সন্ধান মিলেছে পৃথিবীর পঞ্চম স্তরের

ভূমিজ্ঞানের একদম বেসিক নীতি থেকে আমরা জানি, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠণ চার স্তরবিশিষ্ট। ক্রাস্ট বা ভূত্বক, ম্যান্টল, আউটার কোর বা বহিঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল এবং ইনার কোর বা অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল। এই স্তরগুলো পেঁয়াজের মতো বিন্যস্ত।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সম্প্রতি ইনার কোরের ভেতরে পঞ্চম আরেকটি স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই স্তরটাকে বুঝতে পারলে পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন, এর ইতিহাস ও ক্রমপরিবর্তনের ব্যাপারে আরও ভালভাবে বোঝা সম্ভব হবে।

প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী গঠিত হয়। শুরুটা হয়েছিল এর পাথুরে কেন্দ্র গঠিত হওয়ার মাধ্যমে। ভারী মৌলের সংঘর্ষের ফলে এটি গড়ে ওঠে। এই কেন্দ্রটি দুই স্তরে বিভিক্ত। বহিঃস্থ স্তরটি মূলত তরল লৌহ-সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি। এর পুরুত্ব প্রায় ১,৩৫৫ মাইল। অন্তঃস্থ কেন্দ্রটির পূরত্ব এর অর্ধেকের মতো, প্রায় ৭৬০ মাইল। এই অংশটিও লোহার সংকর ধাতু দিয়েই গঠিত। তবে এখানে লোহা তরল নয়, কঠিন। আসলে, বহিঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডলে তাপ অসম্ভব বেশি হলেও চাপ অতটা বেশি নয়। তাই লোহা এখানে গলে যায়। অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডলে তাপের পাশাপাশি চাপও অনেক বেশি। এই চাপের ফলে লোহা গলে যেতে পারে না। ধারণা করা হয়, এই অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল-ই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের জন্য দায়ী।

কেন্দ্রের ওপরে আছে ম্যান্টল। বাংলায় বলে ভূ-আচ্ছাদন। মূলত ম্যাগনেসিয়াম এবং লোহা-সমৃদ্ধ সিলিকেট পাথরে গড়ে উঠেছে এই অংশটি। এর পুরুত্ব ১,৭৯৩ মাইলের মতো। এর ওপরে আছে ভূত্বক। যার পুরুত্ব স্থানভেদে ১৮.৬ থেকে ৪৩.৫ মাইলের মতো হয়।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন, অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল হয়তো একাধিক স্তরে বিভক্ত। কিন্তু এতদিন এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সম্প্রতি এর প্রমাণ পেয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসানো সিসমোগ্রাফ স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে, ভূমিকম্প-তরঙ্গ পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের ভেতর দিয়ে কী বেগে ছুটে যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। সেই গবেষণা থেকেই বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। এই স্ত্ররটিকে বলা হচ্ছে ‘ইনারমোস্ট ইনার কোর’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, গভীরতম অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল।

আগেই বলেছি, অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল গড়ে উঠেছে কঠিন লৌহ-সংকর ধাতু দিয়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই অংশটির সবখানে লোহার সংকর ধাতু একরকম নয়। অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডলে, ভূপৃষ্ঠের ৩,৬০৪ মাইল নিচে এই দেখা যাচ্ছে খানিকটা ভিন্নতা। অর্থাৎ, গভীরতম অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডলের শুরু। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর জন্মলগ্নে বা কাছাকাছি কোনো সময়ে খুব নাটকীয় কিছু একটা হয়েছিল। কী হয়েছিল, তা আমাদের অজানা। কিন্তু সেই ঘটনার জন্যই ওই অংশটুকুতে এরকম ভিন্ন আরেকটি স্তর গড়ে উঠেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক কিছুই আজও আমাদের অজানা। বিশাল এক পাজলের অল্প কিছু টুকরো আমরা হাতে পেয়েছি। গভীরতম অন্তঃস্থ কেন্দ্রমণ্ডল আবিষ্কারের মাধ্যমে আমার জ্ঞানের পরিধিতে নতুন আরেকটি টুকরো যোগ হলো। এখনো এসব তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ পুরোপুরি শেষ হয়নি। তবে গবেষক দলের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তাঁদের এ আবিষ্কারের ফলে শিগগিরই ভূবিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলো নতুন করে লিখতে হবে।

সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন