পালসার সংকেতের রহস্যভেদ

পালসার হলো একধরনের নিউট্রন নক্ষত্র। যেসব ভারী নক্ষত্রের ভর জীবনের শেষ ধাপে ব্ল্যাকহোল তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট নয়, তারা পরিণত হয় নিউট্রন নক্ষত্রে। এদের মধ্যে কোনো প্রোটন বা ইলেকট্রন থাকে না, থাকে শুধু নিউট্রন। আর সে জন্যই এই নাম। ভর সূর্যের কয়েক গুণ। কিন্তু ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে আয়তনে হয় পৃথিবীর চেয়েও অনেক ছোট। ব্যাসার্ধ মাত্র ১০ কিলোমিটারের কাছাকাছি।

এদেরই এক রূপ হলো পালসার। শব্দটি আসলে পালসেটিং স্টার কথার সংক্ষেপ। পালসেট (Pulsate) কথার অর্থ হলো স্পন্দিত হওয়া। এরা নিয়মিত বিরতিতে স্পন্দিত হয় বলেই নামটি পাওয়া। চুম্বকত্বও অনেক বেশি। এ ছাড়া নির্গত করে শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ। নির্গত বেতার তরঙ্গ এদের চারপাশে ঘুরতে থাকে লাইট হাউসের আলোর মতো। এর ফলে এরা খুব সময় মেপে, নিয়মিত বিরতিতে সাধারণত বেতার সংকেত প্রেরণ করতে থাকে।

বহুদিন ধরেই একটি রহস্য বিজ্ঞানীদের খুব ভাবাচ্ছিল। পালসাররা কেন মহাশূন্যে বিভিন্ন ধরনের সংকেত পাঠায়? তবে সম্প্রতি এর কিছু উত্তর মিলেছে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে কাজে এসেছে নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরির তোলা কিছু ছবি। এতে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী পালসার নিয়ে গবেষণা চালানো হয়। এতে বোঝা গেল, পালসারের বিকিরণ পৃথিবী থেকে শুধু কিছু নির্দিষ্ট কোণেই দেখা যায়। এতেই পাওয়া গেছে সমাধানের সূত্র।

বহুদিন পর্যন্ত পালসারদের শ্রেণিবিভাগ করা হতো এদের নির্গত তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের দ্বারা। কিন্তু ২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, কিছু পালসার গামা রশ্মিও নির্গত করতে পারে। এ আবিষ্কার সম্ভব হয় নাসার ফার্মি টেলিস্কোপের মাধ্যমে। বেতার রশ্মির মতোই গামা রশ্মিও আরেক ধরনের তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ। তবে বেতার রশ্মির তুলনায় এর শক্তি অনেক বেশি। গামা রশ্মির পালসারই বিজ্ঞানীদের প্রায় এক দশক ধরে ভাবাচ্ছিল।

পালসারের সংকেতের তারতম্যের সঙ্গে জ্যামিতির খুব মিল রয়েছে। একটি পালসারকে কোন জায়গা থেকে এবং কেমন দেখা যাবে, সেটা নির্ভর করে এর ঘূর্ণন ও চুম্বক অক্ষ আমাদের দৃষ্টিরেখার সঙ্গে কীভাবে অবস্থিত তার ওপর। পালসার গবেষণার একটি উপায় হলো একধরনের নীহারিকা নিয়ে গবেষণা। এই নীহারিকাদের নাম পালসার উইন্ড নেবুলা। পালসারের পাশেই থাকে চার্জিত কণার ঘূর্ণি। এদের গতি আলোর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারে। এই কণাদের দ্বারা গঠিত নেবুলাকেই বলা হয় পালসার উইন্ড নেবুলা। অন্যান্য অনেক নেবুলার মতোই এই নেবুলাও তৈরি হয় কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ থেকে।

চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরির মাধ্যমে এই নেবুলাদের খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে। পালসারদের মধ্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন রকমের চুম্বকীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা পেতে সহায়তা করে নেবুলাগুলো। এ ছাড়া আমরা শুধু নির্দিষ্ট কিছু বিকিরণই কেন পাই, মিলছে তার ব্যাখ্যাও।

গবেষণা দলের সদস্য ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ রজার রোমেনি বলেন, ‘পালসার উইন্ড নেবুলা নিয়ে গবেষণা করে প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর এটা অন্যতম সেরা।’ এই গ্যাসগুলোর ত্রিমাত্রিক কাঠামো পর্যবেক্ষণ করে পালসারের কেন্দ্র থেকে নির্গত প্লাজমার সন্ধান পাওয়া সম্ভব। আগেই বলেছি, সাম্প্রতিক এই অগ্রগতির জন্য দুটি ভিন্নধর্মী পালসার দেখা হয়েছে। এদের উইন্ড নেবুলাও ভিন্ন প্রকৃতির। একটির দূরত্ব (নাম গেমিঙ্গা) ৮০০ আলোকবর্ষ, আরেকটির ৩ হাজার ৩০০। গেমিঙ্গার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দিকে তিনটি আলাদা লেজ পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে, এই লেজের অবস্থানের কারণেই আমরা ভিন্ন ভিন্ন সংকেত পাচ্ছি। গেমিঙ্গার ক্ষেত্রে পাচ্ছি বেতারের বদলে গামা সংকেত।

আবার অন্য পালসারটির ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে বেতারসংকেত। কারণ এর বেতারসংকেতের দিক পৃথিবীমুখী হয়ে আছে। যদিও হয়তো এতেও গামা রশ্মির বিকিরণ চলছে, তার দিক পৃথিবীর দিকে নয়। পালসার নিয়ে এখনো জানার অনেক কিছু বাকি। তবে নতুন এই আবিষ্কারের ফলে দুটো লাভ হয়েছে। এক, জানা গেছে যে পালসাররা কেন শুধু একটি নির্দিষ্ট রকমের বিকিরণই পাঠায়। দুই, কণা পদার্থবিদেরা এমন কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারছেন, যার পরীক্ষা পৃথিবীর কোনো গবেষণাগারে সম্ভব নয়।

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ডটকম, নিউ সায়েন্টিস্ট, উইকিপিডিয়া