লাইগো দেবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের খোঁজ

জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড ভালোমতোই লেগেছিলেন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার পেছনে। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশ করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিউটনের মহাকর্ষের ত্রুটিগুলো দূর করে নতুন একটা মহাকর্ষ তত্ত্ব দাঁড় করানো। এ জন্য তিনি মহকর্ষীয় ক্ষেত্রতত্ত্বের জন্ম দেন। শোয়ার্জশিল্ড সেই ক্ষেত্রতত্ত্বের সমাধান করতে গিয়ে পেলেন নক্ষত্রের এক আশ্চর্য মৃত্যুর খবর। তবে সে জন্য নক্ষত্রকে খুব ভারী হতে হবে। সূর্যের চেয়ে কম্পক্ষে তিন গুণ। এ ধরনের নক্ষত্রের কথা আগে জানত না কেউ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও নন। জানবেন কী করে, নক্ষত্রটাকে নাকি দেখাই যায় না। একেবারে কালো এক অন্ধকূপের মতো, তাই এর নাম ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। কিন্তু কালো জিনিসও তো দেখা যায়।

শোয়ার্জশিল্ড বললেন, ভেতরের জ্বালানি ফুরিয়ে এলে খুব দ্রুত চুপসে যেতে শুরু করে ভারী নক্ষত্র। ভেতরের পদার্থগুলো খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। দ্রুত বাড়তে থাকে নক্ষত্রের ঘনত্ব। পাল্লা দিয়ে বাড়ে নক্ষত্রটির মহাকর্ষ বলও। একসময় একেবারে চুপসে গিয়ে নক্ষত্রটি একটা বিন্দুর আকার ধারণ করে। অবশ্য জ্যামিতিতে বিন্দুর যে সংজ্ঞা, অতটা খুদে হয় না ব্ল্যাকহোলের আয়তন। আমাদের এই পৃথিবী যদি কোনোভাবে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতো, তাহলে এর ব্যাসার্ধ হতো মাত্র দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটার, সূর্যের ক্ষেত্রে ব্যাসার্ধটা দাঁড়াত সাড়ে ৫ সেন্টিমিটারেরর মতো।

নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হলে তার আয়তনটা শুধু কমে এতটুকু হয়ে যায়, ভর কমে না এক ফোঁটাও। রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে ওঠে তার মহাকর্ষ বল। মহাকর্ষক্ষেত্রের মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হবে। তাই আলো চাইলেও ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এমন রাক্ষুসে মহাকর্ষ টান যে বস্তুর, আলোও যার থেকে রেহাই পায় না, তাকে আমরা দেখতে পাব না এটাই স্বাভাবিক। কোনো বস্তুকে দেখতে হলে তা থেকে আলো প্রতিফলিত হতে হবে, সেই আলো এসে আমাদের চোখের রেটিনায় পড়লে তবেই না আমরা দেখব। তাহলে ব্ল্যাকহোলের যে অস্তিত্ব আছে সেটা আমরা জানলাম কী করে? অন্ধের হাতে সাদাছড়ি থাকে। অসীম মহাশূন্যের ভেতর থেকে ব্ল্যাকহোলকে খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের হাতেও আছে একটা বৈজ্ঞানিক সাদাছড়ি−কোয়ান্টাম মেকানিকস। কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কণাবাদী বলবিদ্যা দাঁড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর। গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সেই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেই বেরিয়ে আসে আরেকটা তত্ত্ব-কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই তত্ত্ব বলে, শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। তার ভেতর লুকিয়ে আছে শক্তি। সেই শক্তির জোগান দেয় ভার্চ্যুয়াল কণারা।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাক দিলেন এক আশ্চর্য কণার খোঁজ। বললেন, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণার একটি করে প্রতিকণা থাকবে। সাধারণ কণা আর তার প্রতিকণার ভর সমান, কিন্তু চার্জ উল্টো। ইলেকট্রন আর পজিট্রনের ভর সমান। কিন্তু পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক। তেমনি প্রোটনের আর অ্যান্টিপ্রোটনের ভর সমান কিন্তু প্রোটন ধনাত্মক আর অ্যান্টিপ্রোটনের চার্জ ঋণাত্মক। নিউট্রনের চার্জ নেই, তবু এর প্রতিকণা অ্যান্টি-নিউট্রন আছে। সেটা সম্ভব হয়েছে কোয়ার্কের কারণে। প্রতি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি হওয়া নিউট্রনই আসলে প্রতি-নিউট্রন। এক জোড়া কণা আর প্রতিকণা পরস্পরের সংস্পর্শে এলে দুটোই ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু শক্তি, আলো বা ফোটন আকারে।

আসলে শূন্যস্থানে সব সময় এই কণা-প্রতিকণার সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলা চলছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতি মুহূর্তে সব জায়গায় তৈরি হচ্ছে কণা আর প্রতিকণার জোড়া। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এরা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার এক জোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই প্রকৃতিতে চলছে ভার্চ্যুয়াল কণাদের ভাঙাগড়ার খেলা। এই ভার্চ্যুয়াল কণাগুলোই হদিস পাইয়ে দেয় ব্ল্যাকহোলের।

শোয়ার্জশিল্ড দেখিয়েছিলেন, কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাসার্ধ খুব ছোট। কিন্তু তার আকর্ষণসীমা অতটা ছোট নয়। মূল কৃষ্ণগহ্বর আসলে ছোট্ট বিন্দু, যেটাকে বলে সিঙ্গুলারিটি। এর বাইরে কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষক্ষেত্র। সেটা কয়েক কিলোমিটার ব্যাসের একটা বৃত্ত হতে পারে। কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যেখানে শেষ, সেটাকে বলে ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon)। কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র থেকে ঘটনা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ব্যাসার্ধকে হলো শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ। এই ব্যাসার্ধের বাইরে অর্থাত্ ঘটনা দিগন্তের বাইরে কৃষ্ণগহ্বরের কোনো আকর্ষণ বল কাজ করে না। তবে এই ঘটনা দিগন্তের একটা ঘটনা ব্ল্যাকহোলকে দৃশ্যমান করে। ঘটনা দিগন্তের খুব কাছে তৈরি হয় ভার্চ্যুয়াল কণার জোড়া। এরা পরস্পরকে ধ্বংস করার আগেই একট পড়ে যায় ঘটনা দিগন্তের ভেতরে। অন্য কণাটা ঘটনা দিগন্তে নাও পড়তে পারে। বেরিয়ে যেতে পারে মহাশূন্যে। এই কণাটিই তখন কৃষ্ণগহ্বর থেকে শক্তির জোগান পায়। সেই শক্তিই বিকিরণ করে কণাটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঘটনা দিগন্তের বাইরে তখন তৈরি হয় বিকিরণ বলয়। এ ধরনের বিকিরণকে বলে হকিং বিকিরণ। আর সেই বিকিরণ বলয় দেখেই হদিস মেলে কৃষ্ণগহ্বরের।

কিন্তু ব্ল্যাকহোলের ভেতরের খবর মেলেনি আজও। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, একটা সম্ভাবনা আছে। তবে সেটা আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার হবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের (Quantum Gravity)। কিন্তু কোয়ান্টাম মহাকর্ষের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা কোনোটাই এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে লাইগো (LIGO), যে যন্ত্র থেকে ২০১৬ সালে হদিস মিলেছে মহাকর্ষ তরঙ্গের।

সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাধারণ আপেক্ষিকতা। আইনস্টাইন চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম মেকানিকসকে একত্র করতে। কিন্তু সফল হননি। এখনকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রতিধ্বনিই দেবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের খোঁজ। সুতরাং তখন আর কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের খবর পাওয়া কঠিন হবে না।

২০১৭ সালের শুরুর দিকে লাইগোতে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছেন তিন তরুণ বিজ্ঞানী। কানাডার ওয়াটার লুর পেরিমিটার ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিকসের গবেষক জাহেদ আবেদি, হান্নাহ ডাইকার ও নাইয়েশ আশরফদি। তিন গবেষক একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলছেন, ব্ল্যাকহোল থেকে আসা মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রতিধ্বনি বিশ্লেষণ করে বের করা যেতে পারে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের খবর। সেটা করতে গিয়েই হয়তো পাওয়া যেতে পারে আইনস্টাইনের মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের নীতি। তাই যদি হয়, বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা বৈজ্ঞানিক রহস্যগুলোর সমাধান পেয়ে যেতে পারি অচিরেই।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: ডেইলি গ্যালাক্সি ডট কম

*লেখাটি ২০১৭ সালের বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত