ইলেকট্রনিক পাঠশালা ৪

থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স মাপার সার্কিট

আগের পর্বে আমরা একটি মাল্টিমিটার দিয়ে থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স মেপে তাপমাত্রা পরিমাপের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার থার্মিস্টর ব্যবহার করে নিজে নিজেই কীভাবে বিভিন্ন মৌলিক সার্কিট বানানো যায়, তা নিয়ে আলাপ করব। আগেই বলেছি, থার্মিস্টর মূলত একটি রেজিস্টর বা রোধক। রেজিস্ট্যান্স মাপতে হলে ছবি ১-এর মতো প্রথমে থার্মিস্টর R-এর মধ্য দিয়ে আমরা বিদ্যুত্ প্রবাহিত করি, তারপর এর দুই প্রান্তে কতটা ভোল্টেজ V উত্পন্ন হলো, সেটি পরিমাপ করি।

ছবি ১
বিজ্ঞানচিন্তা

এখানে ভোল্টেজ হবে V=IR, অর্থাৎ কারেন্ট এবং থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্সের মানের গুণফল। এখন যদি এমনভাবে ব্যবস্থা করি (আলাদা সার্কিট ব্যবহার করে) যেন রেজিস্ট্যান্সের মান যা-ই হোক না কেন, কারেন্টের মান অপরিবর্তিত থাকবে, তাহলে ভোল্টেজের মান সরাসরি রেজিস্ট্যান্সের মানের সমানুপাতিক হবে। সে ক্ষেত্রে সার্কিটটি দাঁড়াবে ছবি ২-এর মতো। এর শুরুতেই (বাঁ দিকে) রয়েছে একটি কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্স (constant current source), যেটি নিজেই একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট।

থার্মিস্টরের বা রেজিস্টরের মান যা-ই হোক না কেন, এর থেকে প্রবাহিত কারেন্ট সব সময় অপরিবর্তিত (constant) থাকবে। অবশ্য যেকোনো সার্কিটের ক্ষমতারও একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। কিন্তু এমনভাবে কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সটি ডিজাইন করতে হবে, যেন আমাদের থার্মিস্টরের মান যে সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে, তার মধ্যে এর কারেন্ট অপরিবর্তিত থাকে। এর জন্য আমাকে আগে থেকেই মোটামুটি জানতে হবে তাপমাত্রার কতখানি ওঠানামার মধ্যে আমার যন্ত্রটি কাজ করবে এবং তাতে আমার ব্যবহার করা থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্সের মান কত থেকে কত পর্যন্ত ওঠানামা করবে।

এবার কারেন্ট যাওয়ার ফলে থার্মিস্টরের দুই প্রান্তে যে ভোল্টেজ V তৈরি হবে, সেটিকে একটি অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করে তার গেইন (gain) এমনভাবে ডিজাইন করে নিতে হবে, যেন এমপ্লিফায়ারের আউটপুটে যে ভোল্টেজ Vout আসবে, সেটির সাংখ্য মান আমাদের থার্মিস্টরের যে রেজিস্ট্যান্সের মান রয়েছে তার সমান হয়। এর জন্য অ্যামপ্লিফায়ারের গেইন কমবেশি করে অ্যাডজাস্ট করার ব্যবস্থা রাখতে হয়, যা খুব কঠিন কাজ নয়। অবশ্য এসব প্রাথমিক মাপজোখের জন্য প্রথমেই থার্মিস্টর না লাগিয়ে তার মানের কাছাকাছি কিন্তু জানা মানের একটি স্থির রেজিস্টর লাগিয়ে করা দরকার। থার্মিস্টরের মান যে সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে, সে সীমার মধ্যে আরও কয়েকটি মানের স্থির রেজিস্টর লাগিয়েও পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে আমাদের সার্কিটটি পুরো সীমার মধ্যে ঠিকভাবে কাজ করছে কি না। ভালো হয় যদি আমরা এ পরীক্ষার ফলাফল একটি ছকে লিখে নিই এবং পরীক্ষা করে নিই যে সত্যি সত্যিই আমাদের আউটপুট ভোল্টেজের সাংখ্য মান কাঙ্ক্ষিত রেজিস্ট্যান্সের সাংখ্য মানের সমান হয়েছে কি না। যদি একটু ভিন্ন হয়, তবে অ্যামপ্লিফায়ারের গেইনকে আবারও একটু অ্যাডজাস্ট করে নিই যেন কাঙ্ক্ষিত আউটপুট ভোল্টেজ আসে। তবে একবারেই এমনটি পাওয়া একটু কঠিন হতে পারে, তবে যদি ৫ শতাংশ ভুলের কম থাকে, তবে আপাতত আমরা ধরে নেব যে আমাদের পরীক্ষা ঠিকমতো এগোচ্ছে। পরে আরও পড়াশোনা করে দেখতে হবে কীভাবে ভুলের পরিমাণ কমানো যায়। ভালো একটি সার্কিটে আমরা ১ শতাংশ বা তারও কম ভুল আশা করতে পারি।

ছবি ২
বিজ্ঞানচিন্তা

যেসব কারণে ভুল মান আসতে পারে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। প্রথমেই বলতে হয় স্থির রেজিস্ট্যান্সের মানের কথা। বাজার থেকে আমরা যেসব রেজিস্ট্যান্স কিনতে পাই, তার বেশির ভাগের মান তার ওপরে নির্দেশ করা মানের থেকে কমবেশি হয়ে থাকে। সাধারণত আমরা সচরাচর যেগুলো কিনে থাকি, সেগুলো ছবি ৩-এর মতো কার্বন রেজিস্টর। এদের মান রঙের ব্যান্ড দেওয়া কোডের মাধ্যমে নির্দেশ করা থাকে।

এ নির্দিষ্ট মান থেকে আসল রেজিস্ট্যান্সের মানের মধ্যে ৫ শতাংশ কমবেশি হতে পারে। এ কমবেশি হওয়াটিকে বলা হয় টলারেন্স (Tolerance), প্রস্তুতকারকের জন্য এ সীমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৫ শতাংশ টলারেন্সের একটি ১০ কিলোওহম রেজিস্ট্যান্সের মান ৯ দশমিক ৫ কিলোওহম থেকে ১০ দশমিক ৫ কিলোওহম পর্যন্ত মানের মধ্যে হতে পারে। বিদেশে একটু বেশি দামে ১ শতাংশ টলারেন্সের কার্বন ফিল্ম রেজিস্টর পাওয়া যায়, দেশের কোনো কোনো দোকানে খোঁজ করলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তবে ০ দশমিক ১ শতাংশ টলারেন্সের রেজিস্টরও পাওয়া যায়, যেগুলো প্যাঁচানো তার দিয়ে তৈরি হয়, বিধায় এদের বলা হয় ওয়্যার উন্ড (wire wound) রেজিস্টর (ছবি ৪)। এদের মান সরাসরি সংখ্যা দিয়েই লেখা থাকে। এগুলো কিন্তু দেশের বাজারেও পাওয়া যায়, তবে দাম আরেকটু বেশি। তবে এর কয়েকটি কিনে রাখলে তা এ ধরনের পরীক্ষা করার জন্য সব সময় কাজে আসবে।

ছবি ৩
বিজ্ঞানচিন্তা

দ্বিতীয় ভুলের কারণ হতে পারে কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সের ডিজাইনের দুর্বলতা ও অ্যামপ্লিফায়ার সার্কিটের জন্য ব্যবহার করা পাওয়ার সাপ্লাই বা ব্যাটারির ভোল্টেজ। এগুলো নিয়ে পরে সুবিধামতো সময়ে আলোচনা করা যাবে।

শীতকালে বাতাস খুব শুষ্ক, আমরা সেটা নিয়মিতই টের পাচ্ছি। গায়ের চামড়া যাতে ফেটে না যায় বা টানটান মনে না হয়, সে জন্য শীতকালে আমরা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করি। ময়েশ্চারাইজার চামড়া আর্দ্র রাখে। বছরের অন্য সময় আমাদের আলাদাভাবে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার না করলেও চলে। তার কারণ, তখন বাতাসের আর্দ্রতা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। এই আর্দ্রতা ব্যাপারটা আসলে বেশ মজার।

ছবি ৪
বিজ্ঞানচিন্তা

কোনো একটা জায়গার আর্দ্রতা বলতে আসলে বোঝায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কতটুকু। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকা মানে আর্দ্রতা বেশি। আর্দ্রতা খুব বেশি না হলে আমাদের শরীরের ঘাম তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, অস্বস্তি কম লাগে। জামাকাপড় ধুয়ে দেওয়ার পর দ্রুত শুকিয়ে যায়। আর্দ্রতা বেশি হলে তার উল্টোটা হয়। বিজ্ঞানীদের কাছে অবশ্য আর্দ্রতা জিনিসটার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। কোনো জায়গার এক ঘনমিটার আয়তনের বাতাসে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকে, সেটাকে ওই জায়গার Absolute humidity বা পরম আর্দ্রতা বলে।

পরম আর্দ্রতা ছাড়াও আপেক্ষিক আর্দ্রতা নামে আরেকটা ব্যাপার আছে। আমরা যখন আবহাওয়ার খবরে শুনি, কোনো এক দিন সন্ধ্যায় একটা জেলায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৬৫ শতাংশ, সেটা দিয়ে আসলে আপেক্ষিক আর্দ্রতাকেই বোঝানো হয়। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো একটা জায়গার বাতাসে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকতে পারে, সে পরিমাণ জলীয় বাষ্প সেখানে থাকলে সেটাকে সম্পৃক্ত বাতাস বলা হয়। আর বাতাস যখন সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তখনই আমরা শিশির পড়তে দেখি। বাতাসের আর্দ্রতা ৬৫ শতাংশ দিয়ে বোঝানো হয়, বাতাসের তাপমাত্রায় একটা নির্দিষ্ট আয়তনের বাতাসকে সম্পৃক্ত করতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প বাতাসে থাকা দরকার, তার ৬৫ শতাংশ জলীয় বাষ্প বর্তমানে বাতাসে আছে।

আপেক্ষিক আর্দ্রতা আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ছাড়াও শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে ফসল, শাকসবজি উত্পাদন, রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগে। হাইগ্রোমিটার ব্যবহার করে আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাপা যায়। হাইগ্রোমিটার অনেকভাবেই তৈরি করা যায়। আমরা আজকে যে হাইগ্রোমিটারটি তৈরি করব, সেটাতে মূলত দুটি থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এটি তৈরি করা বেশ সহজ। এই বিশেষ ধরনের হাইগ্রোমিটারকে সাইক্রোমিটার (psychrometer) বলা হয়।

লেখক: অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়

এই সিরিজের আগের লেখাগুলি:

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ১

ইলেকট্রনিক পাঠশালা ২

ইলেকট্রনিক পাঠশালা৩