স্বপ্ন থেকে আবিষ্কার

স্বপ্নে পাওয়া সর্বরোগের মহৌষধের কথা কে না শুনেছে। হাটে বা বাজারে, ট্রেনে-বাসে কিংবা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে রাজধানীর বুকে অনেকটা বুক চিতিয়েই সর্বরোগের ওষুধ বিক্রি করেন অনেকে। সেগুলো নিয়ে ঘোর বিশ্বাসী লোকও সন্দেহের চোখে তাকায়—স্বপ্নে আবার গাছ পাওয়া যায় নাকি! তবে গাছ পাওয়া যাক বা না যাক, স্বপ্নে যে লেখক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী বা গবেষকেরা নতুন নতুন আইডিয়া কিংবা জটিল সমস্যার সমাধান পেয়েছেন, সেটি কিন্তু মিথ্যা নয়। এ কথা শুনে এখনো যাঁরা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন, তাঁদের জানা দরকার, এ তালিকায় আছেন লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসন থেকে শুরু করে গণিতবিদ রামানুজন, আলবার্ট আইনস্টাইনসহ আরও অনেকে। আর আছেন বিখ্যাত রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ অগাস্ট কেকুলে। এ বেলায় জার্মান এই বিজ্ঞানীর স্বপ্নের কথাটাই শোনা যাক। মধ্যযুগে আরব, ইউরোপসহ অন্য দেশগুলোতে সুগন্ধি তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করা হতো ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে। সেখানে জন্মানো একধরনের গুল্মজাতীয় গাছের ছাল থেকে সংগ্রহ করা হতো এই কাঁচামাল। আরবি ভাষায় একে বলা হতো লুবান জায়ি। অর্থাৎ জাভা থেকে আসা লোবান বা ধূপ। কালক্রমে এ শব্দটি ইতালীয় এবং সেখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় ঢুকে পড়ে। তাতে অবশ্য এই লোবানের সুগন্ধের কোনো পরিবর্তন না হলেও শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় গাম বেনজিন বা গাম বেনজামিন। সংক্ষেপে বেনজিন বা বেনজোইন। ১৫ শতকের দিকে এই বেনজিন ইউরোপের সুগন্ধি ও ওষুধশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। তবে ১৮২৫ সালেই এ যৌগটি রাসায়নিকভাবে আলাদা করতে ও শনাক্ত করতে সক্ষম হন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। তিনি এর নাম দেন বাইকার্বোরেট অব হাইড্রোজেন।

এ ঘটনার আট বছর পর গাম বেনজিন থেকে এই যৌগটি তৈরি করতে সক্ষম হন জার্মান রসায়নবিদ ইলহার্ড মিটসচারলিচ। তরল ও হালকা মিষ্টি গন্ধযুক্ত যৌগটিকে তিনি বেনজিন নামেই অভিহিত করেছিলেন। ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সময় অল্প দিনেই বেনজিনের ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। সুগন্ধি ছাড়াও এবার রংশিল্পে যৌগটি ব্যবহার হতে থাকে। মিষ্টি গন্ধের কারণে ১৯ ও ২০ শতকের শুরুর দিকে বেনজিন আফটার শেভ লোশনগুলোতে ব্যবহার শুরু হয়। আবার বিষাক্ত জেনেও ১৯৩৪ সালের দিকে লুডভিগ রোজেলাস নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী এটি কফিতে ব্যবহার করেন। এখন তো ওষুধ, প্লাস্টিক, কৃত্রিম রাবার, রংসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বেনজিন ব্যবহার হয়। মূলত এটি অন্যান্য রাসায়নিক তৈরি করতে মধ্যবর্তী যৌগ হিসেবে ব্যবহূত হয়। ১৯৯৭ সালের দিকে মহাকাশেও বেনজিন শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

খুবই দরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ যৌগ বলে ১৯ শতকের দিকে অনেকেই যৌগটির গঠন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কয়েকজন বিজ্ঞানী তত দিনে বুঝতে পারেন, বেনজিনের মধ্যে ছয়টি কার্বন আর ছয়টি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। তাতে এর রাসায়নিক সংকেত হয় C6H6। কিন্তু এই ব্যাপারটাই তাঁদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কারণ, কার্বন হলো টেট্রাভ্যালেন্ট বা চারযোজী। অর্থাৎ চারটি হাইড্রোজেনের সঙ্গে এটি যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বেনজিনে তো পুরোই ব্যতিক্রম। তাহলে এর গঠন কী হবে? এ নিয়ে তো মহা মুশকিল। রসায়নবিদেরা দিশেহারা। ঠিক সে সময় বেনজিনের রাসায়নিক গঠন নিয়ে আরও অনেকের মতো চিন্তা করেছিলেন কেকুলেও। অন্যরা ব্যর্থ হলেও বেনজিনের সঠিক গঠন বর্ণনা করে ১৮৬৫ সালের দিকে একটি জার্নালে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন তিনি।

১৮৯০ সালে বেনজিন রিং গঠন আবিষ্কারের ২৫তম পূর্তিতে এর আবিষ্কারের রহস্য নিয়ে মুখ খোলেন কেকুলে। তখনই জানা যায় এক মজার ঘটনা। কেকুলের ভাষ্যমতে, ১৮৬৫ সালের দিকে তিনি এক রাতে হঠাৎ স্বপ্নে দেখেন, দুটি পরমাণু নাচতে নাচতে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে সেদিন তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তবে বিষয়টিকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে না দিয়ে তিনি দ্রুত খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন। তারপর স্বপ্নের পরমাণুর নাচনের স্কেচ আঁকতে শুরু করলেন। না, তাতে বেনজিন সমস্যার সমাধান মিলল না।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন চেয়ারে বসে বই পড়তে পড়তে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সে অবস্থাতেই দেখলেন আরেকটি স্বপ্ন। এবার আরও পরিষ্কারভাবে কিছু দেখলেন তিনি। আবারও সেই পরমাণুর নাচন। তবে এবার দেখলেন, অনেকগুলো পরমাণু সর্পিলাকারভাবে চতুর্দিক ঘিরে নাচছে। পরমাণুগুলো নাচতে নাচতে একসময় শুরুর পরমাণুটি সর্পিলাকার আকৃতির শেষ পরমাণুকে যুক্ত করে ফেলল! ঠিক যেন একটা সাপ নিজেই তার নিজের লেজ গিলে ফেলছে, এমন ব্যাপার। এই স্বপ্নই রসায়নের জৈব যৌগের জন্য এক নতুর দ্বার উন্মোচন করেছিল। এই স্বপ্ন থেকেই কেকুলে বেনজিনের সাইক্লিক বা চাক্রিক গঠন সম্পর্কে ধারণা পান। এরপর থেকেই আমরা জানি, বেনজিন রিংয়ে (বলয়ে) ছয়টি কার্বন আর ছয়টি হাইড্রোজেন থাকে। আর এই ছয়টি কার্বন পরমাণু রিংয়ের মতো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং প্রতিটি কার্বনের সঙ্গে একটি হাইড্রোজেন পরমাণুও যুক্ত থাকে। শুধু কার্বন আর হাইড্রোজেন নিয়ে বেনজিন গঠিত বলে একে হাইড্রোকার্বনও বলা হয়। ছয়টি কার্বন মিলে হেক্সাগন বা ষড়ভুজ গঠন করে। একক আর দ্বিবন্ধনগুলোতে প্রতিটি কার্বন-কার্বন বন্ধনের ব্যাপ্তি সমান এবং বেনজিন রিংয়ের ওপরে ও সমতলে থাকা ডিলোকালাইজড ইলেকট্রন বেনজিনকে স্থায়িত্ব এনে দেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ১৮৬৫ সালে অগাস্ট কেকুলের প্রকাশিত জার্নাল, অ্যাক্ট ফর লাইব্রেরি ডটকম ও উইকিপিডিয়া