চেষ্টা করলে ৯ বার ব্যর্থ হতে হয়, শুধু একবারই সাফল্য আসে। অর্থাত্ গবেষণায় সাফল্যের কাহিনি শুধুই আনন্দের কাহিনি নয়। এখানে ব্যর্থতা আছে, শোক আছে, ব্যক্তিগত অনেক অপ্রাপ্তির বেদনা আছে। এগুলোর কোনোটিই ফেলনা নয়।

ইউরেকা মুহূর্ত

আবিষ্কারের নেশায় ডুবে থাকা মানুষের হিতাহিতের জ্ঞান থাকে না। এমনটাই আমরা জেনেছি। এর পেছনে একটা বিখ্যাত গল্প দায়ী। সেটা হলো আর্কিমিডিসের গল্প। সিরাকিউস শহরের বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসকে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৭-২১২) রাজা আদেশ দেন যে রাজমুকুটের সোনায় কী পরিমাণ খাদ আছে, সেটা মুকুট না ভেঙে বলার উপায় বাতলাতে। সমাধান খুঁজতে গিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত আর্কিমিডিস গোসল করতে তাঁর বাথটাবে বসেছিলেন। আমরা সবাই জানি, ভরা চৌবাচ্চায় বসলে কিছু পানি উপচে পড়ে। আর এটি দেখেই আর্কিমিডিসের মাথায় চলে এল প্লবতার সূত্র। তিনি বুঝতে পারলেন, পানিতে ডুবন্ত বস্তু তার সমান আয়তনের পানি অপসারিত করে। আর এটাই তাঁর সমস্যাকে সমাধান করে দেবে। এই আইডিয়া মাথায় আসতেই আর্কিমিডিস পড়িমরি করে রাজদরবারের দিকে দৌড় দিলেন ‘ইউরেকা, ইউরেকা, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি’ বলতে বলতে। তিনি পুরোই ভুলে গেলেন যে তাঁর গায়ে কোনো কাপড় নেই। রাস্তার মানুষ দেখল বিজ্ঞানীপ্রবর ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে দৌড়াচ্ছেন।

একেই বলে ‘ইউরেকা মোমেন্ট’ বা ‘পেয়েছি মুহূর্ত’। অবশ্য আর্কিমিডিসের গল্পটা সত্যি কি না কেউ নিশ্চিত নয়। তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ রকম অনেকবারই ঘটেছে। কোনো একটা সামান্য ঘটনা থেকে সূত্র পেয়ে অন্য কোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া অনেকবারই ঘটেছে। এগুলোকে ‘পেয়েছি মুহূর্ত’ বলে।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫) ১৯২৮ সালে এ রকমই এক ‘পেয়েছি মুহূর্তে’র সাহায্যে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। হেনরি বেকেরেল (১৮৫২-১৯০৮) এ রকম এক ঘটনাচক্রের মাধ্যমে এক্স-রে আবিষ্কার করেন। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাছির নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করতে করতেই রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) স্থানাঙ্ক জ্যামিতি আবিষ্কার করে ফেলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ রকম বহু বিজ্ঞানীর অনেক ইউরেকা মোমেন্টের গল্প জানা যায়।

একই রকম আরেকটি মুহূর্ত হলো ‘মিলে গেছে মুহূর্ত’ বা ‘আহা মোমেন্ট’। অনেক সময় ধরে কোনো একটা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাত্ মিলে গেলে এই ‘মিলে গেছে মুহূর্ত’ এসে পড়ে। ‘ইউরেকা মোমেন্ট’ থেকে ‘আহা মোমেন্টে’র পার্থক্য হলো প্রথমটি বড় সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আবিষ্কার। পরেরটি খুচরো প্রবলেমের চটজলদি সমাধান। ধরা যাক, আপনি একটা জিগ-স বা সুডোকু পাজল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। অনেকক্ষণ ধরেই আপনি চিন্তিত, কিন্তু কিছুতেই মিলছে না। হঠাত্ বুঝে ফেললেন কীভাবে করতে হবে। আচানক একটা সূত্র আপনার মাথায় এল, আর অমনি সব সামাধান হয়ে গেল!

পরীক্ষার খাতায়, ভর্তি বা চাকরিযুদ্ধে, মৌখিক পরীক্ষায়, কাজের জায়গায় কোনো সমস্যায় এই ‘মিলে গেছে মুহূর্ত’ খুব কাজে দেয়। এগুলো এমন নয় যে আপনি ইচ্ছা করলেই চলে আসে। এগুলো কাকতালীয়। স্রেফ ঘটনাক্রম। এদের আগে-পরে কোনো কারণ থোকে না। কিন্তু এগুলো খুব কাজের। ‘পেয়েছি মুহূর্ত’ আর ‘মিলে গেছে মুহূর্ত’ দুটোই বিজ্ঞান গবেষণায় খুব কাজের। এটা অবশ্য আমাদের মগজেরই একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আলোকপাত করে। খুব চাপের মধ্যে পড়লে মস্তিষ্কের জটিলতড়িত্-রাসায়নিক ক্রিয়া এ রকম পরিস্থিতির জন্ম দেয়। কাজেই মনোবিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে গবেষণা করছেন।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎ কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিগানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত