এমন মানব জনম

কিছুদিন ধরে আমি অদ্ভুত একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। উঠতে-বসতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আমি রোবট কি না। প্রশ্নটা করছে আমার ব্যক্তিগত কম্পিউটার। কোনো নতুন ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করলে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠছে প্রশ্ন: Are you a robot?

এমন একটা বেকায়দা প্রশ্নেই শেষ হচ্ছে না ব্যাপারটা। এরপর আমাকে একটা পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে আমি রোবট নই।

পরীক্ষাগুলো খুব সোজা অবশ্য। কিছু এলোমেলো ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে কোন কোন ছবিতে রাস্তায় সাইনবোর্ড ঝুলছে, সেগুলোয় ক্লিক করতে বা কোনগুলো দোকানের ছবি ইত্যাদি। ক্লিক করলেই আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে খুলে যাচ্ছে আমার অভীষ্ট ওয়েবপেজ।

সমস্যা হলো, যতবার কম্পিউটার আমাকে এই প্রশ্ন করে, ততবার আমি একধরনের অস্বস্তিতে ভুগি। পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমার বুক দুরু দুরু করে। যদি ফেল করি?! যদি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হই আমি রোবট নই?

জানি, তাতে আকাশ ভেঙে পড়বে না। কেউ এসে আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে না। বলতে কী, ওই নিতান্ত জলের মতো সহজ পরীক্ষাতেও আমি যে টুকটাক ভুল করি না তা নয়। মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় ফেল করি। কিছু কিছু ছবি নিয়ে কনফিউশনে ভুগে শেষে ভুল ছবিতে ক্লিক করে বসি। তখন আমাকে রোবট প্রতিপন্ন করে কেউ হই-হল্লা শুরু করে দেয় না বটে, কিন্তু আমার অস্বস্তি যায় না। এমনকি কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় পাস করায় ওয়েবপেজের দরজা চিচিং ফাঁক হয়ে যাওয়ার পরও কতগুলো মৌলিক দুশ্চিন্তা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।

কথা হলো, আমি রোবট নাকি মানুষ—এই প্রশ্নটা এখন উঠছে কেন? আগে তো ওঠেনি। আর যদিবা উঠছেই, অতি সরল এসব পরীক্ষায় কম্পিউটার কী করে সাব্যস্ত করছে আমি রোবট নই? কী করে নিশ্চিত হচ্ছে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: পরীক্ষাটা নিচ্ছে কে?

ব্যাপারটা আমাকে সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন আমারই এক ওয়াকিবহাল, যুক্তিবাদী সহকর্মী। বললেন, কম্পিউটারের জগতে দুষ্ট লোকদের একটা বিরক্তিকর উত্পাতের নাম ‘বট’। এগুলো হ্যাকারদের বানানো এমন কিছু অটোমেটেড প্রোগ্রাম, যা ওয়েবসাইটগুলোকে অনবরত সার্চ রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকে। তাতে রিকোয়েস্টের চাপে ওয়েবসাইটগুলো স্থবির হয়ে পড়ে। দুনিয়ায় এই মুহূর্তে ইন্টারনেটের জগতে যত জন কম্পিউটার ইউজার এক পেজ থেকে আরেক পেজে ছুটে বেড়াচ্ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আসলে মানুষ নয়, একধরনের ‘বট’।

কম্পিউটার আসলে যাচাই করে দেখার চেষ্টা করছে, আমি রক্তমাংসের মানুষ, নাকি ‘বট’ নামক কতগুলো নির্জীব গাণিতিক অ্যালগরিদম। মানে চাল থেকে খুদ বাছাই আরকি। কিংবা আরও নির্ভুলভাবে বললে, খুদ থেকে চাল বাছাই।

যে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এটা যাচাই করা হচ্ছে, সেটাকে বলে ‘ক্যাপচা’। পুরো নাম ‘কমপ্লিটলি অটোমেটেড পাবলিক ট্যুরিং টেস্ট দ্যাট টেল কম্পিউটারস অ্যান্ড হিউম্যানস অ্যাপার্ট’। আগে ক্যাপচা পরীক্ষাগুলো ছিল টেক্সটভিত্তিক। কতগুলো বিকৃত রোমান হরফ বা সংখ্যার ছবি দেখানো হতো। সেগুলো দেখে দেখে শুদ্ধ করে লিখে দিতে হবে। এখন পরীক্ষায় বৈচিত্র্য এসেছে। ছবি দেখানো হচ্ছে।

তাহলে বোঝা গেল, যে পরীক্ষায় আমাকে প্রায়ই অবতীর্ণ হতে হচ্ছে, সেটা একটা ট্যুরিং টেস্ট। এটা একটা ছাঁকনিবিশেষ। মানুষ নয় এমন কোনো কিছুই এই ছাঁকনির ফাঁক গলে ঢুকে পড়তে পারবে না। তার মানে ওই সোজা সোজা তামাশামূলক প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব দিতে পারবে না কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধির এই উচ্চাসন দেখে কিছুটা শ্লাঘা বোধ করলাম।

অ্যালান ট্যুরিং নামের এক ব্রিটিশ সংকেতবিদ ৬৭ বছর আগে যখন এই পরীক্ষার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, তখন অবশ্য তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটা মানুষের পর্যায়ে এসেছে, তা মাপার জন্য ট্যুরিং এই পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। এখন সেই পরীক্ষা যেনবা একটা ডিসকো পার্টির দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীর ভূমিকা নিয়েছে, যে প্রহরী পার্টিতে ঢুকতে চেষ্টা করা বেচারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলোকে দরজায় আটকে দিয়ে শুধু মানুষকে ঢুকতে দিচ্ছে।

তবে ভেবে দেখলে এখানে মানুষের জন্যও কিঞ্চিত অপমানের ব্যাপার আছে। অপমানটা এখানে নয় যে, মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একই লাইনে দাঁড়িয়ে একই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এই পরীক্ষাটা আসলে নিচ্ছে কে? কে পরীক্ষক? পরীক্ষক এক বুদ্ধিহীন কম্পিউটার। আরেকটা অন্ধ অ্যালগরিদম। এ জন্য অনেকে ক্যাপচাকে বলেন রিভার্স ট্যুরিং টেস্ট। মানে কম্পিউটার নিচ্ছে মানুষের পরীক্ষা।

ট্যুরিং টেস্ট নামটা মনে পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল ব্রিটেনের ব্রাইটন শহরে প্রতিবছর এক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আসরের কথা। বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রেসিং প্রতিযোগিতা সেটা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোন ডিজাইনটি মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি আসতে পেরেছে, তারই মরণপণ লড়াই যেন। যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়, তাকে দেওয়া হয় ‘দ্য মোস্ট হিউম্যান কম্পিউটার’ উপাধি। তবে ওই একই প্রতিযোগিতায় সম্প্রতি আরেকটি উপাধি চালু করা হয়েছে। সেটার নাম ‘দ্য মোস্ট হিউম্যান হিউম্যান’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘সবচেয়ে মানবীয় মানব’। সেটা আবার কী?

ব্যাখ্যা করতে হলে আগে প্রতিযোগিতার পদ্ধতিটি একটু বলে নিতে হয়। এই প্রতিযোগিতায় কতগুলো ‘চ্যাটবট’ অংশ নেয় একটি স্ট্যান্ডার্ড ট্যুরিং টেস্টে। চ্যাটবট হলো মানুষের মতো কথা বলতে সক্ষম কতগুলো ইন্টারনেট প্রোগ্রাম। এরা একটা কোনো চরিত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে এমনভাবে টেক্সটভিত্তিক কথোপথন বা ‘চ্যাটে’ অংশ নেয়, মানুষ বুঝতেই পারে না, তারা আসলে কম্পিউটার প্রোগ্রামের সঙ্গে কথা বলছে। অনেকেই ধোঁকা খায়। এমনকি ব্রাইটনে এই প্রতিযোগিতার আয়োজকদের একজন তো রীতিমতো ছ্যাঁকাই খেয়েছেন। ইন্টারনেটের চ্যাটরুমের গোলকধাঁধায় তিনি যে চিকিত্সক মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন, কালক্রমে উদ্ঘাটন হয়, সেটা আসলে একটি চ্যাটবট।

তো, ব্রাইটনে এ রকম একসার চ্যাটবট বসে কতগুলো মানুষ বিচারকের সঙ্গে কথোপকথনে। তাদের টার্গেট মানুষ বিচারকদের ধোঁকা দেওয়া। কিন্তু মানুষ বিচারকেরা যদি আগে থেকেই জানেন, তাঁরা চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলছেন, তাহলে আর ফাঁকি দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কীভাবে? এখানেই টুইস্ট। চ্যাটবটদের সঙ্গে একই সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয় কতগুলো মামুলি মানুষকেও। মানে বিচারকেরা মানুষ আর চ্যাটবট উভয়ের সঙ্গেই কথোপকথনে লিপ্ত হন। আগে থেকে তাঁদের জানার সুযোগ থাকে না, তাঁরা এ মুহূর্তে যার সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা কোনো মানুষ, নাকি চ্যাটবট। কথোপকথন শেষে অনুমান করতে হবে, কোনটা মানুষ, কোনটা চ্যাটবট। মানে একধরনের নম্বর দিতে হবে পরীক্ষায়। যে চ্যাটবট সবচেয়ে বেশি বিচারকের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে, সেটি হবে সে বছরের সবচেয়ে ‘মানবীয় কম্পিউটার’ (দ্য মোস্ট হিউম্যান কম্পিউটার)। আর ওই একই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মামুলি মানুষগুলোর জন্য আছে সান্ত্বনা পুরস্কার, ‘দ্য মোস্ট হিউম্যান হিউম্যান’। যাঁকে সবচেয়ে বেশি বিচারক মানুষ বলে অনুমান করেছেন, তিনি এই সান্ত্বনা পুরস্কারে ভূষিত হবেন। অর্থাত্ তাঁর চালচলন, বুদ্ধিশুদ্ধি সবচেয়ে বেশি মানুষের মতো।

২০০৯ সালে যে লোকগুলো নমুনা মানব হিসেবে এই ট্যুরিং টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন আমেরিকান কবি ব্রায়ান ক্রিশ্চিয়ান। ব্রায়ান লোকটা একটু বাতিকগ্রস্তই বলতে হবে। এই প্রতিযোগিতাকে তিনি খুব সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিলেন। সবচেয়ে মানবীয় মানবের ওই সান্ত্বনা পুরস্কার পাওয়ার জন্য তিনি রীতিমতো প্রাণপাত করতে শুরু করেন। আটঘাট বেঁধে নামেন প্রস্তুতিতে। আগের বছরের শিরোপাজয়ীদের কাছে ধরনা দিতে থাকেন। জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে কথা বললে, কী রকম আচরণ করলে ঠিক মানুষের মতোই আচরণ করা হবে। পণ্ডিতেরা তাঁকে বলেছেন, কিছুই করতে হবে না। কেবল নিজের মতো হওয়ার চেষ্টা করলেই হবে (জাস্ট বি ইয়োরসেলফ)।

ব্রায়ান ক্রিশ্চিয়ান খোঁজ নিয়ে দেখলেন, তাঁর আগের বছর যিনি এই শিরোপা জিতেছেন, তিনি অয়্যারড পত্রিকার কলামিস্ট চার্লস প্ল্যাট। প্ল্যাট কীভাবে জিতলেন? তিনি জিতেছেন ‘ভীষণ মুডি, বিরক্তিকর আর যন্ত্রণাদায়ক উত্পাত’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কারণে। উদ্ধৃতিচিহ্নের বিশেষণগুলো বিচারকদের মন্তব্য। তাহলে ব্রায়ান ক্রিশ্চিয়ান এখন কী করবেন?

ব্রায়ান তা-ই করলেন, বাংলার বাউল-ফকিরেরা যুগ যুগ ধরে যা করে আসছেন। তিনি মানুষ নামের এই জীবের অন্তঃসার বা এসেন্সের অনুসন্ধানে নামলেন। মার্কিন কবি একতারা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন না বটে, তবে তাঁর অনুসন্ধান শুধু বিজ্ঞানের চৌহদ্দিতেও আর সীমাবদ্ধ থাকল না। মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র ও দর্শনের রাজ্যে পা রাখতে হলো ব্রায়ানকে।

অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১২ সালে একটি বই লিখে ফেলেন ব্রায়ান। বইটির নাম দ্য মোস্ট হিউম্যান হিউম্যান। দুনিয়ায় এ রকম অদ্ভুত বই খুব কমই লেখা হয়েছে। মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা বানানোর প্রতিযোগিতা ব্রায়ানের চোখে শেষ নাগাদ কী করে মনুষ্যত্বের নির্যাস নির্ণয়ের জটিলতায় পর্যবসিত হলো, এটা তারই বয়ান।

ব্রায়ানের এত আয়োজন বিফলে যায়নি। ওই বছর তিনিই সবচেয়ে মানবীয় মানবের শিরোপা জিতেছিলেন।

তবে খুব খুশি মনে বাড়ির পথ ধরতে পারেননি ব্রায়ান। মানুষের জন্য এক দীর্ঘশ্বাস পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছে তার মনে। কেন, সেটা বইতে বুঝিয়েও বলেছেন তিনি। ব্রায়ান বলছেন, মানুষ তার নিজের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজের চারপাশে বালুতে যে বৃত্তাকার দাগ টেনে দিয়েছে, সেই দাগ তাকে বারবারই মুছে ফেলতে হচ্ছে। কেননা দুপাশ থেকে ক্রমাগত তার চৌহদ্দির দিকে চেপে আসছে দুটি পক্ষ। একদিকে বিচিত্র প্রাণিকুল, আরেক দিক থেকে আসছে যন্ত্রেরা। ব্রায়ানের দুশ্চিন্তা, এমন দিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন ক্রমশ সংকোচনশীল এ দাগ মানুষকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত

ব্রায়ানের লেখা দ্য মোস্ট হিউম্যান হিউম্যান বইয়ের প্রচ্ছদ