প্রথম প্রতিপ্রভ ব্যাঙ

জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিপ্রভ উদ্ভিদ বা প্রাণী তৈরির ব্যাপারটি বেশ কিছুদিন আগে থেকে চলছে। তবে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিপ্রভ সামুদ্রিক প্রাণী। যেমন: প্রবাল, মাছ, হাঙর ও কচ্ছপের কিছু প্রজাতির দেখা মেলে। তবে স্থলচর প্রতিপ্রভ প্রাণী দুর্লভ। কিছুদিন আগ পর্যন্ত প্রতিপ্রভ টিয়া পাখি ও বিছার কথা জানতেন বিজ্ঞানীরা। তবে ২০১৭ সালে প্রথম কোনো প্রাকৃতিক প্রতিপ্রভ উভচরের দেখা পাওয়া গেল। সেটা এক প্রজাতির ব্যাঙ। পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার সান্তা ফের কাছাকাছি। পলকা-ডট ট্রি নামের এই ব্যাঙটিকে বিজ্ঞানীরা যখন অতিবেগুনি আলোর ফ্ল্যাশ লাইটের নিচে রাখলেন, তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন যে ব্যাঙগুলো তীব্র সবুজাভ নীল আলো বিকিরণ করছে। ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে এই চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা জানিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার একদল বিজ্ঞানী।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, প্রকৃতিতে তো অনেক প্রাণীরই দেখা মেলে, যাদের অন্ধকারে জ্বলতে দেখা যায়। আমাদের খুব পরিচিত জোনাকি পোকাও তো রাতে জ্বলে। এ ছাড়া সামুদ্রিক জেলি ফিশ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছি, ছত্রাকসহ এ রকম হাজারো প্রাণীর দেখা মেলে। এসব প্রাণীকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্ট (Bioluminescent) প্রাণী। প্রতিপ্রভ প্রাণীদের সঙ্গে এদের প্রধান পার্থক্য হলো, এদের শরীরে সংঘটিত কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলস্বরূপ এই আলোর উত্পত্তি হয়, বাইরের আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এদের আলোক বিকিরণকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে না। অন্যদিকে প্রতিপ্রভ প্রাণীরা কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে অধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে। ফলে কোনো আলোক-উত্স না থাকলে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই ব্যাপারটি সম্ভব নয়।

পলকা-ডট ট্রি ব্যাঙের বৈজ্ঞানিক নাম Hypsiboas punctatus| দক্ষিণ আমেরিকার খুবই সাধারণ এক ধরনের ব্যাঙ এটি। গায়ে ফ্যাকাশে সবুজ রঙের ওপর লাল রঙের কিছু বিন্দু—সাধারণ আলোতে এর বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। কিন্তু অতিবেগুনি রশ্মির নিচে এই উভচর কিনা আলো বিকিরণ করে রাতারাতি এক ডিস্কো-বলে পরিণত হয়!

এই প্রতিপ্রভার কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষক দলটি বিলিভারডিন নামক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ করেন। বিলিভারডিনের উপস্থিতির কারণে প্রাণীটির হাড় এবং টিস্যুর রং সবুজ হয়। বিলিভারডিন রঞ্জকটি মানুষসহ অনেক প্রাণীতেই পাওয়া যায়। কিন্তু বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী কিছু প্রাণীতে এই বিলিভারডিনের উপস্থিতি প্রতিপ্রভা সৃষ্টিতে সক্ষম। কিছু প্রাণীতে smURFP (Small ultra red fluorescent protein) নামক একধরনের প্রোটিন বিলিভারডিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হালকা লাল রঙের আলো বিকিরণ করে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে। তাই গবেষক দলটি ভেবেছিলেন ব্যাঙটিও অতিবেগুনি রশ্মিতে লাল আলো বিচ্ছুরণ করবে। কিন্তু যে ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের অবাক করেছে সেটি হচ্ছে, ব্যাঙটি লাল আলোর বদলে সবুজাভ নীল আলো বিকিরণ করে! এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অন্য এক পদার্থের সন্ধান পান।

প্রকৃতপক্ষে হাইলোয়িন (Hyloin) নামক একধরনের পদার্থের কারণে এ ঘটনাটি ঘটে। প্রাণীটির লসিকা, ত্বক ও কিছু গ্রন্থীয় ক্ষরণে থাকা Hyloin-L1, Hyloin-L2 I Hyloin-L1-এই তিনটি হাইলোয়িন অণু প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে থাকে। গাঠনিক দিক থেকে চাক্রিক বলয় ও হাইড্রোকার্বন চেইন দিয়ে তৈরি এই অণুগুলো অন্যান্য প্রতিপ্রভা সৃষ্টিকারী অণু থেকে আলাদা। হাইলোয়িন অণুগুলো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে এবং দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে। ফলে অতিবেগুনি রশ্মিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ব্যাঙটি। এ কারণেই পূর্ণিমা ও গোধূলির আলোয় ব্যাঙটির উজ্জ্বলতা যথাক্রমে ২০% ও ৩০% বৃদ্ধি পায়। এই প্রতিপ্রভ রশ্মির কম্পাঙ্কের সঙ্গে রাতের বেলায় ব্যাঙটির দৃষ্টির সংবেদনশীলতার মিল আছে। এটা থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ব্যাঙগুলো হয়তো এই প্রতিপ্রভা নিজেরা দেখতে পায়। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো এই বিষয়ে নিশ্চিত নন, এটি নিয়ে তাঁরা গবেষণা চালিয়ে যাবেন।

গবেষক দলটি পলকা-ডট ট্রি ব্যাঙের মতো অর্ধস্বচ্ছ ত্বক আছে এমন আরও আড়াই শ প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই আবিষ্কারটি প্রাকৃতিক প্রতিপ্রভার পেছনের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং আচরণগত কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ডিওআই ডট ওআরজি