মহাবিশ্বের প্রথম মৌল

মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় ৯০ শতাংশ হাইড্রোজেন, যার গল্পটা শুরু অন্য সব পদার্থের আগে। বিগ ব্যাংয়ের ৩ লাখ ৭৯ হাজার বছর পরে। যখন অত্যন্ত উত্তপ্ত, ঘন ও প্লাজমা অবস্থার প্রোটন, ইলেকট্রন ও ফোটন ঠান্ডা হচ্ছিল এবং মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন ইলেকট্রন আর প্রোটন একত্র হয়ে তৈরি হলো হাইড্রোজেন।

এভাবে পেরোল ৪০ লাখ বছর। হাইড্রোজেন গ্যাসের মেঘ মহাকর্ষের টানে কোথাও কোথাও একত্র হলো। তাদের সংঘর্ষে উত্পন্ন হলো তাপ। জন্ম হলো প্রথম নক্ষত্র। যে ঘটনা না ঘটলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে ঠান্ডা হয়ে যেত। তাপমাত্রা হতো ২ দশমিক ৭ কেলভিন। প্রাণ বেঁচে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতিই আসত না। আরও ভয়ংকর হতো, মহাবিশ্বে শুধু হাইড্রোজেন আর অল্প কিছু হিলিয়াম ও লিথিয়ামই থাকত, তৈরি হতো না অন্য কোনো পদার্থ। এরপর তারাদের নিয়মিত জন্ম হয়েছে হাইড্রোজেন মেঘ থেকে। তাদের সংঘর্ষে তৈরি হওয়া তাপে শুরু হয়েছে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। হাইড্রোজেন থেকে তৈরি হলো হিলিয়াম। এরপর অন্য সব পদার্থ।

হাইড্রোজেনের জগতে এরপরের আমাদের জানা গল্পটা ৪৪০ কোটি বছর আগে। যখন পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমে হয়েছে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। ডাই-হাইড্রোজেন অক্সাইড বাষ্প থেকে তরল হতে শুরু করল। যাকে আমরা এখন বলি পানি। পৃথিবীর প্রাণের প্রধান শর্ত।

মহাবিশ্বের এই যে ৯০ শতাংশই হাইড্রোজেন, এর প্রয়োজন ছিল। যেমন আমাদের শরীরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরমাণুই হলো হাইড্রোজেন। পর্যায় সারণির প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের নানান গুণ আছে। কিন্তু প্রধানতম বৈশিষ্ট্য সম্ভবত তা শক্তির এক অফুরন্ত আধার। পৃথিবীর শক্তির প্রধান উত্স সূর্য। সেই সূর্য কিন্তু শক্তি পাচ্ছে হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম বানিয়ে। সেই সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছিল হাইড্রোজেনে পূর্ণ। তখন পৃথিবীতে একধরনের ব্যাকটেরিয়াল এনজাইম ছিল, যাদের নাম হাইড্রোজিনেস। এরা হাইড্রোজেন অণু বা পানি থেকে শক্তি উত্পন্ন করত। সেই থেকে প্রাণের হাইড্রোজেনের শক্তি ব্যবহার শুরু। তেমন কিছু অণুজীব এখনো দেখা যায় পৃথিবীতে।

বিজ্ঞানী ফন হেলমন্ট প্রথম আবিষ্কার করেন, হাইড্রোজেন বাতাসে পুড়তে পারে। ১৬৭১ সালে রবার্ট বয়েল দেখলেন, অ্যাসিডের মধ্যে লোহার টুকরা ফেললে তা থেকে গ্যাস বের হয়। এরপর ক্যাভেন্ডিস দেখলেন, এই গ্যাস অন্য সব গ্যাস থেকে আলাদা। এর নাম দিলেন অদাহ্য বাতাস। এই অদাহ্য বাতাস অক্সিজেনে পোড়ালে তৈরি হয় পানি। তত দিনে কি ন্তু পানির গুরুত্ব সবাই জানত। এই আবিষ্কার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৭৮৩ সালে ল্যাভয়সিয়ে এই অদাহ্য গ্যাসের নাম দিলেন হাইড্রোজেন (Hydro-gen) বা পানি উত্পাদক।

উল্টো দিকে ১৮০০ সালে নিকলসন ও কারলাইল তড়িত্ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পানি ভেঙে উত্পন্ন করলেন হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। হাইড্রোজেন উত্পন্ন করতে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এই কাজটাই করেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের মূল লক্ষ্য যত কম বিদ্যুত্ বিল দিয়ে তা করা যায়। বর্তমানে ব্যবহূত হয় আলোক-রাসায়নিক ক্রিয়া।

উত্পন্ন হাইড্রোজেন গ্যাস চমত্কার শক্তির উত্স। খুবই হালকা। জ্বালানি হিসেবে একেবারে আদর্শ। একদিক দিয়ে এর চমত্কারিত্ব অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। জ্বালানি হিসেবে অক্সিজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেন পোড়ালে উত্পন্ন হয় পানি। পরিবেশের ওপর তাই কোনো খারাপ প্রভাবই পড়ে না, অন্য জ্বালানির ক্ষেত্রে যা এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। মানুষ যখন প্রথমে বেলুনে করে আকাশে উড়েছিল ১৭৮৩ সালে, তখন তাতে ব্যবহার করেছিল হাইড্রোজেন। দুই শ বছর পরে মহাকাশে যাওয়ার রকেটের জ্বালানিও ছিল হাইড্রোজেন। আক্ষরিক অর্থেই হাইড্রোজেনে ভর করে মানুষ অজানার উদ্দেশে ছুটেছে।

১৯৭০ সালে ফিলিপস রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কার হলো যে ধাতুর ওপর হাইড্রোজেন শোষণ করে তা হাইড্রাইড হিসেবে আলাদা করা সম্ভব। এ আবিষ্কার তড়িত্ রাসায়নিক হাইড্রোজেন ব্যাটারির নতুন অধ্যায় খুলে দিল। ১৯৯৭ সালে জাপানে প্রথম নিকেল-ধাতব-হাইড্রাইড ব্যাটারির গাড়ি রাস্তায় নামে। দিন দিন উত্কর্ষ বাড়তে লাগল হাইড্রোজেন-অক্সিজেন ফুয়েল সেলের। এমনিতে সাধারণ ব্যাটারিতে কঠিন পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ইলেকট্রন। ফুয়েল সেলে কঠিন পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় প্রোটন। আস্তে আস্তে এই প্রোটন পরিবাহীর সক্ষমতাও বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা পৌঁছে গেলেন ১৮৭৪ সালে লেখা জুল ভার্নের গল্প ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’-এর জ্বালানির কাছাকাছি। যে জ্বালানি হবে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের, আলো আর তাপের অফুরন্ত উত্স।

পারমাণবিক (H) ও আণবিক (H2) হাইড্রোজেন অন্য সব অণু ও পরমাণুর চেয়ে সরল। তাই তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিকস আবিষ্কারের পর থেকে গত শতাব্দীজুড়ে হাইড্রোজেনকে ব্যবহার করেছেন মডেল হিসেবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল মডেল এবং ধারণাগুলো তাই অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে হাইড্রোজেনের ওপর।

রসায়নে হাইড্রোজেনের অবস্থান অনন্য। এর জারণ অবস্থা হতে পারে -১ (হাইড্রাইড), ০ (পারমাণবিক) বা +১ (প্রোটন)। প্রতিটি জারণ অবস্থার জন্য রয়েছে একদমই আলাদা সব ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য। এমনিতে আণবিক হাইড্রোজেন (H2) প্রায় নিষ্ক্রিয় পদার্থ। বেশি দিন আগে নয়, ১৯৮৪ সালে কুবাস দেখান যে হাইড্রোজেন অবস্থান্তর মৌলের সঙ্গে সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন গঠন করতে পারে। অন্যদিকে H- (হাইড্রাইড) অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষার ও বিজারক। আবার H+ (প্রোটন) হলো শক্তিশালী অ্যাসিড ও জারক। আসলে অ্যাসিড আর ক্ষারের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার অন্যতম একটা ভিত্তি হাইড্রোজেন। ব্রনস্টেড-লাউরি তত্ত্ব অনুযায়ী অ্যাসিড ক্ষারের বিক্রিয়া হলো প্রোটন (H+) আদান-প্রদানের বিক্রিয়া।

পর্যায় সারণির প্রথম মৌল বা মহাবিশ্বের প্রথম মৌল অথবা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা মৌল হিসেবেই শুধু হাইড্রোজেনের গুরুত্ব নয়, এই মুহূর্তে আমাদের পৃথিবীর সাসটেইনেবল জ্বালানির এক বড় ভরসার নাম হাইড্রোজেন। ভবিষ্যতে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে হাইড্রোজেনের।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার কেমিস্ট্রি, ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় ওজসিয়েক গ্রোশালার লেখা অবলম্বনে