কলেরা থেকে করোনা: জার্মান বিজ্ঞানীদের অবদান

রয়টার্স

ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির জীবাণুবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর নানা মহামারির জীবাণু ও প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারি করোনার প্রথম প্রতিষেধক আবিষ্কারেও তাঁরা আশার আলো দেখাচ্ছেন।

সেই ১৮৮৩ সালে অবিভক্ত বাংলা যখন ভয়াবহ কলেরা মহামারিতে পর্যুদস্ত, তখন সুদূর জার্মানি থেকে একজন জীবাণুবিজ্ঞানী হেনরিখ হারম্যান রবার্ট কখ কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কলেরা রোগ নিয়ে গবেষণা করা। অবাক করার মতো ঘটনা। ১৩৭ বছর আগে তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে তিনিই কলেরার প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেন।

১৮৮২ সালে রবার্ট কখ টিউবারকিউলাস ব্যাসিলাস নিয়ে যক্ষ্মার জীবাণু খুঁজে বের করেন। তাঁর অসীম ধৈর্য ও গবেষণা কলেরা, যক্ষ্মা ও অ্যানথ্র্যাক্সের মতো রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ ও সংক্রামক ব্যাধির প্রতিষেধকের পথ বাতলেছিল। ১৮৯১ সালে কখ তাঁর গবেষণাকেন্দ্র, বার্লিনের চ্যারিটি ইনস্টিটিউটে আরেক কিংবদন্তি পাউল এরলিসকে যুক্ত করেন। এরলিস পরে সিফিলিস, ডিফথেরিয়া, কেমোথেরাপি পদ্ধতি ও ইমিউনোলজির পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।

বর্তমানে নতুন মহামারি করোনা নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। করোনার মরণছোবলে সর্বত্র মানুষ আতঙ্কিত। ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে করোনার করাল গ্রাসে ১৫ লাখের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। যখন করোনার প্রতাপে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলোর কাহিল অবস্থা, ঠিক তখনই আশার খবর জানাচ্ছে করোনা মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কার।

তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান দম্পতি উগুর শাহিন ও ওজলেম তুরেশিরের হাত ধরে প্রথম করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁরা মধ্য জার্মানির মেইনজ শহরে ২০০৮ সালে জৈব প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিওনটেক প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন অস্ট্রিয়ার হেক্সাল কোম্পানির হুবার ভ্রাতৃদ্বয়। তাঁদের সবার স্বপ্ন ছিল ক্যানসার নিয়ে গবেষণা। বিওনটেক প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় ধরে ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনে কাজ করেছেন তাঁরা।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় তাঁরা বিশেষ জেনেটিক কোড সংবলিত মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) ব্যবহার করে আসছিলেন। রোগীর শরীরে এটি প্রবেশ করিয়ে দিলে সেই সংকেত অনুযায়ী বিশেষ প্রোটিন তৈরি হয় যার বিরুদ্ধে দেহ ক্রমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা অর্জন করে। এটি মূলত হয় অ্যান্টিবডি নামক এক সুরক্ষাদায়ক প্রোটিন উৎপাদনের মাধ্যমে যেটা ওই এমআরএনএ সৃষ্ট প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। এভাবেই রোগীর ক্যান্সার কোষের প্রোটিনের বিরুদ্ধে ইমিউন সিস্টেম তথা সুরক্ষাব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করতেন তাঁরা। গত বছর করোনার আবির্ভাবের পর থেকে এই বিজ্ঞানী দম্পতি তাঁদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রাণিদেহে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম হন। এই কাজে তাঁরা ব্যবহার করেন স্পাইক প্রোটিনের কোড সংবলিত এমআরএনএ। এটাই তাঁদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের মূল উপাদান। কোনো সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে এ প্রযুক্তির ব্যবহার এই প্রথম।

বিশ্বে করোনার প্রথম কার্যকর টিকা বা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারক হিসেবে রয়েছে জার্মানির বিওনটেক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল প্রস্তুতকারক ফাইজার কোম্পানি। তবে এই আবিষ্কারের মূল নেপথ্যে রয়েছেন জার্মানির দুই গবেষক উগুর শাহিন ও ওজলেম তুরেশি।

গত ১০ নভেম্বর তাঁরা প্রথম এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের তৃতীয় ধাপ পরীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল ঘোষণা করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের ভ্যাকসিন করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশের বেশি সুরক্ষা প্রদান করবে। ঘোষণাটি দেওয়ার আগে, তাঁদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন ছয়টি দেশ—জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কে ৪৩ হাজার ৫০০ ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করেছে।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, যেকোনো ভ্যাকসিন অনুমোদিত হওয়ার আগে তা অবশ্যই তিনটি ধাপে পরীক্ষিত হতে হবে। ভ্যাকসিন গবেষক বা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্রথম পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর স্বেচ্ছাসেবকদের একটি ছোট গ্রুপকে এই ভ্যাকসিন দেয়। লক্ষ থাকতে হয়, ভ্যাকসিনটি যথাস্থানে পৌঁছেছে এবং তার তীব্র কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রথম পর্যায় সফল হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে কেবল ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণ বা পূর্ববর্তী অসুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বা ক্ষতিকারক কিছু হচ্ছে কি না এবং উপযুক্ত ডোজ পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় ধাপে অনেক বেশি রোগীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ভ্যাকসিনের কার্যকর সুরক্ষা পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ডোজের পরিমাণ নিশ্চিত করা হয়। এই পর্যায়ে টিকা নেওয়া লোকদের মধ্য বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোও দৃশ্যমান হয়।

অণুজীববিজ্ঞানীরা বলছেন, এত অল্প সময়ে কোন ভ্যাকসিন অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকে। সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও এই আবিষ্কারকে সবাই স্বাগত জানিয়েছেন। অনেকেই আশাবাদী, আগামী বসন্তের মধ্যেই সারা বিশ্বে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে।

বার্লিনের চ্যারিটি মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফেকশন ইমিউনোলজি এবং ভ্যাকসিন রিসার্চ গ্রুপের প্রধান লেইফ-এরিক সান্ডার বলেছেন, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বয়স্কদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে এই ভ্যাকসিন ঠিক একইভাবে কার্যকর কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রতিষেধক গবেষণাটির খসড়া প্রকাশিত হলে এই সংশয় দূর হবে। তারপরও সংক্রমণ হ্রাস ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই ভ্যাকসিন একটি ইতিবাচক খবর।

২ ডিসেম্বর ভ্যাকসিনটি অনুমোদনের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএডি) ও আমস্টারডামে অবস্থিত ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) ইউরোপের কাছে পাঠনো হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে অনুমোদনের জন্য একধরনের প্রাথমিক পদ্ধতিতে আপাতত নিবন্ধন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় কমিশন বিওনটেক এবং ফাইজারের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনের বিষয়ে চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুটি সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তিতে ইইউ ২০ কোটি ভ্যাকসিন সংগ্রহ করবে এবং আরও ১০ কোটি ভ্যাকসিন চাহিদামতো সময়ের জন্য অর্ডার দেওয়া থাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ বছর বা ২০২১ সালের প্রথম দিকে ইউরোপে করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদিত হতে পারে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রতিটি ভ্যাকসিনের মূল্য হবে ১৬ দশমিক ৫০ ইউরো বা ১ হাজার ৬৫০ টাকা।

শীতকালে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোয় করোনার প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কমবেশি একই পরিস্থিতি দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতেও। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইউরোপ, আমেরিকাজুড়ে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এখনো সর্বোচ্চ স্তরে। করোনায় পর্যুদস্ত ইউরোপসহ সারা বিশ্বে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পুরোপুরি লকডাউন ব্যবস্থায় না গিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ইউরোপের কিছু কিছু দেশ আবার পুরোপুরি লকডাউন ও রাতে কারফিউ জারি করেছে। শীতকালের ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এই ভাইরাসের প্রকোপ যে বাড়তে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন।

বিশ্বের মানুষ যখন করোনার প্রকোপে আতঙ্কিত, তখন করোনা ভ্যাকসিনের বিষয়ে প্রথম আশার আলো দেখিয়েছে জার্মানিতে আবিষ্কৃত করোনা নিরাময় ভ্যাকসিন। সারা বিশ্বের গবেষক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল করোনার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন তৈরির। জার্মানির বিওনটেক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার কোম্পানিই প্রথম এই প্রতিষেধক তৈরির ঘোষণা দেয়। এই আবিষ্কারের পরই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি মডার্না, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুতনিক–৫ করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত জার্মানিতে আবিষ্কৃত বিওনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিনের বিষয়েই সারা বিশ্বের দৃষ্টি সবচেয়ে বেশি।

সারা বিশ্বে করোনা মহামারির বিষাক্ত ছোবলে যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতি মহাসংকটে পড়েছে, তখন জার্মানির বিজ্ঞানীদ্বয়ের এই আবিষ্কার সারা বিশ্বে আশার আলো জাগাচ্ছে।

লেখক: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি