সাফল্য আর ব্যর্থতার স্ট্রিং তত্ত্ব

গত সংখ্যায় স্ট্রিং তত্ত্বের ইতিহাস নিয়ে সামান্য আলোচনা করেছিলাম। সেখানে এই তত্ত্বের কয়েকটি সাফল্যের কথাও বলেছি। এই পর্বে মূলত সাফল্যগাথার বর্ণনা করেছি। গত আলোচনায় স্ট্রিং তত্ত্বের যেসব সাফল্যের কথা বলেছি, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মাধ্যাকর্ষণের জন্য দায়ী গ্রাভিটন কণা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আর স্থানকালের (দেশকাল) মাত্রা নির্ধারণ। পাশাপাশি একটি স্থিতিশীল সর্বনিম্ন শক্তির দশা পাওয়ার জন্য এই তত্ত্বে অতিপ্রতিসাম্য (Supersymmetry) থাকা প্রয়োজন। এর ফলে তত্ত্বের মধ্যে ফার্মিয়ন (অর্থাত্ কোয়ার্ক ও লেপ্টন গোত্রের মৌলিক কণাগুলো) পাওয়া সম্ভব। আবার দেশকালের মাত্রা (Spacetime Dimensions) চারের বেশি হওয়ার কারণে বিজ্ঞানী থিওডর কালুজার চিন্তা অনুসারে মাধ্যাকর্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য মৌলিক মিথস্ক্রিয়ারও জন্ম দেবে। এটা অত্যন্ত আশাপ্রদ, কারণ, কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বের নিয়ম মেনে তত্ত্ব দাঁড় করাতে গেলে আমাদের প্রতিটি মিথস্ক্রিয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফিল্ড ব্যবহার করতে হবে।

আপাতদৃষ্টিতে তত্ত্বের মধ্যে আমাদের পরিচিত বিশ্বের অনেক উপাদান থাকলেও সেটা আসলে কতটুকু বাস্তবতাকে ধারণ করে? একটা ছোট্ট তুলনা দেওয়া যাক: ছাগল ও গরুর উভয়েরই চারটি পা, খুর, শিং আছে আর দুটি প্রাণীই তৃণভোজী। কিন্তু গরুর মতো ছাগল দিয়ে হালচাষ করা যায় না। কোনো তত্ত্ব ঠিক কি না, তার চূড়ান্ত নির্ধারক হলো পরীক্ষণ। আর পাশাপাশি এই পরীক্ষণ এমন হতে হবে, যাতে এই পরীক্ষণটা আবারও করা যেতে পারে। যেমন আমরা শুনে থাকি যে গ্যালিলিও নাকি পিসার হেলানো মিনার থেকে কাঠের ও লোহার বল ফেলে দিয়ে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ ম যে উভয়ের জন্য সমান তার চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়েছিলেন। তিনি আসলেই সেটা করেছিলেন কি না, ব্যাপারটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে কিন্তু এই পরীক্ষা যেকোনো জায়গায় এমনকি অ্যান্টার্কটিকায় করা যায়। আর তার ফলাফল আমরা একই পাব। অবশ্য এর একটি বিশাল ব্যতিক্রম আছে। সেটি হচ্ছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি। আমাদের পক্ষে এটা বারবার করা সম্ভব নয়। আমাদের হাতে এর জন্য উপাত্ত (data) একটিই আছে। যা-ই হোক, পরীক্ষণের কাঠগড়ায় কতটুকু সফল—স্ট্রিং তত্ত্বকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন করা গেলে কী উত্তর আসে তা দেখা যাক।

স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে যে উচ্চাশা তা মূলত ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু। কোনো কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রণয়নের আগে তার বলবিজ্ঞানের সনাতনী (Classical) ভাষার সমকক্ষের চিত্রটি আমাদের জানতে হয়। কারণ, আমরা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের ভাষা ব্যবহার করে পরিমাপ করি না। এখন এ রকম যদি হয় যে চিরায়ত তত্ত্বে যে রকম প্রতিসাম্য (Symmetry) আছে তা কোয়ান্টাম জগতে নেই, তাহলে একটা যৌক্তিক সমস্যার সামনে আমাদের পড়তে হয়। সেটা হলো, কোয়ান্টাম হচ্ছে ক্ষুদ্র বস্তুর জগত্, আর নিউটনীয় বা সনাতনী জগত্ তারই সামষ্টিক প্রতিরূপ। সে জন্য আমরা যদি কোনো প্রতিসাম্য সনাতনী তত্ত্বে দেখি, তাকে অবশ্যই একই তত্ত্বের কোয়ান্টাম ভার্সনে দেখে নিতে হবে। যদি না হয়, তবে সে তত্ত্বে অসংগতি (Anomaly) আছে বলে আমরা ধরে নিই। আমাদের বর্তমানের সবচেয়ে সফল যে মডেল অর্থাত্ স্ট্যান্ডার্ড মডেল, সেখানে কোয়ার্ক আর লেপ্টন পরিবারের সংখ্যা সমান। কারণ এটা না হলে মডেলটির সনাতন রূপ আর কোয়ান্টাম রূপের মধ্যে পার্থক্য থাকত। এই ব্যাপারটা থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে সঠিক তত্ত্বের কোয়ান্টাম রূপের মধ্যে এ রকম অসংগতি থাকতে পারবে না। এত কিছু বলার পেছনে কারণ হলো স্ট্রিং তত্ত্বে যখন অতিপ্রতিসাম্য যোগ করা হলো, তখন ফার্মিয়ন পাওয়ার পাশাপাশি IIA ও IIB নামের দুই প্রকার স্ট্রিং তত্ত্ব পাওয়া গেল। আরও রইল খোলা স্ট্রিংয়ের তত্ত্ব—যেটাকে আমরা টাইপ ও বলে অভিহিত করি।

এসব সুপারস্ট্রিং তত্ত্বকে কোয়ান্টায়িত করতে গিয়ে দেখা গেল, যদি স্থানকাল দশ মাত্রার তত্ত্বের মধ্যে SO(32) অথবা E8 x E8 গ্রুপের প্রতিসাম্য না থাকে, তাহলে সেই তত্ত্বটি অসংগতিপূর্ণ হয়। এটা সেই সময় বিশাল একটি আলোড়ন তৈরি করেছিল। কারণ, এই প্রথম কোনো তত্ত্ব তার দেশ-কাল-মাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি তার অভ্যন্তরীণ প্রতিসাম্যও ঠিক করে নিল। এ কারণেই তখন থেকে সুপারস্ট্রিং তত্ত্বকে সবকিছুর তত্ত্ব (Theory of Everything বা ToE) হিসেবে অভিহিত করা হতে লাগল। আর এর মাঝেই অনেকে পদার্থবিজ্ঞানের শেষ সীমান্ত খুঁজতে লাগলেন। স্বভাবতই ৩০ বছর ধরে টানা গবেষণার কারণে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে ১৯৯৫ সালের দিকে এডওয়ার্ড উইটেনের স্ট্রিং তত্ত্ব সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার এই চাওয়াটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে সব মিলিয়ে পাঁচ ধরনের সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব থাকলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। উইটেন দেখান, পাঁচটি তত্ত্বের প্রতিটিকেই নানা ধরনের রূপান্তরের (Transformation) মাধ্যমে অন্য সুপারস্ট্রিং তত্ত্বে পরিবর্তিত করা যায়। শুধু তা-ই নয়, সুপারস্ট্রিংয়ের সঙ্গে আপাতভাবে সম্পর্কিত নয় এ রকম ১১ মাত্রার সুপারগ্রাভিটি, যার অস্তিত্ব তাত্ত্বিকদের কাছে একটি রহস্য ছিল, তা-ও এই উইটেনের আবিষ্কৃত জালের মধ্যে ধরা পড়ল। উল্লেখ্য, সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব থেকে যেসব সুপারগ্রাভিটি তত্ত্ব পাওয়া যায়, সেগুলোর স্থান-কাল-মাত্রা হলো ১০। এরপর থেকে অনেকেই ধারণা করতে লাগলেন, স্ট্রিং তত্ত্বে আদতে মৌলিক তন্তুর ভেতরেও আরও কিছু আছে।

বিজ্ঞানী থিওডর কালুজা

এই ধারণার সপক্ষে যুক্তি আরও জোরালো হলো যখন ১৯৯৫ সালে জোসেফ পোলচিনস্কি সুপারস্ট্রিং তত্ত্বের মধ্যে ডি-ব্রেন (D-Brane) নামের বস্তু আবিষ্কার করলেন। এর ফলে এই তত্ত্বের মাঝের একটা পুরোনো ধাঁধার সমাধান ঘটল। ধাঁধাটা কী, সেটা একটু বলি। আগের সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম যে সুপারস্ট্রিং তত্ত্বের স্ট্রিংয়ের টানের মান অসীম হলে সেখানে শুধু ভরহীন কণার সমাবেশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা-২বিশিষ্ট গ্রাভিটন এবং এর অতিপ্রতিসাম্যের বা Supersymmetric পার্টনার স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা-৩/২ বিশিষ্ট গ্রাভিটিনো। সে জন্য এই তত্ত্ব থেকে আমরা মামুলি আইনস্টাইনীয় মাধ্যাকর্ষণ পাই না। বরং এর Supersymmetric পরিমার্জন, যাকে আমরা ওপরে সুপারগ্রাভিটি বলে অভিহিত করেছি। এখানে একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো যে এই সুপারগ্রাভিটিগুলোতেও আইনস্টাইনের তত্ত্বের মতোই কৃষ্ণবিবর (Blackhole) আছে। তবে পার্থক্য হলো এখানকার সব কৃষ্ণবিবরই ভর ও ঘূর্ণনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চার্জ (সেগুলো শুধু আমাদের চেনা বৈদ্যুতিক চার্জ না) থাকে আর এদের মাত্রা (Dimension) আমাদের পরিচিত তিনটির চেয়ে বেশি। চিত্রটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম:

সুপারস্ট্রিং → সুপারগ্রাভিটি → চার্জিত (বেশি মাত্রার) কৃষ্ণবিবর

এখন দেখা দিল ধাঁধাটি—নতুন চার্জগুলো তাহলে মৌলিক কোন বস্তুর কারণে আবির্ভূত হচ্ছে? সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব তো আমরা তারের মতো একমাত্রিক বস্তু দিয়ে শুরু করেছিলাম!

পোলচিনস্কির আবিষ্কারে বোঝা গেল, সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব শুধু স্ট্রিং নয়, বিভিন্ন মাত্রার বস্তু ও তার সমাহারের বর্ণনা দেয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা এই ফলাফলের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলেন যখন কৃষ্ণবিবরের এনট্রপির জন্য হকিং তাঁর গবেষণায় বিখ্যাত ফর্মুলাটি দিলেন। ১৯৯৬ সালে এই উ-ইত্ধহব-এর সমাহার গণনা করে কামরান ভাফা ও অ্যান্ড্রু স্ট্রুমিঞ্জার তাঁর ব্যাখ্যা দিলেন। এতে বোঝা গেল, কৃষ্ণবিবরের কোয়ান্টাম ব্যাখ্যার খুব কাছাকাছি স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা চলে এসেছেন।

তার মানে স্ট্রিং তত্ত্ব কি সফল হয়েছে? নিন্দুকেরা কিন্তু ঠিক বিপরীতটাই বলবে। তাঁদের ভাষায় ‘হকিং বিকিরণ আর কৃষ্ণবিবরের এনট্রপির কোনো সরাসরি প্রমাণ কি পরীক্ষাগারে আমরা দেখেছি?’ আগামী পর্বে তাঁদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করব।

লেখক: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, বর্তমানে ঢাকাস্থ ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত

  • লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত