কজনের চোখে তিল ছিল?

একদিন রাজা সভা ডেকে বললেন, ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। যাদের চোখে তিল আছে, ওরা অপয়া। আমি চাই না এ ধরনের কেউ আমাদের গ্রামে থাকুক। যদি কেউ থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।

রাজা বললেন, আমি বলব না কার চোখে তিল। শুধু বলব, অন্তত একজনের চোখে তিল আছে। তিনি এও বললেন, তোমরা যদি দেখো কারও চোখে তিল, তাহলে সেটা গোপন রাখবে, তাকে বলবে না। যার চোখে তিল আছে সে নিজেই বুঝে নেবে সেটা। এবং যেদিন সে এটা বুঝতে পারবে, তার পরদিনই তাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।

রাজা আবারও মনে করিয়ে দিলেন, গ্রামে অন্তত একজনের চোখে তিল আছে।

সেই গ্রামে কারও কাছে আয়না ছিল না। কোনো পুকুরও ছিল না। তাই কেউ নিজের চেহারা কখনো দেখেনি। আবার একজনের চেহারা নিয়ে অন্য কেউ কথাও বলত না। অন্যের চেহারা নিয়ে কোনো কিছু বলা তাদের রীতির মধ্যে পড়ে না। তাই কেউ যদি কখনো লক্ষ করেও থাকে যে অন্য একজনের চোখে তিল, সেটা নিয়ে সে আলোচনাও করত না। ফলে গ্রামের কেউ জানত না তার নিজের চোখে তিল আছে কি না।

গ্রামের লোকগুলো শান্ত। সংখ্যায় কম। প্রতিদিন সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়, পরস্পরকে সহযোগিতা করে। প্রতারণা জানে না। খুব দায়িত্বশীল। ন্যায়ের পথে থাকে। রাজার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।

ওরা সবাই গণিতে খুব পাকা। রাজা নিজেও একজন ভালো গণিতবিদ। গণিতের যুক্তি দিয়ে ওরা চট করে যেকোনো সমস্যার সমাধান বের করে ফেলে।

তাই রাজা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রামের যে কয়জনের চোখে তিল, ওরা নিশ্চয় নিজেরাই হিসাবনিকাশ করে বের করে ফেলবে এবং কথামতো গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।

পরদিন সবাই কাজে বের হলো। সবার সঙ্গে সবার দেখা হলো। সবাই সবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল তিল আছে কি না, কয়জনের চোখে তিল ইত্যাদি। তারপর প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যায় স্বাভাবিকভাবেই ওরা ঘরে ফিরে গেল।

কিন্তু পরদিন কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে গেল না। এতে অবশ্য গ্রামের লোকজন কেউ অবাক হলো না। ওরা তো দেখেছে কয়জনের চোখে তিল। তাই ভাবল যাদের চোখে তিল, সময়মতো ওরা ঠিকই বুঝতে পারবে এবং তার পরদিন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু পরদিনও কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে গেল না। কেউ অবাকও হলো না। রাজারও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এভাবে চার দিন চলে গেল। কারও গ্রাম ছাড়ার লক্ষণ নেই। লোকজনও নির্বিকার।

কিন্তু চার দিনের পর খুব ভোরে একসঙ্গে কয়েকজন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল এবং রাজা ও গ্রামবাসী মোটেও অবাক হলো না। তাদের কাছে সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

প্রশ্ন হলো কয়জনের চোখে তিল ছিল এবং কয়জন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। কেন ওরা প্রথম, দ্বিতীয় বা তার পরদিন গেল না। কেন চার দিন পর গেল। সবচেয়ে বড় কথা, কেন একই দিনে সবাই একসঙ্গে চলে গেল, কেন আগে-পরে গেল না। আবার এটাও এক প্রশ্ন, প্রথম চার দিন ধরে কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে না গেলেও রাজা বা গ্রামের অন্য লোকজন কেন অবাক হলো না।

এতগুলো প্রশ্নের উত্তর বের করা সহজ নয়। কিন্তু সম্ভব। একটু মাথা খাটালেই সব রহস্য বের হয়ে আসবে। এটা গণিতের একটি বিশেষ ধাঁধা। সহজে বোঝা যায় না এখানে গণিতের কী আছে। গণিত জানলে মাথা খাটানো যায়। এটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

গণিতের এই চমত্কার ধাঁধাটি প্রথম পড়েছি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ম্যাথম্যাজিক নামের একটি বইয়ে। অবশ্য ইন্টারনেটেও এ ধরনের ধাঁধা রয়েছে (দেখুন https://goo.gl/TXSEo2)। এসব লেখার আলোকেই এই ধাঁধা। আমরা এই ধাঁধার সমাধানের জন্য গণিতের বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সূত্র রাজা নিজেই দিয়েছেন। তিনি প্রথমেই বলে দিয়েছেন, অন্তত একজনের চোখে তিল আছে। সেখান থেকেই আমরা শুরু করতে পারি।

প্রথমে আমরা ধরে নিই ওই গ্রামে মাত্র একজনের চোখে তিল ছিল। মনে করি একমাত্র ক-এর চোখে তিল আছে। দেখা যাক তাহলে কী ঘটে।

রাজা যেদিন সভা করে সবাইকে কথাটা বললেন, তার পরদিন সকালে সবাই কাজে বের হয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের চোখ লক্ষ করবে। আগেই বলেছি, প্রতিদিন সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়। তাই সবাই বিশেষভাবে সবার চোখের দিকে তাকাবে। সবাই দেখবে, ক-এর চোখে তিল। কিন্তু ক লক্ষও করবে, অন্য কারও চোখে তিল নেই। সে তখনই বুঝে ফেলবে যে তার নিজের চোখেই তিল। কারণ, রাজা তো বলেছেন অন্তত একজনের চোখে তিল। সে অন্য কারও চোখে তিল না দেখে বুঝে ফেলবে একমাত্র তার নিজের চোখেই তিল। তাই পরদিন খুব ভোরে ক নীরবে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।

তাহলে বোঝা গেল যদি একজনের চোখে তিল থাকে, একদিন পর সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যদি দুজনের চোখে তিল থাকে, তাহলে কী হবে?

মনে করি ক ও খ-এর চোখে তিল। এবার এক মজার ব্যাপার ঘটবে। কারণ, প্রথম দিন সকালে উঠে সবাই দেখবে ক ও খ-এর চোখে তিল। কিন্তু ক দেখবে শুধু খ-এর চোখে তিল। অন্যদিকে খ দেখবে শুধু ক-এর চোখে তিল। তাই ক ধরে নেবে, পরদিন খুব ভোরে খ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, আর খ ভাববে ক চলে যাবে। সুতরাং দ্বিতীয় দিন ক ও খ-এর কেউই গ্রাম ছেড়ে যাবে না, কারণ ক ভাববে খ যাবে আর খ ভাববে ক যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন ক দেখবে খ যায়নি, আর খ দেখবে ক যায়নি, তখন দুজনেই একসঙ্গে উপলব্ধি করবে নিশ্চয়ই তাদের দুজনের চোখেই তিল, সে জন্যই ওরা দুজনেই গ্রামে রয়ে গেছে। তাই পরদিন ওরা দুজনে খুব ভোরে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। অর্থাত্ আমরা দেখছি, দুজনের চোখে তিল থাকলে এক দিন পর কেউ যাবে না, বরং দুই দিন পর খুব ভোরে একসঙ্গে ওরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।

একই যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে বলা যায় গ্রামে তিনজনের চোখে তিল থাকলে প্রথম তিন দিন কেউ গ্রাম ছেড়ে যাবে না, বরং তিন দিন পর খুব ভোরে একসঙ্গে তিনজন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।

এখন আমরা ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেছি। বলুন তো ওই গ্রামে কয়জনের চোখে তিল ছিল? খুব সোজা। ওই গ্রামে মোট চারজনের চোখে তিল ছিল। তাই প্রথম চার দিন কেউ যায়নি। চার দিনের পরদিন খুব ভোরে একসঙ্গে চারজন গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

কেন একসঙ্গে গেল? কেন আগে-পরে গেল না? এটাও এক বড় প্রশ্ন। ব্যাপারটা আমরা এভাবে দেখতে পারি। মনে করি ক, খ, গ ও ঘ—এই চারজনের চোখে তিল। এখন প্রথম দিন ক ভাববে খ, গ, ও ঘ-এর চোখে তিল। গণিতের পূর্ব বর্ণিত যুক্তি দিয়ে এটাও বুঝবে, তিন দিনের আগে ওদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না যে ওদের তিনজনের চোখেই তিল। সে ধরে নেবে, তিন দিন পর সকালে ওরা একসঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। এর আগে চলে না যাওয়ায় ক মোটেও অবাক হবে না। কিন্তু যখন দেখবে যে খ, গ ও ঘ চতুর্থ দিনও যায়নি, তক্ষুনি সে বুঝে ফেলবে যে তার নিজের চোখেও তিল, সে জন্যই অন্য তিনজন যায়নি। খ, গ ও ঘ—ওরা তিনজনও একই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবে। চার দিন পর ওরা একসঙ্গে চলে যাবে।

চার দিন পর্যন্ত কেউ চলে না যাওয়ায় রাজা বা অন্যরা কেন অবাক হয়নি? এটাও এক মজার প্রশ্ন। অবাক হয়নি, কারণ ওরা সবাই গণিতে পারদর্শী। ওরা তো সবাই দেখেছে ক, খ, গ ও ঘ—এই চারজনের চোখে তিল। তাই গণিতের পূর্ববর্ণিত যুক্তি দিয়ে বুঝে নিয়েছে, ওদের সবার চোখে যে তিল এটা বুঝতে চার দিন লাগবে ও এর আগে কেউ-ই যাবে না। তাই ওরা কেউ অবাক হয়নি।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত