নোবেল পুরস্কার কি রুখে দেবে ‘হেপাটাইটিস সি’ কে?

হার্ভে অলটার, মাইকেল হটন এবং চার্লস রাইস (বাঁ থেকে) ২০২০ সালে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেননোবেল প্রাইস ডট ওআরজি

চলতি বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পাচ্ছেন তিনজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হার্ভে অলটার, মাইকেল হটন ও চার্লস রাইস। তাঁরা গবেষণা করেছেন মারাত্মক একটি রোগের জীবাণু নিয়ে। সেটি হলো হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। তাঁরাই ভাইরাসটিকে শনাক্ত করে এর বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম নির্ণয় করেছিলেন। উপযুক্ত ব্যক্তিদেরই এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও ইমিউনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইলি বার্নেস। তিনি বলেন, ‘এটি বিজ্ঞানের অন্যতম বড় আবিষ্কার। তাঁদের এই আবিষ্কার আমাদের পথ দেখিয়েছে। ফলে সম্ভব হয়েছে হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৭ কোটি লোক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ হেপাটাইটিস সি-র কারণে লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারে মারা যায়।

হার্ভে অলটার যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের গবেষক। ১৯৭০ সালে তিনি রক্ত আদান-প্রদানের মাধ্যমে হেপাটাইটিসের সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি প্রমাণ করেন, হেপাটাইটিস এ এবং বি ভাইরাস ছাড়াও তৃতীয় কোনো জীবাণু আছে, সেটি রক্তের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে শিম্পাঞ্জিতে হেপাটাইটিসের বিস্তার ঘটায়। সে সময় হটন গবেষণা করছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার এমারিভিলের কাইরন কর্পোরেশনে। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত শিম্পাঞ্জির দেহ থেকে এই ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান আলাদা করেন। পরে নিশ্চিত হন এটি ফ্লাভিভাইরাস গোত্রের সম্পূর্ণ নতুন একটি আরএনএ ভাইরাস। তাঁরা এই নতুন ভাইরাসের নাম দেন হেপাটাইটিস সি ভাইরাস।

ইলেকট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস
ছবি: কাভালিনি জেমস

মিসৌরির সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী চার্লস রাইস। তিনি ও তাঁর দল জিন প্রকৌশল ব্যবহার করে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জিনোমের একটি অংশ চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। সেটিই আসলে রোগের সৃষ্টির জন্য দায়ী।

একটি প্রেস কনফারেন্সে অলটার বলেন, এ রকম কাজ করা খুবই শ্রমসাধ্য ব্যাপার। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জিনোমের ক্ষুদ্র একটি অংশ ক্লোন করতে কাইরনের গবেষকদের ছয় বছর লেগেছিল। অথচ গবেষণার জন্য যদি কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ না করা হয়, তাহলে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া অনেক দুঃসাধ্য। তরুণ গবেষকদের জন্য এটি অনেক কঠিন।

কিছু গবেষক মনে করেছিলেন, জার্মানির হেইডেরবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট রাফ বার্টেন স্লেজার এবারের নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন। তিনি ল্যাবরেটরিতে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু নোবেল কমিটি উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই তিনি মনে করেন। অলটার বলেন, ‘এটি আসলেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি, তারা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেছেন, তা যথেষ্ট স্বচ্ছ।’

এর আগে হটন বিজ্ঞানবিষয়ক পুরস্কার নিয়ে অনেক সরব ছিলেন। বিশেষ করে প্রার্থী তালিকা সংক্ষিপ্ত হওয়া নিয়ে তাঁর ক্ষোভ ছিল। এমনকি ২০১৩ সালে তিনি সম্মানসূচক কানাডা গার্ডনার অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করেন। সেটির সম্মানী ছিল ১ লাখ কানাডিয়ান ডলার। প্রত্যাখ্যানের কারণ, গার্ডনার ফাউন্ডেশন তাঁর দুই সহযোগী কুই লিম চো এবং জর্জ ক্যুকে অ্যাওয়ার্ড দিতে রাজি হয়নি। ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব স্ট্রাসবার্গের ভাইরোলজিস্ট ও হেপাটোলজিস্ট টমাস বোমার্ট বলেন, হটন সব সময় তাঁর আবিষ্কারকে দলের অবদান ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু একটি নোবেল পুরস্কার সর্বোচ্চ তিনজনকে দেওয়া হয়। হটন বলেন, ‘নোবেল পুরস্কার সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যাপার। যদি আমি নোবেল প্রত্যাখ্যান করি, এটি খুব দম্ভের ব্যাপার হবে। যেহেতু তাদের নিয়মকানুন ও পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী হয়, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি না।’

এই তিন বিজ্ঞানী ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানীদের গবেষণা হেপাটাইটিস সি শনাক্তের পদ্ধতি ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। হয়েছে নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার। ফল চিকিৎসাপদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। নতুন ওষুধগুলো হেপাটাইটিস সি ভাইরাস প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। কিন্তু এগুলোর দাম খুব বেশি। তাই সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। চিকিৎসার জন্য একটি ওষুধ ৮-১২ সপ্তাহ ব্যবহার করতে হয়। বার্নেস বলেন, যেহেতু হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী সংবেদনশীল, যেমন নেশাগ্রস্ত, তাঁদের কাছে উপযুক্ত ওষুধ পৌঁছানো একটু কঠিন। তিনি আশা করছেন, এবারের নোবেল পুরস্কার হেপাটাইটিস সি-র প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিভারের অসুখের জন্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের পরই হেপাটাইটিস সি ভাইরাসকে দায়ী করা হয়। দেশের প্রায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। ৩০ শতাংশ লিভার সিরোসিস ও ১৭ শতাংশ লিভার ক্যানসারের কারণ হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। মোট আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ নারী। আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের ছয়টি প্রধান জিনোটাইপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জিনোটাইপ ৩ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রকট (৫০-৮৯ শতাংশ)।

বাংলাদেশে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণের প্রধান কারণগুলো হলো হাতুড়ে চিকিৎসা, পাবলিক সেলুনে চুল–দাড়ি কাটা, শরীরে অলংকরণের জন্য বিশেষ ছিদ্র করা ইত্যাদি। এ ছাড়া গুটিবসন্ত, কলেরার ভ্যাকসিনেশন, দাঁতের চিকিৎসা, রক্ত আদান-প্রদানও হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

২০১৫ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের চিকিৎসায় রিবাভিরিন ও পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন একসঙ্গে ব্যবহৃত হতো। হেপাটাইটিস সি জিনোটাইপ ৩-এর ক্ষেত্রে এই ডুয়াল থেরাপির সাস্টেইন্ড ভাইরোলজিক রেসপন্স ছিল ৮০ শতাংশ। একটি অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ব্যবহার করে চিকিৎসা শেষ হওয়ার ১২ সপ্তাহ বা তার পরে যদি রক্তে ওই ভাইরাস না পাওয়া যায়, তাহলে একে সাস্টেইন্ড ভাইরোলজিক রেসপন্স বলে।

২০১৫ সালে দেশে উৎপাদিত সফসবুভির বাজারে আসে। এখন আমাদের কাছে রিবাভিরিন ও পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন ছাড়াও ড্যাকলাটাসভির ও লেডিপাসভির রয়েছে। এই তিন ওষুধ একসঙ্গে ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। সরকার কর ও ভ্যাট তুলে নিয়েছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের ওপর থেকে। তাই এখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশে উৎপাদিত হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। এত কিছুর পরও বাংলাদেশ থেকে হেপাটাইটিস সি সমূলে নির্মূল হতে সময় লাগবে। হয়তো সেটি ২০ বছর অথবা আরও বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নির্মূল করার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। এখানে একটি বড় সমস্যা হলো, এই ভাইরাসের কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। বার্নেস বলেন, ‘ভাইরাসটি ৩০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখনো আমাদের কাছে কোনো ভ্যাকসিন নেই। এখনো মানুষ হেপাটাইটিস সি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। তাই গল্প এখনো অনেক বাকি।’

গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থের স্বল্পতা এবং ভাইরাসের পরিবর্তন প্রবণতার কারণে ভ্যাকসিন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বার্নেস অনুমান করেন, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস এইচআইভির চেয়ে ১০ গুণ এবং সার্স কোভ-২ করোনাভাইরাসের তুলনায় কয়েক গুণ পরিবর্তিত হয়েছে। বার্নেস বলেন, এ ভাইরাসে সংবেদনশীল মানুষদের নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করাও কঠিন কাজ।

টমাস বোমার্ট বলেন, হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে বলে মানুষ ভাবছে, ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে। এটি পুরোপুরি ভুল ধারণা। এমনকি বরাদ্দকারী সংস্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাগুলোর আগ্রহও কমে গেছে এতে। এবারের নোবেল পুরস্কার হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নিয়ে বিশ্ববাসীকে পুনরায় নতুনভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার নিউজ, doi: 10.1038/d41586-020-02763-x