শব্দগুলো বিজ্ঞানের

কথায় বলে, নামে কীই-বা আসে যায়। কিন্তু তারপরও দৈনন্দিন জীবনে নামের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। নতুন কিছুকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করাসহ নানা কারণেই নাম দিতে হয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। আর এসব নামের পেছনেও অনেক সময় বেশ মজার ইতিহাস বা গল্প লুকিয়ে থাকে। বিজ্ঞানের অতিপরিচিত তেমন কিছু শব্দের পেছনের কথা থাকছে এবার।

লেন্স

অনেক আগে থেকেই মানুষ জানত বাঁকানো কাচের ভেতর দিয়ে তাকালে যেকোনো বস্তুকে বড় দেখা যায়। খালি চোখে অনেক কিছু দেখা না গেলেও এই কাচের ভেতর দিয়ে জীবদেহের অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপারও বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যেত। কিন্তু এর কারণ তখনো কেউ জানত না। এমনকি ১৬৫০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানী এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাননি। সে সময় এ ধরনের বাঁকানো কাচকে বলা হতো লেন্স (lenses) বা আতশ কাচ। শব্দটি এসেছিল লাতিন শব্দ লেনটিল (lentil) থেকে, যার অর্থ মসুর ডাল। কারণ কাচের এই টুকরোর আকার অনেকটা মসুর ডালের মতোই।

মধ্যযুগে ছোট্ট জীবন্ত কোনো কিছু লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখায় সাধারণত একাধিক লেন্স ব্যবহার করা হতো। বস্তু দেখার সময় লেন্সগুলোকে নির্ধারিত স্থানে রাখতে একটি ধাতব টিউবের দুই প্রান্তে লেন্স বসানো থাকত। এ ধরনের টিউবকেই বলা হতো মাইক্রোস্কোপ। বাংলায় বলা হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্র। শব্দটি এসেছিল গ্রিক থেকে, যার অর্থ ছোট জিনিস দেখা। এর মাধ্যমে অনেক ছোট ছোট জীব দেখতেন সেকালের বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে মাছি দেখতেন তাঁরা। সে কারণে প্রথম দিকের মাইক্রোস্কোপের আরেক অর্থ মাছি দেখার কাচ।

ধমনি

খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে গ্রিসের বিখ্যাত চিকিত্সক ছিলেন প্রাক্সাগোরাস। মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে তিনি মানুষের রক্ত চলাচল-প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। একসময় তিনি প্রমাণ করে দেখালেন, দেহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কয়েকটি টিউব বা নল হূিপণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। এগুলো আসলে রক্তনালি। এসব নলের কয়েকটি রক্ত দিয়ে পরিপূর্ণ। এদের মধ্যে একধরনের নল বা নালিকে আমরা বলি ভেইন (vein) বা শিরা (রগ)। লাতিন শব্দ ভেনা অর্থ রক্তনালি। সেখান থেকেই ইংরেজি ভেইন শব্দ এসেছে।

গবেষণা করতে গিয়ে আরেক ধরনের নালিও হূিপণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাক্সাগোরাস। তবে সেগুলো খালি। এ নালিগুলোতে শুধু বাতাস দিয়ে ভরা থাকতে দেখেছিলেন প্রাক্সাগোরাস। বাতাস ভরা এই নালিগুলো দেখে প্রাক্সাগোরাস ভেবেছিলেন, এই দ্বিতীয় ধরনের নালিগুলো শরীরের বিভিন্ন অংশে বাতাস বহন করে নিয়ে যায়। সে কারণে তিনি গ্রিক শব্দ থেকে ধার করে এই নলগুলোর নাম দিলেন আর্টারিজ (arteries) বা ধমনি, যার অর্থ ‘বায়ু বহনকারী’।

আধুনিক কালে আমরা জানি ধমনি আসলে বাতাস বহন করে না। বরং এই নালিটি হূিপণ্ড থেকে বিশুদ্ধ বা অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশে বহন করে নিয়ে যায়। কিন্তু এখনো আমরা সেই ভুল নামটিই ব্যবহার করি।

কোষ

১৬৬৫ সাল। ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে এক টুকরো পাতলা কর্ক নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। কর্ক হচ্ছে একটি গাছের ছাল। এটি মৃত কোষ। খালি চোখে কর্ক দেখতে ঘন বলে মনে হয়। কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এটি ছোট ছোট আয়তাকার গহ্বর বা গর্তের বিন্যাস দেখতে পাওয়া যায়। রবার্ট হুক এসব ক্ষুদ্রাকার গর্তের নাম দিলেন কোষগুচ্ছ (cells)। সাধারণত ছোট ঘরকে ইংরেজিতে সেল বলা হয়, সে কারণেই এমন নাম দিয়েছিলেন তিনি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: হাউ উই ফাইন্ড অ্যাবাউট জার্মস, ইলেকট্রিসিটি, ব্ল্লাড, জিনস/ আইজাক আসিমভ