বিবর্ণ নীল বিন্দুর এক গ্রহ

১৯৯০ সালে যখন নাসা থেকে উৎক্ষেপিত ভয়েজার মহাকাশযান সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তনাক্ষত্রিক শূন্যতায় প্রবেশ করবে, ঠিক সেই সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান এক মিনতি জানালেন নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে। তিনি বললেন, ‘ভয়েজারকে একবারের জন্য পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকাতে নির্দেশ করুন, প্লিজ।’ নাসা সেই অনুরোধ রেখেছিল, ভয়েজার মাত্র একবার পেছন ফিরে তাকাল। এরপর একটা মাত্র ছবি তুলল পৃথিবীর। সেই ছবিটি তুলল ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে।

সেই ছবিটা যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, বিশাল গাঢ় অন্ধকারের মাঝে কয়েকটা আলোক-রেখা। তার মাঝে মলিন একটা বিন্দু। সাগানের ভাষায়, ‘পেইল ব্লু ডট’। হ্যাঁ, ওই বিন্দুটাই আমাদের ৭০০ কোটি মানুষ আর বাস্তুসাংস্থানিক জীবদের বসবাসের পৃথিবী। এই ছবি মানবসভ্যতাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছিল, মহাজাগতিক পরিমণ্ডলে মানুষের অবস্থান কত নগণ্য ও তুচ্ছ। নক্ষত্রের ছাই থেকে জন্ম নেওয়া মানুষ তাই মহাবিশ্বের মহারূপ সম্পর্কে জানতে চায়। কী করে জন্ম নিল গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথ? একটি মাত্র বিন্দু থেকে কী করে ঘটল মহাবিস্ফোরণ? বিশ্বটা কি আসলেই সরে সরে যাচ্ছে দূরে, ক্ষণে ক্ষণে? আমরা কি পারব কখনো, কোনো নক্ষত্রে যেতে? মহা অন্ধকারে জোনাকির মতো জ্বলছে যেসব নক্ষত্র তাদের কারও সংসারে কি পৃথিবীর মতো বসতভিটা আছে, যেখানে বসবাস করে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী? এই ছবিটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মহাশূন্যে মানবজাতির ভবিষ্যত্ লক্ষ্য নিয়ে তিনি লিখে ফেলেছিলেন পেইল ব্লু ডট বা বিবর্ণ নীল বিন্দুর গ্রহ।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে যুদ্ধ, লোভ, বল্গাহীন বাণিজ্য আর আমাদের দেশের নদীদখল, জমিদখল, যানজটের পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ট্যাক্স ছাড়া গাড়ি আমদানি দেখলে বিবর্ণ পৃথিবীর কথাই মনে হয়।

সেই সময়, ভয়েজার সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে আন্তনাক্ষত্রিক শূন্যস্থান পাড়ি দিচ্ছে মনে হলেও আসলে কতটা পথ সেটা আমরা জানতাম না। এখন নিশ্চিত, ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৯৪ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব) হেলিওসেথ অতিক্রম করে হেলিওপজে প্রবেশ করে। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট ভয়েজার-১ হেলিওপজ অতিক্রম করে আন্তনাক্ষত্রিক শূন্যতায় প্রবেশ করে। বিদ্যুত্ উত্পাদক রেডিও আইসোটোপ জেনারেটর সক্রিয় থাকলে এই যাত্রা ২০২৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ভয়েজার যেন মানবজাতির মহাজাগতিক দৃষ্টিকে সম্প্রসারিত করতে এগিয়ে চলেছে। মহাকাশযানটি সৌরসীমার প্রান্তে থাকা অবস্থায় প্রকাশিত বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্স থেকে আরেকটি বিষয় জানা গিয়েছিল। সে সময় নাসার ভয়েজার মিশনের প্রজেক্ট বিজ্ঞানী ড. এডস্টোন বলেছিলেন, ‘আমি সঠিকভাবে জানি না কখন ভয়েজার-১ মহাকাশযান সৌরজগত্ ত্যাগ করবে, তবে বিশ্বাস করি সেই মুহূর্ত আসন্ন। এটা যেকোনো দিন হতে পারে, আবার কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে।’ এখন এটা বাস্তব। তা-ই যদি হয়, তাহলে এই সৌরজগতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পাড়ি দিতে আলোর গতিতে ১০ ঘণ্টা লাগে। তা ভয়েজারের লেগেছে ৩৫ বছর।

১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভয়েজার-১ উিক্ষপ্ত হয়েছিল। ৭২২ কিলোগ্রামের এই রোবটিক স্পেসক্রাফট সৌরজগতের বাইরের অঞ্চল নিয়ে গবেষণার জন্যই অভিযান শুরু করেছিল। ১৯৭৯ সালে বৃহস্পতি গ্রহ এবং ১৯৮০ সালে শনির গ্রহ ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল এই মহাকাশযান। এদিকে ২০১৫ সালেই ভয়েজার-১ সৌরজগতের শেষ সীমান্তে নতুন এক স্তরের সন্ধান পায়। পৃথিবী থেকে প্রায় ১১০০ কোটি মাইল দূরে। বিজ্ঞানীরা একে ‘চৌম্বকীয় মহাসড়ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভয়েজার-১ প্রায় ৩৯ বছর দুই মাস ১৭ দিন ধরে ছুটে চলেছে এবং এখনো গভীর মহাশূন্য থেকে পাঠানো বার্তার মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ভয়েজার-১ থেকে বর্তমানে পৃথিবীতে তথ্য আসতে সময় লাগছে প্রায় ১৮ ঘণ্টা। এটাই হলো পৃথিবী থেকে মানব নির্মিত সবচেয়ে দূরবর্তী যন্ত্র বা মহাকাশযান—প্রায় ১৩৭ জ্যোতির্বিজ্ঞান একক বা ১ হাজার ২৭৪ কোটি ১০ লাখ মাইল।

কার্ল সাগান তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত পেইল ব্লু ডট প্লানেট: আ ভিশন অব দ্য হিউম্যান ফিউচার ইন স্পেস-এ ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তোলা বিন্দুর ছবিটা সম্পর্কে নানা রকম ভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশাল দূরত্বে পৃথিবীকে নিছক একটা বিন্দুর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। কিন্তু একটু ভাবলেই আমাদের কাছে তা খুবই ভিন্ন হয়ে ধরা দেয়। কেননা এটার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জড়িয়ে। এটাই পৃথিবী, আমাদের বসত, এটাই আমরা। যাদের আমি ভালোবেসেছি, যারা পরিচিত, তাদের সবাই এখানে। অন্তত যাদের কথা আমরা শুনেছি, তাদের সবাই এখানে জীবন কাটিয়েছে। আমাদের সারা জীবনের যত দুঃখ-কষ্ট, হাজার হাজার ধর্ম, আদর্শ আর অর্থনৈতিক মতবাদ; যত শিকারি আর লুণ্ঠনকারী, যত সাহসী-ভীরু, সভ্যতার নির্মাতা-ধ্বংসকারী, যত রাজা আর প্রজা, যত প্রেমিক-প্রেমিকা, যত বাবা-মা, যত স্বপ্নে বিভোর শিশু, আবিষ্কারক, পরিব্রাজক, যত নীতিমান শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, যত সুপারস্টার, ইতিহাসের সব সাধু আর পাপী, সবারই জীবন কেটেছে আলোয় ভেসে থাকা ছোট্ট ওই ধূলিকণাটিতে। বিশাল মহাবিশ্বে খুবই ছোট্ট মঞ্চ হলো আমাদের এই পৃথিবীটা।

ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, ক্ষুদ্র এই বিন্দুর ক্ষুদ্র একটি অংশ জয় করে মহান হওয়ার আশায় সেনাপতি, সম্রাটরা কত রক্ত ঝরিয়েছে। ভেবে দেখুন তো, সীমাহীন সেসব হিংস্রতার কথা; ছোট্ট এই বিন্দুর আরও ছোট্ট একটি অংশের মানুষ যা ঘটিয়েছে অন্য প্রান্ত জয় করবে বলে।

কী দ্বন্দ্ব তাদের মাঝে, রক্তের জন্য তাদের কী পিপাসা? কী প্রকট তাদের জিঘাংসা? আমাদের নাক উঁচু ভাব, আমাদের কাল্পনিক অহমিকা, মহাবিশ্বে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, সেই বিভ্রম—প্রশ্নবিদ্ধ হয় ক্ষুদ্র বিন্দুর ঝাপসা নীল আলোর মধ্য দিয়।

ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক, এই মুহূর্তে পৃথিবীই একমাত্র আশ্রয়। মানুষের অহংকারকে ধূলিসাত্ করার জন্য দূর থেকে তোলা ছোট্ট পৃথিবীর ছবির চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। আমার মতে, এটা আমাদের বলে, কতটা জরুরি পরস্পরের প্রতি আরেকটু সহানুভূতিশীল হওয়া, এই ছোট্ট নীল বিন্দুকে রক্ষা করা।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা