ভবিষ্যতের রূপকথা

মেরি শেলীর হাত ধরে একদিন সাহিত্যের যে নতুন শাখার জন্ম হয়েছিল; জুল ভার্ন, এইচ জি ওয়েলস হয়ে আসিমভ, আর্থার সি ক্ল্যার্কের অবদানে সেই শাখাটি আজ অনেকটাই সাবালক। ইউরোপীয়ান লেখকদের দেখানো পথে হেঁটে বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের চল শুরু করেছিলেন জগদানন্দ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকেরা। পরে সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন, হুমায়ূন আহমেদ এবং মুহাম্মদ জাফর ইকবালেরা কল্পবিজ্ঞানকে দিয়েছেন উতুঙ্গ জনপ্রিয়তা। আর সেই কল্পবিজ্ঞানই হয়তো ভবিষ্যতে রূপকথা হিসেবে আবির্ভূত হবে...

বিখ্যাত ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলি গিয়েছিলেন এক দ্বীপে বেড়াতে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মেরি শেলি এবং বন্ধু ‘প্রেমের কবি’ হিসেবে খ্যাত লর্ড বায়রন। সেখানে তাঁদের মধ্যে একটা চুক্তি হলো। তিনজন লিখবেন তিনটি ভূতের গল্প। কারটা কেমন হয় সেটা যাচাই করা হবে পরে। লিখলেনও। কিন্তু পি বি শেলি আর বায়রনের গল্প দুটি হারিয়ে গেছে ইতিহাসের কোন অতলে। কিন্তু মেরি যেটা লিখলেন সেটা শুধু কালজয়ীই নয়, জন্ম হলো বিশ্বসাহিত্যের নতুন এক শাখার। কল্পবিজ্ঞান তার নাম।

অবশ্য কল্পবিজ্ঞান শব্দটা পরিচিতি পেয়েছে আরও পরে। ইতিহাসের প্রথম সেই সায়েন্স ফিকশনটির নাম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস। রাতারাতি ঝড় তুলল সেই উপন্যাস। এ কেমন গল্প শোনাচ্ছেন মেরি শেলি, এমন করে তো আর কেউ কখনো গল্প বলেনি? রূপকথার গল্প মানুষ শোনে, তাতে রোমাঞ্চিতও হয়। কিন্তু বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে গড়ে উঠতে পারে উপন্যাসের কাহিনি, সে কথা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। শেলি গল্পের উপাদানটা পেয়েছিলে বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানির বিখ্যাত ব্যাঙ নাচানোর ঘটনা থেকেই। সেই গ্যালভানি, যার নামে বিদ্যুৎ প্রবাহ মাপার যন্ত্রের নাম গ্যলভানোমিটার। সেটা প্রায় আড়াইশো বছর আগের ঘটনা। মৃত ব্যাঙ নিয়ে কী জানি পরীক্ষা করছিলেন গ্যালভানি। সঙ্গে বিদ্যুৎও ছিল। বিদ্যুতের দুটি তার ব্যাঙের একটা কাটা পায়ে স্পর্শ করতেই সেটা নড়ে ওঠে। গ্যালভানি প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় মরা ব্যাঙের প্রাণ সংঞ্চার করে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই। সেটা নিয়ে একটা প্রবন্ধই লিখে ফেললেন উত্তেজনার বশে। বেশ কিছুদিন পরে আবিষ্কার করেন, বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণেই ব্যাঙটা নড়ে উঠেছিল, মরা ব্যাঙ প্রাণ ফিরে পায়নি। এ ঘটনা চাউর হয়ে যায় লোকসমাজে। এ নিয়ে প্রচুর হাসাহাসিও হয় গ্যালভানিকে নিয়ে। লোকে ঠাট্টা করে গ্যালভানির নাম দিল ‘ব্যাঙ নাচানো প্রফেসর’ সেই ঘটনাই গড়ে দেয় ইতিহাসের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের ভিত।

মেরি শেলি
ফাইল ছবি

মেরি শেলি তাঁর গল্পে এক গবেষককে হাজির করলেন। নাম তাঁর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। সেই গবেষকের খুব ইচ্ছা ছিল মৃত মানুষের প্রাণ ফেরাবেন। জৈব ও রাসায়নিক গবেষণা করে একদিন ঠিকই তিনি এক শবদেহকে জাগিয়ে তোলেন। কিন্তু সেই মানুষ আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো হলো না। হলো কুৎসিত-কদাকার এক দানব। ভয় পেয়ে গেলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এমন কুৎসিত চেহারার প্রাণীর সঙ্গে বসবাস করার কথা ভাবতে পারলেন না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন নিজের তৈরি দানবটাকে। কিন্তু প্রথমে শুধু চেহারাতেই সে দানব ছিল। তার ভেতরে ছিল ভালোবাসার কাঙাল এক শিশুমন। যে শিশু তার স্রষ্টার কাছে হাতজোড় করে ভালোবাসা চেয়েছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মন গলেনি। দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাকে। এরপর সেই বিদঘুটে দানবটা সত্যিকারের দানব হয়ে ফিরে আসে। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মানবসমাজে। স্রষ্টাকে সে মারেনি, তবে তাঁকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে শেষ করেছে। এভাবেই জন্ম হয় সাহিত্যের এক কালজয়ী উপন্যাসের, জন্ম হয় কল্পবিজ্ঞানের।

শিল্পীর তুলিতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন
ফাইল ছবি

মেরি শেলির পর অনেকেই কল্পবিজ্ঞান লিখতে চেয়েছেন। কিন্তু সেগুলো ঠিক কল্পবিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি। এরপরই ফরাসি লেখক জুল ভার্নের আবির্ভাব। ১৮৬২ সালে তিনি লিখলেন তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ।এই উপন্যাস তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তুলল।

জুল ভার্ন দূরদর্শী কল্পবিজ্ঞান লেখক ছিলেন। তৈরি করলেন এক কালজয়ী চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো—ভারতের রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে ফেরার। ব্রিটিশ সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেন সাগরের তলদেশে। নটিলাস নামের এক ডুবোজাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ান সাগর-মহাসাগরে। টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি এবং মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড উপন্যাসে ক্যাপ্টেন নিমোর অসাধারণ সব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। জুল ভার্ন যখন নটিলাসের কথা বলছেন, সেই যুগে কেউ কল্পনাই করতে পারেননি সাগরের তলদেশে ডুবোজাহাজ চলতে পারে। পরে জুল ভার্নের সেই নীতি অনুসরণ করেই তৈরি করা হয় প্রথম সাবমেরিন।

জুল ভার্ন একে একে লিখেছেন জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, অফ অ্যান অ্য কমেট, প্রপেলার আইল্যান্ড। লিখেছেন অ্যারাউন্ড দ্য মুন-এর মতো বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন। এই সায়েন্স ফিকশনেই প্রথম চন্দ্রাভিযানের বিষয়টি উঠে আসে। চন্দ্রাভিযান কীভাবে হতে পারে তার একটা দিকনির্দেশনাও ছিল এতে। মেরি শেলি যদি স্রষ্টা হয়ে থাকেন, তবে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের প্রথম প্রকৌশলী জুল ভার্ন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আবির্ভাব সর্বকালের অন্যতম সেরা কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েলসের। ১৮৮৭ সালে তিনি লিখলেন ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ড নামের বিখ্যাত উপন্যাসটি। মঙ্গলবাসীদের পৃথিবী আক্রমণ এবং সেই আক্রমণ প্রতিহত করার এক দুর্দান্ত থ্রিলার এটি। ১৮৯৫ সালের আগ পর্যন্ত কল্পকাহিনিগুলো ছিল অ্যাডভেঞ্চার আর কাল্পনিক প্রযুক্তিনির্ভর গল্প। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান প্রথম জায়গা পেল ওয়েলসের দ্য টাইম মেশিন গল্পে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা প্রকাশের ১০ বছর আগে সময় ভ্রমণের এক অনবদ্য কাহিনি উঠে আসে সেই উপন্যাসে। উপন্যাসে সময় পর্যটক ভবিষ্যতে গিয়ে ফিরে এসেছেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, নিজের তৈরি টাইম মেশিনের ব্যবহার করে। মানবসভ্যতার একেবারে অন্তিম লগ্নে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় এক করুণ মানবিক বিপর্যয়ের। মানবিকতা, রোমাঞ্চ আর বিজ্ঞানের মিশেলে তৈরি হওয়া টাইম মেশিন সর্বকালের অন্যতম সেরা সায়েন্স ফিকশন। পরে তিনি লিখেন অদৃশ্য মানব (ইনভিজিবল ম্যান) নামে আরেকটি মাস্টারপিস।

কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে হাত পাকিয়েছেন শার্লক হোমসের জনক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও। জন্ম দিয়েছেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার সিরিজের। দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে দেখা যায় আদিম পৃথিবীর ডাইনোসরের সঙ্গে দম বন্ধ করা এক অভিযান।

কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে এক ভিন্ন ধারার জন্ম দেন রুশ কল্পবিজ্ঞান লেখক আলেক্সান্দার বেলায়েভ। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য অ্যাম্ফিবিয়ান ম্যান বা উভচর মানুষ। সাগর আর মাটিতে সমানভাবে দাবড়ে বেড়ানো এক তরুণের প্রেম, মানবিকতা, সেই সঙ্গে গণমানুষের নায়কে পরিণত হওয়ার এক অনবদ্য কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক এই উপন্যাসে। আর্জেন্টিনার রিও ডি লা প্লাতা উপসাগরের তীরে বেড়াতে গেছেন অথচ উভচর মানব ইখথিন্ডিয়ারকে খোঁজ করেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বেলায়েভের আরেক বিখ্যাত কল্পগল্প 'হৈটি টৈটি'। মাথায় মানুষের মগজ বসানো এক হাতিকে নিয়ে লেখা দুর্দান্ত সায়েন্স ফিকশন ছিল সেটা।

বিংশ শতাব্দীতে এসে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মহাজাগরণ তৈরি হয়। সাবালক হয়ে ওঠে কল্পবিজ্ঞান। দেশ-কাল-পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি পাড়ি দেয় গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। কল্পবিজ্ঞানের এই আধুনিক ধারার জনক রুশ-আমেরিকান লেখক আইজ্যাক আসিমভ। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস এমনকি সামাজিক উপন্যাসেও ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয় কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে। তাঁর ‘নাইটফল’ গল্পটি সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশনের স্বীকৃতি পেয়েছে।

আসিমভের সবচেয়ে বড় কাজ রোবট নিয়ে। রোবোটিকসের বহুল কথিত তিনটি নীতি তাঁরই বানানো। আন্তঃনাক্ষত্রিক ‘মানবসভ্যতার স্বপ্ন’ দেখেছেন তিনি। তৈরি করেছেন ফাউন্ডেশন নামে এক কল্পবিজ্ঞান সিরিজ। সেই সিরিজের অধীনে লিখেছেন সাত-সাতটি উপন্যাস। সাম্রাজ্যবাদ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, আন্তঃনাক্ষত্রিক যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা, মানবিকতা আর ভালোবাসার অপূর্ব মিশেলে গড়ে উঠেছে বিশ্ব সায়েন্স ফিকশনের অমূল্য সম্পদটি।

বিশ্ব কল্পবিজ্ঞানের আরেক প্রবাদপুরুষ স্যার আর্থার সি ক্লার্ক। তাঁর স্পেস ওডিসি সিরিজ ফাউন্ডেশন-এর মতোই জনপ্রিয়। তিনি স্যাটেলাইট যোগাযোগের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই। তাঁর সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। তাই ক্লার্ককে আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম

রূপকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সারা বিশ্বের পাঠককুল। আসিমভ, রবার্ট হাইনলেইনের সঙ্গে তিনিও সায়েন্স ফিকশনের বিগ থ্রির সদস্য।

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জন্মও আজকালের নয়, সেই ১৮৭৯ সালে। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক জগদানন্দ রায় প্রকাশ করলেন শুক্র ভ্রমণ নামের একটি উপন্যাস। ১৮৮২ সালে মাসিক বিজ্ঞান দর্পণ পত্রিকায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয় হেমলাল দত্তের কল্পবিজ্ঞান রহস্য। তবে সার্থক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। ১৮৮৯ সালে তিনি লিখলেন 'নিরুদ্দেশের কাহিনী' নামে একটি বিজ্ঞান কল্পগল্প। পরে সেটিই 'পলাতক তুফান' নামে আবার প্রকাশিত হয়।

বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন সুলতানার স্বপ্ন নামে একটি কল্পবিজ্ঞান। খেয়াল খুশির রাজা সুকুমার রায় শোনালেন ক্ষ্যাপাটে এক বিজ্ঞানীর অদ্ভুত গল্প, তাঁর হেশোরাম হুশিয়ারির ডায়েরিতে। তারপর সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৯৩০ সালে লেখেন 'পিঁপড়ে পুরাণ' নামের এক অসাধারণ কল্পবিজ্ঞান কাহিনি। কাছাকাছি সময়ে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে আবির্ভাব তাঁর বিখ্যাত মামাবাবু সিরিজের। টানটান উত্তেজনায় ভরা অ্যাডভেঞ্চারধর্মী কল্পবিজ্ঞান কুহকের দেশে এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্র মামাবাবুকে নিয়ে লেখেন দ্বিতীয় বই ড্রাগনের নিঃশ্বাস। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যায় মামাবাবুর রোমহর্ষক অভিযানের কাহিনিগুলো। সেই সঙ্গে শুরু হলো বাংলা সাহিত্যেও কল্পবিজ্ঞান সিরিজের যাত্রা।

ষাটের দশকে ভিন্নধর্মী এক কল্পবিজ্ঞান নিয়ে হাজির হলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর সন্দেশ পত্রিকায়। 'ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী' নামে প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান চরিত্র ‘প্রোফেসর শঙ্কু’র প্রথম গল্প। ছয় দশক পরেও সমান জনপ্রিয় শঙ্কুর দুঃসাহসিক বৈজ্ঞানিক অভিযানের কাহিনিগুলো। অবশ্য সবাই শঙ্কুর কাহিনিগুলোকে কল্পবিজ্ঞান মানতে রাজি নয়। সত্যজিৎ রায় নিজেও শঙ্কুর কাহিনিগুলোকে ঠিক সায়েন্স ফিকশন বলে চালাতে চাননি কখনো। তাই শঙ্কু-কাহিনিগুলোকে সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে সায়েন্স ফ্যান্টাসি বললেও ভুল হবে না।

সত্যজিতের সমসাময়িক কল্পবিজ্ঞান লেখক অদ্রীশ বর্ধন। তাঁর প্রফেসর নাট-বল্টু সিরিজ যেমন দুর্দান্ত সব প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে, তেমনি টান-টান উত্তেজনা আর ভাষার কারুকাজে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে অনেক বড় এক সম্পদে পরিণত হয়েছে সিরিজটি।

প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সত্যজিতের পর বহু লেখক কল্পবিজ্ঞানে ঝুঁকেছেন। এর মধ্যে বিমল কর অন্যতম। তাঁর লেখা মন্দারগড়ের রহস্যময় জোসনা বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অমূল্য এক সম্পদ। কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারদের মতো প্রথম সারির লেখকেরাও। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের কর্নেল সিরিজের বেশ কয়েকটি কাহিনি কল্পবিজ্ঞাননির্ভর। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের সেরা গল্প গুল্পগুলো নিয়ে অনীশ দেব সংকোলন করেছেন দুটি বই। সেরা কল্পবিজ্ঞান আর সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান বই দুটি পড়লেই বোঝা যায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার হাত বাঙালি লেখকদের কম শক্তিশালী নয়। তবে সত্যজিতের পর বৃহৎ প্রেক্ষাপটে কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জনক হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখা প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনিটি ছিল তোমাদের জন্য ভালবাসা। তিনিই বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ভিত মজবুত করেছেন। মানবতা, সমাজ, দর্শন নিয়ে গড়ে ওঠা সত্যিকার উপন্যাসের স্বাদ পাওয়া যায় তাঁর সায়েন্স ফিকশনগুলোতে। তেমনি চিন্তার খোরাক জোগানোর অবকাশও মেলে। হুমায়ূন আহমেদের শূন্য উপন্যাসটিকে বিশ্বমানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বললে বোধ হয় ভুল হবে না। এ ছাড়া ফিহা সমীকরণ, অনন্ত নক্ষত্রবীথি, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, নিউটনের ভুলসূত্র মানের বিচারে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পরে মুহম্মদ জাফর ইকবালের হাত ধরে বাংলা কল্পবিজ্ঞান পায় উতুঙ্গ জনপ্রিয়তা।

অনেক লেখকই মনে করেন, কল্পবিজ্ঞানই হতে যাচ্ছে আগামী দিনের সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী অঙ্গন। একসময় কল্পবিজ্ঞানকে বাঁকা চোখে দেখতেন অনেক মূলধারার সাহিত্যিক। তবে সময় বদলেছে। অনেকে এখন মনে করছেন, একটা সময় রূপকথার যে প্রভাব আমাদের সাহিত্যে, কিশোর মনে ছিল; সেই জায়গাটা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে কল্পবিজ্ঞান। মানুষ অসাধ্য সাধনের গল্প শুনতে ভালোবাসে। তাই বারবার রূপকথার জগতে ঢুঁ মারে। এখন সেই কাজটিই মানুষ বেশি করে করছে কল্পবিজ্ঞানের বই পড়ে, সিনেমা দেখে। তবে রূপকথার সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের পার্থক্য বিস্তর। আজকের কল্পবিজ্ঞানই হয়তো আগামী দিনের বাস্তবতা। কিন্তু রূপকথার ক্ষেত্রে এ কথা বলার অবকাশ নেই মোটেও। রূপকথা শোনায় সুদূর অতীত থেকে ডালপালা মেলা কল্পকাহিনি। আর কল্পবিজ্ঞান শোনায় দূর-ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বাস্তবতার গল্প।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ডট কম

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়