কান আর মাথার তেলেসমাতি

সংখ্যার সৌন্দর্যস্মিথসনিয়ান ম্যাগ ডট কম

গণিতের শুরু সংখ্যা থেকে। আর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে গণিতের কান্নাও শুরু হয় সংখ্যা গণনা থেকেই। গণিতের এই কান্না হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্যের সমান বয়সী। আজকের বড়রাও এই কান্নার শরিক ছিলেন একদিন। কিন্তু ভুলোমনা বাঙালীর কোনো পীড়াদায়ক স্মৃতিই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

সংখ্যা গণনার এই পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতার কথা ভোলেননি গণিতের অধ্যাপক আজিজর রহমান খলিফা। তিনি শিশুদের কান্না শুনতে পেয়েছিলেন বড় হয়েও। শুনুন তাঁর ভাষায়-

একজন ইংরেজ ছেলেকে অঙ্কে লিখতে বলা হল forty-one; সে forty শুনে forty -এর 4 বসাল এবং one -এর 1 লিখে, শেষ করে ফেলল। তাকে লিখতে বলা হল forty-nine। স্বাভাবিকভাবেই সে forty শুনে সে বসাল 4 এবং তারপর nine শুনে 9 বসিয়ে 49 লিখে ফেলেছে।

ঠিক ওই দুইটি সংখ্যা লিখতে বাঙালি ছেলেটি কী করল? একচল্লিশ শুনে এক-এর জন্য ১ এবং চল্লিশ এর জন্য ৪ অর্থাৎ ১৪ (চৌদ্দ) লিখে বসল। আর ঊনপঞ্চাশ লিখতে বলাতে সে পঞ্চাশ শুনে ৫ লিখেছে। কিন্তু ঊন-এর জন্য কী লিখবে সে ভেবেই পাচ্ছে না। ঊন এর জন্য যদি সে ৯ লেখে তবুও তার হবে না।

ইংরেজ ছেলেটির কাছে বিষয়টি একেবারে শ্রুতিলিখন বা dictation এর মত সহজ, সরল। ঠিক যেমন 'আমি গণিত শিখেছি' লিখতে বললে সে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি, গণিত শিখেছি শব্দগুলি পরপর লিখে শেষ করে দেবে। ঠিক সেই রকমই forty-nine শোনামাত্র সে forty-এর জন্য 4 এবং তারপর nine বসিয়ে 49 লিখে শেষ করে ফেলবে। ঠিক অবিকল শ্রুতি-লিখন বা dictation-এর মত। কিন্তু বাঙালি ছেলের কাছে এটা একটা প্রাণান্তকর সমস্যা।

একবার ভাবুন, অঙ্কে বায়ান্ন লেখার কথা, fifty-two। ইংরেজ ছেলেটি অতি সহজেই শ্রুতিলিখনের মত লিখবে fifty'র জন্য প্রথমে 5 এবং two'র এর জন্য পরে বসাবে 2; চটপট লিখে ফেলবে 52। বাংলায় বাহান্ন কথাটি শুনে বাঙালি ছাত্রটি কী লিখবে? fifty two-এর fifty, two পদ দুইটি ইংরেজ ছাত্রটিকে বলে দিচ্ছে তাকে কী লিখতে হবে। আর বাংলা বায়ান্ন কথাটির ভেতর এমন কিছুই নেই, যার বাঙালি ছেলেটি কি লিখতে হবে, তা সহজে স্থির করতে পারে।

যেমন হতে পারে শতকিয়ার ঊচ্চারণ
লেখক

সমস্যাটি সার্বজনীন। আমার, আপনার এবং আমাদের সকলের। একটু ধৈর্য ধরে পড়লেই বুঝতে পারবেন। লেখাপড়া শিখতে হলে বা শেখাতে হলে, সবার আগেই এই প্রাথমিক সমস্যাটি সামনে চলে আসে। ছেয়েমেয়ে, মাতাপিতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন বা তাদের অভিভাবক, সকলের জন্যই এটা জটিল সমস্যা।

ছেলেমেয়েদের গণিত শিক্ষায় প্রথম পদক্ষেপ হল শতকিয়া সংখ্যা লিখন ও পঠন। ২১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত শতকিয়া সংখ্যাগুলি লিখতে ও পড়তে ইংরেজ, পার্শিয়ান দেশী শিক্ষার্থীদের কোনও কষ্টবোধ হয় না। তাদের ভাষায় সংখ্যা ও গঠনপদ্ধতি স্বাভাবিক এবং এজন্য সমস্ত জিনিসটাই তাদের কাছে mechanical কলের কাজের মত। সহজ-সরল, কোথাও ভাববার কিছু নিই। ওই সংখ্যাগুলি লেখা বা পড়া, তাদের কাছে মোটেও কোন সমস্যা নয়।

অন্যদিকে বাংলাভাষায় এই সংখ্যাগুলির গঠনপদ্ধতি অমার্জনীয়ভাবে কৃত্রিম ও অবৈজ্ঞানিক। ফলে এগুলি লিখতে-পড়তে আমাদের বাঙলী ছেলেমেয়েদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনবরত লিখে লিখে বা মুখস্ত করে, অমানুষিক পরিশ্রম করার মাধ্যমে এবং অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে তাদের এগুলি আয়ত্ত করতে হয়। আর এজন্য গোড়া থেকেই আমাদের ছেলেমেয়েদের ভেতর একটা ভুল ধারণা সাধারণভাবেই গড়ে—ওঠে গণিত একটি ভীষণ কঠিন বিষয়।

খুব একটা সাধারণ এবং স্বাভাবিক বিষয় আমাদের অমনোযোগিতা বা হঠকারিতার ফলে হয়ে উঠেছে একটি ভয়ানক সমস্যা। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এই শতকিয়া লিখন-পঠনের পেছেনে যে সময় ব্যয় করে, বহির্বিশ্বের সৌভাগ্যবান ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সময়ে অনেক কিছু শিখে ফেলে এবং শিক্ষার পথে অনেকটা এগিয়ে যায়।

শিক্ষার্থীদের এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে জনাব খলিফা ৪১, ৪২, ৪৩,..., ৪৯ কে যথাক্রমে চল্লিশ-এক, চল্লিশ-দুই, চল্লিশ-তিন, ..., চল্লিশ-নয়, পড়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তখনকার অনেক সাহিত্যপ্রেমী জ্ঞানী-গুণী ভাষার সতীত্ব রক্ষার প্রবল তাড়না থেকে খলিফার এই প্রস্তাব অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন।

প্রকৃত অর্থে প্রচলিত সংখ্যা গণনার রীতিটি যে কেবল পরিশ্রমসাধ্য ও অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, আমার মতে, এটি একটি ভুল পদ্ধতিও বটে। গণিতে সংখ্যা গণনার যে ধারাবাহিকতা রয়েছে, এখানে কেবল সেই ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এছাড়া এতে গণিতের মূলভাবও লঙ্ঘিত হয়েছে।

গণিতের কিংবা সংখ্যার প্রধান কাজই হলো গুণবাচক শব্দকে পরিমাণবাচক রাশিতে পরিণত করা। বাংলার এই সংখ্যাগণনা রীতিতে গণিতের সেই মূল উদ্দেশ্যটিই ব্যহত হচ্ছে। যেমন, ঊনপঞ্চাশ, ঊনষাট, ঊনসত্তর—এই সংখ্যাগুলোর কথাই বলা যাক।

বাংলা ভাষায় ঊন শব্দের অর্থ কম। ঊন বা কম শব্দটি গুণবাচক। ঊনপঞ্চাশ শব্দের অর্থ পঞ্চাশের চেয়ে কম। কিন্তু কত কম? সেই পরিমাণ বোঝানোর উপায় নেই। পরিমাণের হিসাব অনুযায়ী ৪৯.৫-ও ঊনপঞ্চাশ কিংবা ৪৯.৭-ও ঊনপঞ্চাশ। কাজেই ঊনপঞ্চাশকে ন-পঞ্চাশ বা খলিফা নির্দেশিত পঞ্চাশ-নয় কিংবা অন্য কোনো যুৎসই নামে ডাকা প্রয়োজন।

আর যারা ভাষার সতীত্বে কথা বলছেন, তাদের জন্য বলি, 'ভাষার সতীত্ব' কথাটিই অর্থহীন । মানুষের প্রয়োজনে ভাষার জন্ম। আর মানুষের প্রয়োজনেই ভাষার পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা সংশোধন হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে ভাষা, গণনা, বর্ণ অনেক কিছুই বদলে গেছে। বাংলা ভাষায়ও কিছু যে বদলায়নি, তেমন নয়।

এই বিষয় নিয়ে একটি তর্কপ্রস্তাব উঠিয়েছিলাম দেশের এক বিশিষ্ট চিন্তকের সাথে। বললাম সংখ্যা গণনার রীতিটা সংশোধন করা দরকার। হঠাৎ গরম উনুনে হাত পড়লে যেমন ছ্যাত করে, আমার প্রস্তাব শুনে তিনিও ঠিক তেমনি ছ্যাত করে উঠলেন। পরে স্বভাবসিদ্ধ পাণ্ডিত্য নিয়ে বললেন, না না তা সম্ভব নয়। ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন: এগারো শব্দটি এমনি এমনি হয়নি। এগারো শব্দের অর্থ এক আরও। অর্থাৎ, দশের পরে এক আরও, তাই হলো এগারো।

আমি বললাম, তা ঠিক। এভাবে না হয় বারো, তের-রও একটা গতি করা যাবে। কিন্তু 'চৌদ্দ' তাহলে চোদ্দোরো হলো না কেন, কিংবা ষোলো কেন ষোয়ারো হলো না?

এবার তিনি চুপ মেরে রইলেন। কিন্তু তাতে ফায়দা হলো না কোনো পক্ষেরই। আর শিশুদের গণনার ক্লেশও তাতে কমল না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে শিশুদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছি। প্রচলিত সংখ্যা গণনার রীতি অনুযায়ী ৪১-৫০ পর্যন্ত গুণতে একজন শিশুর কয়েক দিন লেগে যায়। কিন্তু এর নামগুলো একটু বদলে এক-চল্লিশ, দুই-চল্লিশ, তিন-চল্লিশ, চার-চল্লিশ, পাচ-চল্লিশ, ছয়-চল্লিশ, সাত-চল্লিশ, আট-চল্লিশ, ন-চল্লিশ, পঞ্চাশ এভাবে শেখালে একবার শুনলেই শিশুদের তা মনে থাকে। বিশ্বাস না হলে আপনি নিজে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

৩১ কে এক-ত্রিশ, ৪১-কে এক-চল্লিশ বলা বৈধ হলে ৫১-কে এক-পঞ্চাশ বলা কেন বৈধ হবে না?

বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে বৈকি!

এই লেখার সঙ্গে আপনি ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন। কিন্তু তাতে শিশুদের গণিত শেখার পথ সুগম হবে না। শিশুদের এই গুরুতর সমস্যাটির কথা মন দিয়ে, দরদ দিয়ে অনুধাবন করা জরুরি। এরপর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি। নইলে শিশুদের গণিতভীতি দূর করা প্রায় অসম্ভব।

লেখক: শিক্ষক ও গণিত বিষযক লেখক