সন্তান কেন বিজ্ঞান পড়বে?

বিজ্ঞান পড়লেই চাকরি নিশ্চিত নয়ছবি: সুমন ইউসুফ

অনেকেই ভাবেন সন্তান বিজ্ঞান পড়লে ভালো চাকরি পাবে, বিদেশে যেতে পারবে, কোনো দিন টাকাপয়সার অভাব হবে না। বিজ্ঞান পড়লে অনেক বড় বাড়ি থাকবে, দামি গাড়ি থাকবে, জীবনে কোনো দুঃখ–কষ্টের লেশমাত্র থাকবে না। এ ধারণা ভুল। বিজ্ঞান পড়লেই নিশ্চিত বা সুন্দর ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিজ্ঞান পড়ার পরও মানুষ অসুখী হতে পারে। তার শত্রু থাকতে পারে, বিদেশে না–ও যেতে পারে, এমনকি প্রচলিত অর্থে ভালো চাকরি হবে, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিজ্ঞান ব্যবহার করে টাকাপয়সা উপার্জন করা যায় বটে, তবে বিশেষ মাত্রার বেশি টাকা উপার্জনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর দামি বাড়ি, দামি গাড়ি...এর সঙ্গে বিজ্ঞান পড়ার সহজ–সরল কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে অসুখ–বিসুখের সঙ্গেও বিজ্ঞান পড়ার কোনো সরল সম্পর্ক নেই। বিশ্বখ্যাত অনেক বিজ্ঞানীর জীবন গেছে নানা টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক...বিজ্ঞান পড়ে আপনার সন্তান কি সফল হবে, না বিফল হবে, এখানে দৃষ্টিভঙ্গিরও বড় একটি ভূমিকা আছে। সুতরাং বিজ্ঞান পড়া আর চোখ–ধাঁধানো বড় বড় সুবিধার মধ্যে কোনো প্রকার সরল রৈখিক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দেবেন না?

তারপরও সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিন। জীবনে সব ভালোর নিশ্চয়তা বিজ্ঞান না দিতে পারলেও আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিন। কেন? এর অনেক কারণ আছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বড় একটি শিক্ষা হলো আশপাশের জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হতে পারা। কোনটা কীভাবে কাজ করে, এগুলো শিখতে হয়। বলতে গেলে এখান থেকেই বিজ্ঞানের শুরু। বিজ্ঞান বলতে যে শুধু বই পড়েই জানতে হবে, তা কিন্তু নয়। পরিবেশ থেকেও বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করা যায়, যে বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই মানুষ ব্যবহার করে যাচ্ছে। পরিবেশ থেকে আসা বিজ্ঞানের জ্ঞান সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে যাচ্ছে ঠিকই, তবে হয়তো গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। যেমন একজন সাইকেলচালক—তিনি জানেন কখন পা দিয়ে প্যাডেলে চাপ দিতে হবে। এতে তিনি বিজ্ঞানের টর্ক ব্যাপারটা ব্যবহার করেন। টর্ক যখন সবচেয়ে বেশি হবে, তখনই তিনি প্যাডেল চাপ দেন। এই সাইকেল চালাতে চালাতেই তিনি বিজ্ঞানের এই জ্ঞান রপ্ত করেছেন।

আমাদের সবারই একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মেধা আছে। এই মেধার চর্চা করেই আমাদের বাঁচতে হয়। হাঁটাচলা থেকে শুরু করে রকেট চালানো পর্যন্ত সবকিছুতেই কাজে লাগে এই মেধার চর্চা। এমনকি ঘরের যে ভাত রান্না, সেখানেও আছে মেধার চর্চা, রেসিপি বলে দিলেই সবাই ভালোভাবে ভাত রান্না করতে পারে না। ভাত রান্নারও একটি চর্চা থাকতে হয়। মেধার চর্চার জন্য বিজ্ঞান একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো গণিত! এই গণিত খুব সাধারণ নিয়মে চলে, দুই যোগ দুই সব সময়ই চার, দিনে–রাতে, ঘরে–বাইরে, ট্রেনে, প্লেনে সব সময় এবং দুই যোগ দুই সবখানেই চার—গণিতের এই নিয়ম যেমন খুব সরল, তেমনি প্রকৃতিজগৎও চলে খুব সরল নিয়মে, যদিও এর গাণিতিক ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কঠিন বলে মনে হয়, এই কঠিনের একটি বড় কারণ হলো আমাদের বিজ্ঞান এবং গণিতের চর্চার অভাব।

তবে বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে চাকরি পাওয়ার বড় একটি যোগ আছে। বিশ্বের বেশির ভাগ চাকরিই বিজ্ঞাননির্ভর। সে জন্য বিজ্ঞান পড়লে চাকরি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। কিন্তু ধরুন, আপনার সন্তান চাকরি করবে না, ক্রিকেটার হতে চায়। সেখানেও যদি বিজ্ঞানের কিছু কিছু ধারণা তার মধ্যে থাকে, তাহলে সে হয়তো সেগুলোও কাজে লাগাতে পারে। কারণ, একজন বোলারের বল করা এবং একজন ব্যাটসম্যানের ব্যাট করার মধ্যে থাকে অনেক ধরনের জটিল বিজ্ঞান। ক্রিকেটাররা হয়তো গাণিতিকভাবে না বুঝেই ক্রিকেটের চর্চা থেকে এই বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছেন। ঠিক আছে, আপনার সন্তান ক্রিকেটার হবে না, নিখাদ কবি হবে। সে ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান জানা থাকা দরকার, হয় বিজ্ঞান পড়ে, না হয় কবিতার চর্চা করে। কবি তো পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষের মন—এগুলো নিয়েই কাজ করেন! এগুলোর সঙ্গেও যে অনেক অনেক বিজ্ঞান জড়িত! বাঁশি বাজাতে গেলেও বিজ্ঞান লাগে। সুতরাং যেকোনো কিছু করতে গেলেই বিজ্ঞান লাগে, হয় চর্চা থেকে বিজ্ঞানের জ্ঞান পেয়ে যায়, না হয় বই থেকে। এমনকি ব্যবসা করতেও যে বিজ্ঞান লাগে, গণিত লাগে! সুতরাং চাকরি বা জীবনধারণের জন্যও আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিতে হবে।

কিছুটা হলেও জীবন-জীবিকাসহ সবকিছুতেই বিজ্ঞানের একটি সম্পর্ক তুলে ধরা হলো। এরপর হলো, আমাদের বেঁচে থাকতে হয় প্রকৃতিজগতে। প্রকৃতিজগতের সঙ্গে আমাদের যে মায়া, মমতা, প্রেম–ভালোবাসা, এসবের মূলেই হলো আমাদের ভাবতে পারার ক্ষমতা। বিজ্ঞান পড়লে আমাদের ভাবতে পারার সীমাটা অনেক বেড়ে যায়। একবার ভাবতে শুরু করলে প্রকৃতিজগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও অন্য মাত্রায় চলে যেতে পারে। এর সঙ্গে যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা যোগ হয়, তখন একজন মানুষ অনায়াসেই সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। যেমন রোদের ভেতর দরজা বন্ধ গাড়ির ভেতরে গরম বেশি, কারণ আলো জানালা দিয়ে ঢুকতে পারে, আর এর জন্য ভেতরের অংশ গরম হয়ে যায়, যা কিনা বিকিরণ করতে থাকে, কিন্তু সেই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি, যা কাচ দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে না। ঠিক এ কারণে পৃথিবীও গরম থাকে, সূর্য থেকে আলো এসে পৃথিবী গরম হয়ে যায়, তখন পৃথিবীও বিকিরণ করতে থাকে, যার পুরোটা বাতাস ভেদ করে পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। কারণ, বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার ওপর, যত বেশি গরম তত ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রিনহাউস ইফেক্ট, যার জন্য পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে, গলে যেতে পারে মেরু অঞ্চলের বরফ, তখন বেড়ে যাবে সমুদ্রে পানির উচ্চতা, শুরু হতে পারে বড় ধরনের অনাসৃষ্টি! এ ধরনের ভাবনা থেকে মানুষ নিজে সচেতন হতে পারে, ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে বিশ্ব, পরিশেষে যা বয়ে আনতে পারবে প্রকৃতির মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য, যা আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি।

সুতরাং আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিন। বিজ্ঞানের যেকোনো মাত্রাতেই আনন্দ আছে। নিছক জানা থেকে মানুষ যেমন আনন্দ পায়, একটি জিনিস পুরোপুরি কীভাবে কাজে লাগে, এটা জানতে পারলে মানুষের মধ্যে আনন্দের মাত্রাটাও বেড়ে যেতে পারে—অবশ্য কথাটা ব্যক্তিনির্ভর! প্লেন আকাশে উড়তে দেখলে অনেকেরই ভালো লাগে। অনেকের মতো আমিও মুগ্ধ হয়ে আকাশে উড়তে থাকা প্লেন চেয়ে দেখি। ভাবতেই অদ্ভুত লাগে, এত ভারী একটি জিনিস বাতাসে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। এখন যদি প্লেনের ওড়া সম্পর্কে একটু ধারণা থাকে, তখন ভাবনাটা আরও ছড়িয়ে যায় এবং গভীরেও যায়। তখন কীভাবে এত ভারী একটি প্লেন আকাশে উড়ছে, এটা ভাবতে পারলে আনন্দ আরও বেড়ে যেতে পারে। আর অনেক বিজ্ঞান পড়াশোনা করে প্লেনের গতিতে কোনো পরিবর্তন আনা বা কম জ্বালানিতে প্লেন চালানোর উপায় বের করা যেমন বিজ্ঞানের অনেক বড় একটি প্রয়োগ, ঠিক একই সঙ্গে নিজের জীবনে অনেক বড় বেতনের একটি চাকরিও নিশ্চিত করা যেতে পারে।

বর্তমানে বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। হাতের কাছে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কম্পিউটার। একটি কম্পিউটারে যে কত কিছু করা যায়, বলে শেষ করা যাবে না। আর ভাবতে গেলে তো কথাই নেই, অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে যায়। একই সঙ্গে একটি মুঠোফোনের কথাও ভাবা যেতে পারে। একটি ভালো মানের স্মার্টফোন আসলে একটি কম্পিউটার, একটি ভিডিও ক্যামেরা, একটি নরমাল ক্যামেরা, একটি জিপিএস সিস্টেমের ভেতরে যে কত কত ফাংশন! এই ফাংশনগুলোর মূলে হলো বিজ্ঞানের অনেক অনেক জটিল প্রয়োগ। বলতে গেলে এগুলো বই না পড়ে বোঝা একেবারেই অসম্ভব। আর একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, টাচ স্ক্রিন কত দিন হলো বাজারে এসেছে, এটা কীভাবে কাজ করে, বুঝতে পারলে তো খুবই ভালো কথা। কম্পিউটার আর স্মার্টফোনের বাইরে একটি ভালো উদাহরণ হলো টিভি। গত দুই দশকে টেলিভিশনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক জায়গা দখল করা আর ভারী টিভি থেকে এখন খুব হালকা আর অল্প পরিসরে আঁটানো যায়, এ রকম টিভি বাজারে এসেছে এবং সাধ্যের মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই এক্স–রে ফিল্মের মতো চিকন টিভি চলে আসবে। সুতরাং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য, শিক্ষা–দীক্ষা সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে এবং সামনে আরও বড় বড় পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে আমাদের জীবন ও জীবিকারও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চাইলে বিজ্ঞান না পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

বিজ্ঞান পড়া নিয়ে আরও অনেক কথাই বলা যায়। আমাদের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। দিন–রাত্রি, জোয়ার–ভাটা, অমাবস্যা–পূর্ণিমা, শীত–গ্রীষ্ম, সূর্যগ্রহণ–চন্দ্রগ্রহণ—এই সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান, যার পেছনে থাকে কার্যকারণ। এগুলো জানাটা বেশ আনন্দের এবং জরুরিও বটে! প্রকৃতিজগতের খুব সুন্দর একটি ব্যাপার হলো কার্যকারণ। এই কার্যকারণ ভাবতে গেলেই বিজ্ঞানের আনন্দটা খুব সহজে ধরা যায়। আর এর গভীরে গেলে তো কথাই নেই, প্রকৃতিজগতের ভেতরের কথাও জানা যায়। তবে এগুলোর আর কোনোটাই সাদামাটাভাবে ভাবার কোনো বিষয় নয়, ভাবতে গেলে কিছু না কিছু জানতে হয়, জানতে গেলে বিজ্ঞান পড়তে হয়। আর বুঝতে গেলে রীতিমতো বিজ্ঞান নিয়েও ভাবতে হয়। আর মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এই ভাবতে পারা। আর জীবনে ভাবতে পারাটাই বড় একটি আনন্দ। সাধারণ মানুষের ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞান খুবই বড় একটি ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিন।

আকাশ দেখে কে না মুগ্ধ হয়! দিনের আকাশ, রাতের আকাশ, মেঘলা আকাশ, সন্ধ্যার আকাশ, ভোরের আকাশ—বিজ্ঞান না জেনেও বিভিন্ন সময়ের আকাশ দেখে মানুষ মুগ্ধ হতে পারে। দিনের আকাশের সূর্যের গতিবিধি, রাতের আকাশে চাঁদ আর তারাদের গতিবিধি দেখায়ও মুগ্ধতা আছে। এর সঙ্গে যদি বিজ্ঞানের একটু জ্ঞান যোগ করা যায়—গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, উল্কা, স্যাটেলাইট—তখন আকাশ নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের মাত্রাটা আরও বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।

সবশেষে আরেকটি কথা বলতে চাই, আর তা হলো প্রত্যেক মানুষই বিশ্বের একটি বিশেষ সম্পদ। ভাবতে পারার সঙ্গে সমাজ এবং পরিবেশের দায়বোধ থেকে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে বিশেষভাবে সচেতন, নিজেকে গড়ে তুলতে পারে বিশ্বের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে। এই ভাবতে পারার পেছনে থাকতে পারে বিজ্ঞানের বিশেষ একটি ভূমিকা। তাই আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান পড়তে দিন, ওর মাঝে ভাবনার বীজ বুনে দিন এবং মনের ভেতর গেঁথে দিন সুন্দর কিছু স্বপ্ন, যেগুলো আঁকড়ে ধরেও নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে একজন বিশ্বমানের সম্পদ হিসেবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়