করোনা প্রতিরোধে জিংক

জিংক সমৃদ্ধ ভাইরাসের আক্রান্তের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করেছবি: ইন্টারনেট

মানবদেহে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক খনিজ পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বয়স, লিঙ্গ, শারীরবৃত্তীয় অবস্থা (যেমন গর্ভাবস্থা) এবং অসুস্থতার ওপর ভিত্তি করে শরীরে খনিজ উপাদানগুলো বিভিন্ন পরিমাণে প্রয়োজন হয়। জিংক ঠিক তেমনই অতি প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। এর ওপর শরীরের চালিকা শক্তির প্রায় ১০ শতাংশ প্রোটিন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। এটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসেচক বা এনজাইম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তেমনি প্রভাবিত করে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে। শিক্ষা ও স্মৃতিশক্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন করে জিংক। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ের জিংক স্বল্পতায় ভোগে। জিংক স্বল্পতা স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের পথে অন্যতম বাধা। এ ছাড়া ক্ষুধামন্দা, স্বাদহীনতা, ত্বকের রোগ, প্রজনন ব্যাহত হওয়া ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার পেছনেও জিংকের ভূমিকা আছে।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিংকের ভূমিকা দুই ধরনের। জিংক ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ভাইরাস নিজেই নিজের যে প্রতিলিপি তৈরি করে তাতে বাধা দেয় জিংক।

শ্বেত রক্তকণিকা ও লিম্ফোসাইটস শরীরের দুটি মূল্যবান রোগপ্রতিরোধকারী কোষ। জিংক এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিপক্বতা, বিস্তার ও কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। জিংক স্বল্পতার কারণে শরীরে জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অ্যন্টিবডি যেমন সাহায্যকারী টি-সেল এবং ন্যাচারাল কিলার সেলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা রোগ ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ।

মেটালোথিওনিন (MT-প্রোটিন) নামের এক অঙ্গাণু কোষের বহিঃস্থ এবং অন্তঃস্থ জিংকের পরিমাণ অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অঙ্গাণু আর্সেনিক ও পারদের মতো বিষাক্ত ধাতুগুলোকে হেভি মেটাল ডেটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের করে দেয়। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই MT-প্রোটিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণকালে জিংক নিজেই MT-জিনকে সক্রিয় করে MT-প্রোটিন উৎপন্ন করে। কোষে উপস্থিত জিংকের শতকরা ১৫ ভাগই এই প্রোটিনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং দেহের সাম্যাবস্থা বজায় রাখে। এর পাশাপাশি সংক্রমণকালে জিংক লিভারের সাহায্যে শরীরের নিজস্ব ভাইরাস প্রতিরোধক IFN-গুলোর মাত্রা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। যেমন জিংক IFN-α–এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় দশ গুণ।

গবেষণায় দেখা গেছে, জিংক আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। HSV, হেপাটাইটিস সি, ডেঙ্গি এমনকি এইচআইভি ভাইরাসের বিরূদ্ধেও জিংকের কার্যক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। সোয়াইন ফ্লু মহামারিতেও জিংক ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিংক মূলত চারটি উপায়ে কাজ করে। সরাসরি ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে, ভাইরাসের আবরণ বিমুক্তকরণে বাধা দেয়, ভাইরাসের জিনের প্রতিলিপিকরণে বাধা দেয় এবং ভাইরাসের প্রোটিন মেশিনারিকে অকেজো করে।

করোনার বিরুদ্ধেও জিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিজের প্রতিলিপি তৈরি বা বংশবৃদ্ধি করতে করোনাভাইরাস আরএনএ-পলিমারেজ (RdRp) নামের এনজাইমের সাহায্য নেয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মুক্ত আয়নিক জিংক (Zn2+) মানব কোষের ভেতরে গিয়ে এই RdRp এনজাইমকে তার mother RNA-এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে বাধা দেয়। সুতরাং ব্যাহত হয় করোনার প্রতিলিপিকরণ প্রক্রিয়া। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, Zn2+ ও জিংক আয়োফোর পিরিথিন প্রয়োগ করলে সার্স কোভ-২-এর প্রতিলিপি তৈরির প্রক্রিয়া আরও সফলভাবে ব্যাহত হয়। শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণকারী আরেকটি ভাইরাস RSV। এর বিরুদ্ধেও জিংকের ভূমিকা অনেক শক্তিশালী। দেখা গেছে জিংকের প্রতিলিপি তৈরির প্রক্রিয়া প্রায় এক হাজার গুণ হ্রাস করে।

করোনাভাইরাস মূলত মানব কোষের ACE-2 প্রোটিন রিসিপ্টরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শ্বাসযন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া। এতে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের মাধ্যমে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও জিংক চারভাবে সুরক্ষা দেয়। জিংক ফুসফুসের স্পন্দনমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে ভাইরাস শ্লেষ্মা দ্রুত অপসারণ করে। জিংক ফুসফুসে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট কার্যকলাপ বাড়ায়, ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে উচ্চমাত্রায় IFN-α উৎপাদনের মাধ্যমে শরীরের নিজস্ব ভাইরাসবিরোধী প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং NF-κB প্রোটিন থেকে সৃষ্ট ক্ষতিকর সাইটোকাইন স্ট্রম বা সাইটোকাইন ঝড় সংগঠনে বাধা দেয়। বিস্তারিত ছবিতে দেখুন।

ভাইরাস দমনে ও ফুসফুসের সুরক্ষায় জিংকের ভূমিকা

শুরুতে যদিও বলা হচ্ছিল যে SARS-CoV-2 শুধু প্রাপ্তবয়স্কদেরই আক্রমণ করছে। কিন্তু পরে দেখা যায়, শিশুরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছে। রাশিয়াতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের ওপর এক গবেষণা চালানো হচ্ছে। শিশুদের করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে শরীরের জিংকের ঘাটতির সম্পর্ক কেমন তা দেখা হচ্ছে সেই গবেষণায়। ইতিপূর্বেও সাধারণ নিউমোনিয়ার ওপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল। শতকরা ৮০ ভাগ নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর রক্তরসে জিংকের একটা তীব্র ঘাটতি থাকে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সম্পূরক হিসেবে জিংক প্রয়োগের ফলে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ২০ শতাংশ কমানো গেছে। যেহেতু কোভিড-১৯ ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টিকারী একধরনের ভাইরাল নিউমোনিয়া। তাই এসব তথ্য–উপাত্ত গবেষকদের একটা স্পষ্ট ধারণা দিচ্ছে শিশুদের সংক্রমণ প্রতিরোধে জিংক বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ প্রাণীজ আমিষ থেকে বঞ্চিত। এই আমিষ জিংকের অন্যতম প্রধান উৎস। মহামারির এই ক্রান্তিলগ্নে শিশু থেকে বয়স্ক সবারই উচিত অন্যান্য ভিটামিনের পাশাপাশি নিয়মিত জিংকসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। মাংস, ডিম, মাশরুম, বাদাম, দুগ্ধজাত খাবার, ছোলা, মটরশুঁটি, মসুর, কুমড়া, তিল ও লাউয়ের বীজ ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিংক রয়েছে। যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা এর লক্ষণ যাচ্ছে, তাঁদের উচিত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সহনশীল মাত্রায় জিংকের একটি সাপ্লিমেন্টও নিতে পারেন।

লেখক:

আশীষ দাস, পিএইচডি গবেষক (বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলো), প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ এইচ এম নুরুন নবী, অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়