রোগ নিরাময়ে আশার আলো

ক্যান্সার কোষ (গোলাপি), CRISPR প্রযুক্তিতে এডিটিং করা শ্বেত রক্তকনিকা (নীল)

জিন-পরির গল্প শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। জিন-পরির গল্প শুনিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানো সেই আদিকাল থেকে গ্রামীণ সভ্যতায় চলে আসছে। বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ এই একুশ শতকে, আজও আমাদের গ্রামীণ সমাজ জিন-পরির আছরকে বিভিন্ন মারাত্মক রোগের (থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, ক্যানসার) কারণ হিসেবে গণ্য করছে, যা সত্যিই কষ্টদায়ক। বিজ্ঞানের মতে, জিন-পরি বলে কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি যে থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানেমিয়া, ক্যানসার—এগুলো জেনেটিক ব্যাধি, যা জিনের সমস্যার কারণেই হয়। আপনারা নিশ্চয়ই জিন নিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করছেন।

চলুন এই বিভ্রান্তি দূর করি। যেসব জিনের সমস্যার কারণে এসব মারাত্মক রোগ হয়, সেসব জিন কিন্তু আমাদের কল্পনার অলীক জিন নয়, এই জিনগুলো বাস্তবে ছড়িয়ে আছে প্রতিটি জীবের শরীরে। এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিজ্ঞানের ভাষায় জিন হলো—একটি বিস্তৃত ডিএনএ অণুর নির্দিষ্ট খণ্ডাংশ, যা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। প্রতিটি জিনের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জৈব রাসায়নিক সংকেত। আর এসব জিনের অভিব্যক্তিই জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দায়ী, যা বংশপরমপরায় সঞ্চারিত হয়।

থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানেমিয়া মূলত রক্ত সম্পর্কিত জেনেটিক রোগ। আমাদের রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় রয়েছে হিমোগ্লোবিন নামের এক রঞ্জক পদার্থ, যা আমাদের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে। নিশ্চয়ই জানেন হিমোগ্লোবিন উজ্জ্বল লাল বর্ণের আলোকে প্রতিফলিত করে বলেই আমাদের রক্তের রং লাল। আর এই হিমোগ্লোবিনকে প্রকাশের জন্য যে জিনগুলো দায়ী, তাদের মিউটেশনের (জেনেটিক সংকেতের পরিবর্তন) কারণেই থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানেমিয়া হয়।

কী ভালোই না হতো যদি আমরা হ্যারি পটারের জাদুর কাঠির মতো কোনো কাঠি দিয়ে এই জেনেটিক মিউটেশনগুলোকে কেটে বাদ দিতে পারতাম, বাঁচাতে পারতাম আমাদের কারও না-কারও আপনজনের প্রাণ। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের কল্পনার এই জাদুর কাঠিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এই জাদুর কাঠি আর কিছু নয়, এটা হচ্ছে ক্রিসপার সিস্টেম।

ক্যাস৯ হচ্ছে কাঁচির মতো, যা জেনেটিক মিউটেশনগুলোকে কেটে বাদ দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ক্যাস৯-কে পথ চেনাবে কে? কে তাকে নিয়ে যাবে সেই নির্দিষ্ট জায়গায়, চিনাবে মিউটেশনগুলোকে? আর এই পথপ্রদর্শকের কাজটি করে গাইড আরএনএ। গাইড আরএনএগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে করে গাইড আরএনএগুলো যথাযথভাবে মিউটেটেড ডিএনএর মধ্যে তার সম্পূরক সংকেতগুলোকে চিনতে পারে। তাই গাইড আরএনএগুলো, যাতে জেনেটিক মিউটেশনগুলোকে চিনতে পারে, সেভাবেই ডিজাইন করা হয়।

প্রথমে গাইড আরএনএগুলো যথাযথভাবে মিউটেশনকে চেনে, তারপর Cas9 এসে মিউটেশনের জায়গাগুলোকে কেটে ফেলে এবং ক্রিসপার সিস্টেম বাকি অংশকে জোড়া লাগিয়ে দেয়। ফলে হিমোগ্লোবিনের সেই মিউটেশনগুলো আর থাকে না এবং হিমোগ্লোবিন তার সহজাত কাজগুলো করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী লিন ইয়ে এবং তার দল থ্যালাসেমিয়া ও সিকেল সেল অ্যানেমিয়া রোগীর শরীর হতে ব্লাড সেল (কোষ) নিয়ে CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন জিনের এই মিউটেশনগুলো (ওপরের উল্লিখিত) দূর করতে সক্ষম হন।

আর অন্যদিকে সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী লু ইউ এবং তাঁর দল ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে শ্বেত রক্তকণিকা (রোগ প্রতিরোধকারী কোষ) সংগ্রহ করে। ক্রিসপার-ক্যাস৯ প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্বেত রক্তকণিকা থেকে PD1 জিন (যা শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি নিয়ন্ত্রণ করে) কেটে বাদ দেওয়া হয়। এই এডিটিং করা কোষগুলোকে ল্যাবরেটরিতে সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। আর কোষগুলোকে রোগীর শরীরে পুনরায় প্রবেশ করানো হয়। এটি যা ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে আরও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।

শুধু থ্যালাসেমিয়া আর ক্যানসার নয়, বিজ্ঞানীরা ক্রিসপার প্রযুক্তি দিয়ে ইঁদুরের টাইরোসিনেমিয়া নামের বিপাকীয় রোগ নিরাময় করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন এই সব চমকপ্রদ গবেষণা আজ থ্যালাসেমিয়া আর ক্যানসারের মতো মারাত্মক ব্যাধি নিরাময়ে নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। হার মানাচ্ছে আমাদের কল্পনাকেও।

শিক্ষার্থী, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ল্যাব, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার জার্নাল, পিএনএএস জার্নাল

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত