পেনরোজ, কৃষ্ণগহ্বর ও নোবেল ২০২০

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রজার পেনরোজ‌এএফপি

এ বছরের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন রজার পেনরোজ (Roger Penrose), অ্যান্দ্রেয়া গেজ (Andrea Ghez)ও রাইনহার্ড গেনজেল (Reinhard Genzel)।


গত এক দশক ধরে কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা ও আবিষ্কার হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম দুটি হল, ২০১৫ সালে LIGO যন্ত্র দিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ এবং দ্বিতীয়টি হল, ২০১৯ সনে ETH বেতার দূরবীন দিয়ে M৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের ছায়ার ছবি গ্রহণ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎস হিসেবে বিজ্ঞানীরা বহুদূরের গ্যালাক্সিতে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষকে চিহ্নিত করেন। ২০১৭ সালে LIGO-এর সঙ্গে যুক্ত তিনজন বিজ্ঞানীকে নোবেল দেয়া হয়। তাই এবার ETH-এর সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা নোবেল পুরস্কার পেলেও পেতে পারেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে ETH না পেলেও কৃষ্ণগহ্বর ও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বর্তমান বিজ্ঞান মানসকে যে কতখানি প্রভাবিত করছে সেটা ২০২০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে বোঝা গেছে। কারণ এ বছরের পুরস্কারও কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গেই জড়িত।

চলতি বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী (বাঁ থেকে) রজার পেনরোজ, রাইনহার্ড গেনজেল, অ্যান্দ্রেয়া গেজ
নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি

১৯৬০-এর দশকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পুনর্জন্ম হয়। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মারটেন স্মিড মহাকাশে অতি-উজ্জ্বল কোয়াজার (এখন আমরা জানি, এগুলো কিছু গ্যালাক্সির শক্তিশালী কেন্দ্র) ও ১৯৬৪ সালে উইলসন ও পেনজিয়াস মহাজাগতিক বিকিরণ (মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড) আবিষ্কার করেন। প্রায় একই সময়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষ্ণগহ্বরের জন্য আইনস্টাইনের জটিল সমীকরণের একটি সমাধান বের করেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী রয় কের (Roy Kerr)। আবার কৃষ্ণগহবরের ভেতরে স্থান-কালের চরম বক্রতায় অসীম ঘনত্ব (সিংগুলারিটি) সৃষ্টি হবে সেটা প্রমাণ করেন ইংরেজ রজার পেনরোজ। সেই নতুন সময়ে ১৯৬০-এর দশকে হকিং মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে সমসত্ত্ব বস্তু-ঘনত্ব থেকে পৃথক পৃথক গ্যালাক্সি সৃষ্টির সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেন, মহাবিশ্বের আদি ও অন্তের সিংগুলারিটির সম্ভাবনার কথা লেখেন। ওই সময় থেকেই পেনরোজের সঙ্গে হকিংয়ের বিজ্ঞানিক সহযোগিতা শুরু হয়। পরবর্তী দশ বছরে কৃষ্ণগহবর বিজ্ঞানকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন এই দুজনে মিলে।

১৯৬৪/৬৫ সালে রজার পেনরোজ টপোলজি গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখান, একটি অন্তঃপতনশীল (Collapsing) বড় নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এত বেশি হবে যে, সেটি একটি সিঙ্গুলারিটিতে পরিণত হবে। একটি অসীম ঘনত্বের বা অসীম মহাকর্ষীয় বলের বিন্দুটিকে ইংরেজিতে সিঙ্গুলারিটি বলা হয়। সিঙ্গুলারিটির অর্থ হল অনন্য। এমন অনন্য অবস্থা মহাবিশ্বের আর অন্য কোথাও বিরাজ করে না। সিঙ্গুলারিটিতে স্থান-কালের বক্রতা এত তীব্র হয় যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা সেখানে আর কাজ করে না, সে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়। পেনরোজ প্রমাণ করেন, এরকম সিঙ্গুলারিটি একটি ঘটনা দিগন্ত দিয়ে ঘেরা থাকবে, যার ভেতর থেকে আলোও বের হবে না। এটাকে মহাজাগতিক সেনসরশিপ নাম দিয়েছিলেন পেনরোজ। অর্থাৎ কোনো সিঙ্গুলারিটিকেই খোলা বা নগ্ন অবস্থায় দেখা যাবে না, সেটি সব সময় ঘটনা দিগন্ত দিয়ে আবৃত থাকবে। কৃষ্ণ বিবর বা ব্ল্যাকহোল বলতে আমরা সিঙ্গুলারিটিসহ ঘটনা দিগন্তের মধ্যে যা আছে তা-ই বোঝাই। সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণের জটিল সমাধান এড়িয়ে পেনরোজই প্রথম গাণিতিক টপোলজি ব্যবহার করে সিংগুলারিটির সম্ভাবনা প্রমাণ করেন।

১৯৬৯ সালে পেনরোজ আবিষ্কার করেন যে, একটি ঘুরন্ত কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে প্রচুর পরিমাণে ঘুরন্ত শক্তি বর্তমান এবং যেহেতু সেটি ঘটনা দিগন্তের বাইরে সেটাকে আহরণ করা সম্ভব। একে বর্তমানে পেনরোজ প্রক্রিয়া বলা হয়। মনে করা হয়, সরাসরি পেনরোজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে না হলেও বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বিশালাকায় কৃষ্ণগহ্বর (যেমন M৮৭-এর কেন্দ্রে অবস্থিত গহ্বরটি সাড়ে ছ শ কোটি সূর্যের ভরের সমান) অনুরূপ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর শক্তি বিকিরণ করে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে কৃষ্ণগহ্বর
নাসা

M৮৭-এর মত দানবীয় গহ্বর না হলেও আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বর বাস করছে। গত প্রায় তিন দশক ধরে সেটাকে মার্কিন বিজ্ঞানী আন্দ্রেয়া গেজ ও জার্মান বিজ্ঞানী রাইনহের্ড গেনজেল পর্যবেক্ষণ করছেন অবলোহিত তরঙ্গে। সেটার অবস্থান আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এবং আমাদের থেকে আনুমানিক ২৬ হাজার ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে। গেজ, গেনজেল ও অন্যান্য গবেষকরা বহু সময় ধরে কেন্দ্রে অবস্থিত একটি উজ্জ্বল বেতার উৎস Sgr A-র (সাজিটেরিয়াস A) চারদিকে তারাদের আবর্তনের কেপলেরীয় কক্ষপথ বিশ্লেষণ করে বার করেন যে, Sgr A কৃষ্ণগহ্বরের ভর প্রায় ৪১ লক্ষ সৌরীয় ভরের সমান। যেহেতু এই তারাগুলো Sgr A কাছাকাছি এলে আলোর গতির প্রায় ৩% গতিবেগে ভ্রমণ করে তাই তাদের বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘের পরিবর্তন হয়। শুধু তাই নয় Sgr A-র শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে তাদের গতিরও পরিবর্তন হয়। এই দুটি পর্যবেক্ষণই সাধারণ আপেক্ষিকতার ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত। এত দূর থেকে যে আমরা গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছের তারাদের গতিবিধি অবলোকন করতে পারছি সেটা সত্যি চমকপ্রদ। এর জন্য চাই যেমন Keck-এর মত বড় ব্যাসের (১০ মিটার) দূরবীন আর adaptive optics। Sgr A একটি কৃষ্ণগহ্বর, যা কিনা মাঝেমধ্যেই খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হয়তো পেনরোজ প্রক্রিয়ার মত একটি প্রক্রিয়ায় বিকিরণ করে। তাই এই বছরের নোবেল পুরস্কার কৃষ্ণগহ্বরকে আমাদের বিজ্ঞান চেতনায় স্থায়ীভাবে ঠাঁই দিল।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র