কোয়ার্কদ্রষ্টা মারে গেল–মান

মারে গেল-ম্যানগেল-ম্যানের প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

এই বছরের মে মাসে প্রফেসর মারে গেল–মান মৃত্যুবরণ করলেন, তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০। পল ডিরাক, শিনিচিরো তোমোনাগা, জুলিয়ান সুইংগার, রিচার্ড ফাইনম্যানের মতো বিজ্ঞানীরা যেমন করে কোয়ান্টাম তড়িৎবলবিদ্যাকে (quantum electrodynamics বা QED) গড়ে তুলেছিলেন, সেই ঐতিহ্যের পথ ধরেই মারে গেল–মান, ইয়োচিরো নামবু প্রমুখ তাত্ত্বিকদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল কোয়ান্টাম বর্ণবলবিদ্যা (quantum chromodynamics বা QCD)। ফাইনম্যান ও মারে গেল–মান একই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেক ইনস্টিটিউটে পাশাপাশি অফিসে কাজ করতেন, দুজনে প্রথমে একসঙ্গে কিছু গবেষণা করলেও তাঁদের ব্যক্তিগত অহম এক অর্থে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। এই দ্বন্দ্বে মারে গেল-মানের প্রতিভা ও অর্জন কোনো অংশেই ফাইনম্যানের চেয়ে কম ছিল না, কিন্তু ফাইনম্যান যেভাবে বিজ্ঞানকে ফাইনম্যান লেকচার সিরিজ দিয়ে ছাত্রদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিংবা ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম দিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের কণাদের মিথস্ক্রিয়াকে বর্ণনা করা সহজ করে দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তার সঙ্গে গেল–মানের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ ছিল না। অথচ গেল–মানের কাছে আমরা পেয়েছি প্রকৃতির অন্যতম ভিত্তিভূমি সবল মিথস্ক্রিয়া, যা কি না পরমাণুর মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনদের একসঙ্গে ধরে রাখে, পেয়েছি কোয়ার্কের মতো মৌলিক ধারণা, যা দিয়ে অতিপারমাণবিক কণার পর্যায় সারণি তৈরি করা যায়। সেই অর্থে মারে গেল–মান ছিলেন আধুনিক যুগের দিমিত্র মেন্দেলিভ।

মারে গেল–মানের Eight-Fold Way (অষ্টাঙ্গিক পথ)। I3 অক্ষ হলো আইসোস্পিন, S স্ট্রেঞ্জনেস ও Q হলো তড়িৎ আধান।

১৯৪০ ও ’৫০–এর দশকে পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম ও বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে তড়িৎ আধানযুক্ত কণারা কীভাবে ফোটন বিনিময় করে একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সেটার একটা পূর্ণ চিত্র পেলেন; এটাই হলো কোয়ান্টাম তড়িৎবলবিদ্যা (QED)। নিউক্লীয় সবল ও দুর্বল মিথস্ক্রিয়া তখনো ছিল অজানা। উচ্চশক্তির কণাত্বরক যন্ত্রে তখন বিজ্ঞানীরা প্রচুর ক্ষণস্থায়ী কণার সন্ধান পাচ্ছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন না প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেকট্রনের সঙ্গে সেগুলোর সম্পর্ক কী। তবে তাঁরা ধারণা করছিলেন, তড়িৎচুম্বকীয় বলের বাইরে অন্য বল দিয়ে এই কণাদের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জাপানি বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সালে একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে পায়ন নামে একটি অনুকল্পিত কণা বিনিময়ের মাধ্যমে প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৪৭ সালে মহাকাশ থেকে আগত কণাদের (কসমিক রে) মধ্যে পায়ন বা পাই মেসন কণা আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীকালে দেখা যাবে প্রোটন, নিউট্রন ও পায়ন কণারা সবাই কোয়ার্ক ও (গ্লুয়োন) দিয়ে গঠিত; প্রোটন ও নিউট্রন তিনটি কোয়ার্ক আর পায়ন দুটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। তিনটি কোয়ার্ক (বা বিজোড় সংখ্যার) সংবলিত কণাদের ব্যারিয়ন আর দুটি কোয়ার্কের (বা জোড়) কণাদের মেসন বলা হয়। ব্যারিয়ন ও মেসন মিলে তৈরি করে হ্যাড্রন পরিবার।

এরপরের বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে বুঝতে হলে আমাদের দুটি ধারণার প্রবর্তনা করতে হবে। এর একটি হলো আইসোস্পিন, অপরটি হলো স্ট্রেঞ্জনেস। আইসোস্পিনের ধারণাটা অনেকটা ইলেকট্রন স্পিনের মতোই, ইলেকট্রনের যেমন +১/২ ও -১/২ স্পিন থাকতে পারে, বিজ্ঞানীরা (হাইজেনবার্গ বোধ হয় প্রথম এটি ভাবেন) ধারণা করলেন প্রোটন ও নিউট্রন একটি কণারই দুটি রূপ। কণার আইসোস্পিন +১/২ হলে প্রোটন ও -১/২ হলে সেটি হবে নিউট্রন। এখানে স্পিন বা ঘূর্ণন ধ্রুপদি বলবিদ্যার ঘূর্ণন নয়, অর্থাৎ আমরা প্রতিনিয়ত যে ঘূর্ণনের সঙ্গে পরিচিত সে রকম নয়, বরং এটা কণার অন্তর্নিহিত কোনো একটা বৈশিষ্ট্য, যাকে দৃশ্যত বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

SU(3) গ্রুপের মৌলিক গ্রুপ হলো ওপরের ত্রিভুজটি। এখানে I অক্ষ হলো আইসোস্পিন ও S স্ট্রেঞ্জনেস। এই গ্রুপটি ব্যবহার করে দিয়ে চিত্র ২–এর ষড়্‌ভুজ বা চিত্র ৪–এর বৃহত্তর ত্রিভুজটি সৃষ্টি করা সম্ভব।

কণাত্বরক যন্ত্রে আবিষ্কৃত কণাদের তালিকা তৈরি করে মারে গেল–মান আইসোস্পিনের মতো আর একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন। তিনি এর নাম দিলেন স্ট্রেঞ্জনেস (strangeness)। যদি কোনো কণা প্রোটনে রূপান্তরিত হয় তবে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে –১, অ্যান্টি বা পরাপ্রোটনে (প্রতিপ্রোটন) রূপান্তরিত হলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে +১। কোনো স্ট্রেঞ্জ কণা অন্য একটি স্ট্রেঞ্জ কণায় রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নিলে (১০-১০ সেকেন্ড) তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে বেশি -২, কম সময় (১০-২৪ সেকেন্ড) নিলে তার স্ট্রেঞ্জনেস হবে -১। এখন আমরা জানি সবল মিথস্ক্রিয়ায় কণাদের স্ট্রেঞ্জনেস নম্বর সংরক্ষিত হয়, দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় হয় না।

গেল–মান স্ট্রেঞ্জনেস ও আইসোস্পিনের ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি চিত্র সাজালেন, প্রতিটি চিত্রে আটটি করে কণা স্থান পেল (চিত্র ২)। তিনি ভাষা, দর্শন, সংগীত, প্রত্নতত্ত্বে খুবই উৎসাহী ছিলেন, তাই এই অষ্টকণার সম্মেলনকে বৌদ্ধ প্রথা অনুযায়ী নাম দিলেন eight-fold way, যার বাংলা হলো অষ্টাঙ্গিক পন্থা। ২ নম্বর চিত্রটিকে আমাদের একটু সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। যেহেতু কোয়ার্কের ধারণা তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমরা চিত্রটিতে প্রথমে কোয়ার্কের চিহ্নগুলো অগ্রাহ্য করব। চিত্রে সর্বমোট তিনটি অক্ষ দেখানো হয়েছে­ I3 দিয়ে আইসোস্পিন, S দিয়ে স্ট্রেঞ্জনেস ও Q দিয়ে তড়িৎ আধান। উদাহরণস্বরূপ প্রোটনের স্ট্রেঞ্জনেস ০, আইসোস্পিন হলো ১/২ এবং তড়িৎ আধান +১, অন্যদিকে – কণার স্ট্রেঞ্জনেস হলো ২, আইসোস্পিন -১/২ ও তড়িৎ আধান -১। চিত্রে দুটি কণার ও এর স্ট্রেঞ্জনেস ১, আইসোস্পিন ০ ও তড়িৎ আধান ০; তারা স্থান পেয়েছে ষড়্‌ভুজের কেন্দ্রে। চিত্রটি নিশ্চয় প্রকৃতির মধ্যে কোনো গভীর প্রতিসাম্য নির্দেশ করে, কিন্তু এর অর্থ উদ্ধার করতে গেল–মানের একটু সময় লাগল। ক্যালটেকে একজন গণিতের অধ্যাপকের কাছে তিনি লি গ্রুপের প্রতিসাম্যর কথা শুনলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নরওয়ের গণিতবিদ Sophus Lie এমন একটি গ্রুপ তত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে Special Unitary SU(3) নামে একটি গ্রুপ পাওয়া যায়; SU(3) দিয়ে গেল–মান তাঁর অষ্টাঙ্গিক পথের রহস্য উদ্‌ঘাটন করলেন।

গেল–মান দেখলেন যদিও SU(3) দিয়ে কণাদের ৮টি (চিত্র ২) বা ১০টি (চিত্র ৪) প্রতিরূপে সাজানো যাচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে সহজ যে প্রতিরূপ—একটি ত্রিভুজ—সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ SU(3)–তে ত্রিভুজ একটি মৌলিক গ্রুপ। গেল–মান ভাবলেন এই ধরনের ত্রিভুজ পাওয়া যাবে, যদি আমরা কোয়ার্ক নামে একধরনের কণা চিন্তা করি, যাদের তড়িৎ আধান পূর্ণ সংখ্যা নয়। তিনি তিন ধরনের কোয়ার্কের কথা চিন্তা করলেন আপ (u), ডাউন (d) ও স্ট্রেঞ্জ (s)। (কীভাব গেল–মান কোয়ার্ক নামটা পেলেন, সেটাও একটা ইন্টারেস্টিং কাহিনি, সময়ের স্বল্পতা হেতু সেটা পরবর্তীকালের জন্য তুলে রাখা হলো)। এদের তড়িৎ আধান হবে যথাক্রমে +২/৩, -১/৩ ও -১/৩, ও অন্যদিকে আইসোস্পিন সংখ্যা হবে +১/২, -১/২ ও ০। ৩ নম্বর চিত্রে এই ত্রিভুজ গ্রুপটি দেখানো হলো। এই মৌলিক গ্রুপটি ব্যবহার করে খুব সহজেই অষ্টাঙ্গিক পথ বা ৪ নম্বর চিত্রের বৃহত্তর ত্রিভুজটি গঠন করা সম্ভব।

SU(3) দিয়ে ১০টি কণার যে প্রতিরূপ পাওয়া গেল তা গেল–মানকে একটি অনাবিষ্কৃত নতুন কণার ভাবিকথন করতে সাহায্য করল। ৪ নম্বর চিত্রটি যখন গঠিত হলো, তখনো নিচের শীর্ষের কণাটি আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯৬২ সালে গেল–মান বললেন এই অনাবিষ্কৃত কণাটির স্ট্রেঞ্জনেস হবে -৩, আইসোস্পিন ০ এবং তড়িৎ আধান -১। পাঠক ৪ নম্বর চিত্রটা একটু মনোযোগসহকারে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কেমন করে গেল–মান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। এই অনাবিষ্কৃত কণাটির নাম দেওয়া হলো ওমেগা মাইনাস , যেটি ১৯৬৪ সালে কণাত্বরক যন্ত্রে ধরা পড়ল। সবল মিথস্ত্রিয়ায় SU(3)-এর রূপরেখা ও কোয়ার্ক মডেল প্রতিষ্ঠিত হলো।

তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসই এমন যে এক্সপেরিমেন্ট ও তত্ত্ব যখন এমন জায়গায় পৌঁছায়, তখন তার ফলাফল নিয়ে ভাবার মানুষের অভাব হয় না। গেল–মান যখন অষ্টাঙ্গিক পথ ও SU(3)–র সঙ্গে সেটার সম্পর্ক আবিষ্কার করছিলেন প্রায় একই সময় ইউভাল নিমান নামের একজন ইসরায়েলি বিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। গেল–মান যখন কোয়ার্ক নিয়ে ভাবছিলেন প্রায় একই সময় জর্জ ৎস্ভিগ নামের এক রুশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী কোয়ার্কের ধারণা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরে প্রকাশিত হয়। ওয়াইগ নতুন কণাদের নাম দিয়েছিলেন এইস (ace)।

কোয়ার্কের ধারণা প্রবর্তন করার ফলে সমস্ত পারমাণবিক কণাগুলোর ধর্ম বোঝা সম্ভব হল। প্রোটন দুটি আপ (u) ও একটি ডাউন (d) কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত, এর ফলে তার আধান হবে +২/৩ + ২/৩ - ১/৩ = +১। আইসোস্পিন হলো +১/২ + ১/২ - ১/২ = +১/২। নিউট্রন একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত +২/৩ - ১/৩ - ১/৩ = ০ আধান ও +১/২ - ১/২ - ১/২ = -১/২ আইসোস্পিন। এই মডেলে মেসন কণারা, যেমন পাই মেসন বা মিউ মেসন দুটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে মধ্যম মানের ভারী কণারা, যেমন ইলেকট্রন, মিওন ও টাউ কণারা, যারা কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি নয়, তারা সবল মিথস্ক্রিয়া অংশগ্রহণ করে না, দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় করে। এদের লেপটন বলা হয়।

সমস্যা হলো, পাউলির বর্জন নীতি অনুযায়ী দুটি কণা একই কোয়ান্টাম দশায় থাকতে পারবে না। ৪ নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে ওমেগা মাইনাস তিনটি স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, এদের আইসোস্পিন, তড়িৎ আধান, স্ট্রেঞ্জনেস, সবই এক রকম। প্রোটনে অবস্থিত দুটি u কোয়ার্কেরও একই দশা। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে, ১৯৬৪ সালে, অসকার গ্রিনবার্গ নামে একজন মার্কিন বিজ্ঞানী বললেন কোয়ার্কদের তড়িৎ আধান, আইসোস্পিন ও স্ট্রেঞ্জনেস ছাড়াও আর একটি কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য আছে। গেল–মান এই দশাকে বর্ণ বা রং (colour) বলে অভিহিত করলেন। অবশ্য রং বলতে এখানে একটা কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যই বোঝানো হয়েছে, প্রকৃত রঙের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। একটি কোয়ার্কের লাল, নীল বা সবুজ রং থাকতে পারে। এই রংগুলো (যা কিনা আসলে রং নয়) হলো সবল মিথস্ক্রিয়ার আধান, অর্থাৎ তড়িৎ আধান ছাড়াও কোয়ার্কের বর্ণ আধান রয়েছে। কিন্তু প্রোটনের সামগ্রিকভাবে কোনো বর্ণ আধান নেই, তার মানে প্রোটনের মধ্যে যে তিনটি কোয়ার্ক আছে, তাদের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রঙে থাকতে হবে যেমন লাল, নীল ও সবুজ, যাতে তাদের মিশ্রিত বর্ণ সাদা বা আধানবিহীন হয়।

এখান থেকে শুরু হলো কোয়ান্টাম বর্ণবিদ্যার জয়যাত্রা। আপ, ডাউন ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ককে বলা হলো কণার স্বাদ (flavor) আর প্রতিটি স্বাদের কোয়ার্ক আবার রঙের অধিকারী। কণাদের স্বাদের আবার উল্টো বা প্রতিরূপ আছে, প্রতিআপ, প্রতিডাউন ও প্রতিস্ট্রেঞ্জ। আবার রংগুলোর উল্টো বা প্রতিরং আছে: প্রতিলাল, প্রতিসবুজ ও প্রতিনীল। SU(3)-এর প্রতিসাম্য অনুযায়ী লাল, সবুজ ও নীলকে যতি একটি সমবাহু ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষে বসানো হয় এবং ত্রিভুজটিকে ঘোরানো হয়, তবে QCD তত্ত্বের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ একটি লাল আপ কোয়ার্ককে একটি নীল আপ কোয়ার্ক থেকে আলাদা করা যাবে না। এই যে ঘূর্ণনের কারণে রঙের অবস্থান বদলাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না তার অর্থ হলো যে কোনো রং সবল মিথস্ত্রিয়ায় অপরিবর্তিত থাকবে, অর্থাৎ যে রংগুলো মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেবে, সেই রংগুলোই বের হয়ে আসবে। যেহেতু লাল, নীল বা সবুজ কোয়ার্ক বলতে গেলে একই জিনিস, সেটা একধরনের প্রতিসাম্য, যা কিনা একটি কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের সূচনা করে (স্থান ও সময়ের স্বল্পতাহেতু এই আলোচনাটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হলো)। এই ক্ষেত্রটি সৃষ্টি করে গ্লুয়ন নামে একধরনের বিনিময় কণা।

ফোটন যেমন তড়িৎচুম্বকীয় বলের মাধ্যম, সবল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম হলো গ্লুয়ন। ফোটন ও গ্লুয়ন দুটির ভরই শূন্য, দুটিরই তড়িৎ আধান শূন্য। অন্যদিকে গ্লুয়নের বর্ণ-আধান আছে, অর্থাৎ গ্লুয়ন কোয়ার্কের মতোই রং বহন করে। একটি গ্লুয়ন দুটি গ্লুয়নে ভেঙে যেতে পারে, আবার দুটি গ্লুয়ন একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে নতুন দুটি গ্লুয়ন সৃষ্টি করতে পারে, ফোটন এগুলো করতে পারে না। একটি গ্লুয়ন আবার একটি কোয়ার্ক ও একটি পরাকোয়ার্কে ভেঙে যেতে পারে, আবার একটি কোয়ার্ক ও একটি পরাকোয়ার্ক মিলিত হয়ে একটি গ্লুয়ন সৃষ্টি করতে পারে। এর মানে হচ্ছে একটি প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে শুধু যে তিনটি কোয়ার্কই আছে তা নয়, সেগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কোয়ার্ক-পরাকোয়ার্ক সৃষ্টি ও ধ্বংস হচ্ছে। ৬ নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে একটি সবুজ কোয়ার্ক সবুজ ও পরানীল গ্লুয়ন বিকিরণ করে একটি নীল কোয়ার্কে রূপান্তরিত হচ্ছে। অন্যদিকে একটি নীল কোয়ার্ক একটি সবুজ ও পরানীল গ্লুয়োন আত্মস্থ করে সবুজ কোয়ার্কে পরিণত হচ্ছে। সবুজ ও নীল আসছে এবং নীল ও সবুজে রূপান্তরিত হচ্ছে, রং সংরক্ষিত হচ্ছে। প্রতিটি গ্লুয়ন একটি রং ও একটি প্রতিরং দিয়ে তৈরি। এই বিক্রিয়ায় কিন্তু আপ কোয়ার্ক ডাউনে বা ডাউন কোয়ার্ক আপে রূপান্তরিত হচ্ছে না। কাজেই গ্লুয়ন কোয়ার্কের রংই শুধু বদল করে, স্বাদ নয়। স্বাদ বদলাতে হলে, অর্থাৎ আপকে ডাউন করতে বা ডাউনকে আপ, আমাদের দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হবে।

প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে কোয়ার্করা গ্লুয়োন ক্ষেত্র দিয়ে দিয়ে সংবদ্ধ থাকে, কিন্তু নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনরা আবদ্ধ থাকে পায়ন বিনিময় বা কোয়ার্ক-পরাকোয়ার্ক বিনিময় দ্বারা। ৭ নম্বর চিত্রে এ রকম একটা প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। সেখানে প্যাঁচানো রেখাগুলো গ্লুয়োনকে বোঝাচ্ছে। বলা যায়, পায়ন কণার বিনিময় গ্লুয়ন ক্ষেত্রেরই একটি দূরবর্তী প্রভাব। সবল মিথস্ক্রিয়ার কার্যকরী দূরত্ব খুব বেশি নয়, ১০-১৫ মিটার, একটি মাঝারি ধরনের নিউক্লিয়াসের আকারের সমান, এরপরে প্রোটনদের মধ্যে তড়িৎ বিকর্ষণ প্রাধান্য পায়। এই ধরনের তড়িৎ বিকর্ষণ ইউরেনিয়ামের মতো বড় নিউক্লিয়াসকে অস্থিত করে দেয় এবং তাদের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয় হয়।

কণাত্বরক যন্ত্রে খুব উচ্চ শক্তিসম্পন্ন পরীক্ষায়ও কোয়ার্কে আলাদাভাবে দেখা যায়নি। এর মূল কারণ হলো কোয়ার্করা গ্লুয়োনের ফ্লাক্স দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে, দুটি কোয়ার্ককে আলাদা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করলে সেই শক্তি থেকে নতুন এক জোড়া কোয়ার্ক তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে দেখা গেল কোয়ার্ক পরিবার শুধু আপ, ডাউন ও স্টেঞ্জের মধ্যে আবদ্ধ রইল না, চার্ম, টপ ও বটম কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হলো। কিন্তু সেই কাহিনি এখনকার জন্য নয়। ১৯৬৯ সালে মারে গেল–মান সবল মিথস্ক্রিয়া আবিষ্কারে তাঁর অবদানের জন্য এককভাবে নোবেল পুরস্কার পান।

মারে গেল–মান অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর বাবা–মা আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে এসেছিলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ২১ বছর বয়সে MIT থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। আমি এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ফাইনম্যানের সঙ্গে গেল–মানের তুলনা দিয়ে। ফাইনম্যানের ও গেল–মানের ব্যক্তিত্ব ছিল একেবারেই উল্টো, ফাইনম্যান কোনো লৌকিকতার ধার ধারতেন না, অন্যদিকে গেল–মান ছিলেন ফরমাল—সর্বদা স্যুট–টাই পরা—বুদ্ধিজীবী, যিনি একাধারে বিজ্ঞানী ও ভাষাবিদ, যিনি আমাদের কোয়ার্ক, স্ট্রেঞ্জনেস, রং ও গ্লুয়োনের মতো বিশেষ্য উপহার দিয়েছেন। মারে গেল–মানের হয়তো আক্ষেপ ছিল যে তাঁর নাম ফাইনম্যানের মতো জনপ্রিয় হয়নি, কিন্তু পদার্থবিদ্যায় শেষাবধি গেলমানের নাম দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তিনি প্রকৃতির মূল উপাদান কোয়ার্ক আবিষ্কার করেছিলেন।

লেখক: অধ্যাপক ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত