বাড়ছে দিনের দৈর্ঘ্য
আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবলই মনে হতে থাকে, সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। একেকটি বছর যেন উড়ে যাচ্ছে ফুড়ুত করে। এর পেছনে অবশ্য গাণিতিক ব্যাখ্যা আছে। আমরা যখন ছোট, ধরুন বয়স যখন চার, তখন মাত্র ১ বছর পুরো জীবনের ৪ ভাগের ১ ভাগ। কিন্তু বয়স যখন ২৫, তখন ১ বছর মানে ২৫ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। এ জন্যই বড় হলে সময় দ্রুত চলে যায় বলে মনে হয়।
তবে বছরগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে বলে মনে হলেও জ্যোতির্বিদেরা বলছেন উল্টো কথা। বছরের দৈর্ঘ্য দিন দিন বড় হচ্ছে। পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর একবার ঘুরে এলে এক দিন হয়। সাধারণত এক বছরে ৩৬৫ দিন। তাই পৃথিবী প্রতিবছর নিজ অক্ষের ওপর ৩৬৫ বার ঘোরে (আবর্তন)। আবার পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে একবার ঘোরে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে। দিন দিন এ সময়ের পরিমাণ বড় হয়ে গেলে বছরের দৈর্ঘ্যও বড় হতে বাধ্য। বাস্তবে এটাই ঘটছে।
পৃথিবীর আবর্তনকাল ধীর হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা চাঁদের। চাঁদের আকর্ষণে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর আকৃতি পরিবর্তন হয়। চাঁদ পৃথিবীর যে দিকে থাকে, পৃথিবীর সে অংশ (বিশেষ করে পানি) চাঁদের আকর্ষণে ফুলে ওঠে। আবার চাঁদের উল্টো পাশের পৃথিবীর পানিও ফুলে ওঠে আকর্ষণ কম থাকার ফলে। এ জন্যই দিনে দুইবার করে জোয়ার-ভাটা হয়। এতে ধীর হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর আবর্তন গতি। আবার চাঁদ ও পৃথিবীর আপেক্ষিক অবস্থান ও দূরত্ব ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই পৃথিবীর বিকৃতিও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হয়, সেই সঙ্গে আবর্তন গতির তারতম্যও হয়। সূর্যের প্রভাব খুবই নগণ্য বলে আপাতত সেটুকু এড়িয়ে যাচ্ছি।
এত দিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, চাঁদের আকর্ষণসহ বিভিন্ন কারণে প্রতি শতকে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ২.৩ মিলি সেকেন্ড করে বড় হচ্ছে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের কিছু গবেষক বলছেন, দিনের দৈর্ঘ্য আসলে বাড়ছে ১.৮ মিলি সেকেন্ড করে। এর পেছনে তাঁরা দায়ী করেছেন পৃথিবীর সমুদ্রস্তর, কোর ও ম্যান্টেলের মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িত্চুম্ব্বকীয় বলসহ নানা কারণকে। অবশ্য এই হারে দিন বড় হলে দিনের দৈর্ঘ্য মাত্র ১ মিনিট বড় হতে সময় লাগবে ৩৩ লাখ বছর! আর ১ ঘণ্টা বাড়তে সময় লাগবে ২০ লাখ শতক!
তাহলে এত নগণ্য হিসাব-নিকাশ করে লাভ কী? প্রথমত বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে দিন দিন অতি সূক্ষ্ম হিসাবের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এর মধ্যে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য খুবই জরুরি একটি বিষয়। ভবিষ্যতে পৃথিবীর ঠিক কী ঘটবে তা জানতেও চাই সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ। সম্প্রতি আরও সূক্ষ্মভাবে দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের হিসাব বের করা হলেও একই সঙ্গে জানা গেছে, এ পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ, আগের তুলনায় বেশি জিনিসের প্রভাব কাজ করছে বলে জানা গেছে।
নতুন এ হিসাব করতে যুক্তরাজ্যের এক দল জ্যোতির্বিদ প্রায় ৩ হাজার বছরের উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭২০ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত। সবচেয়ে প্রাচীন তথ্য পাওয়া গেছে ব্যাবিলনীয়দের লিখিত মাটির ফলকে। এ ছাড়া ব্যবহূত হয়েছে গ্রিক, চীনা, মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের তথ্য-উপাত্ত। বহু বছর ধরে এসব অঞ্চলের মানুষের দেখা সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ থেকে মূলত পাওয়া গেছে এসব উপাত্ত। এই ঐতিহাসিক উপাত্তকে কম্পিউটার নমুনার সঙ্গে তুলনা করেই নেওয়া হয়েছে এ সিদ্ধান্ত।
তবে পৃথিবীর আবর্তন গতির পরিবর্তন সব সময় একই হারে হয়নি। যেমন বরফ যুগে পৃথিবীর সব পানি জমে গিয়ে মেরু অঞ্চলে জমা হয়েছিল। এ সময় কমে গিয়েছিল পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি। এই একই কারণেই আইস স্কেটাররা ঘোরার সময় হাত মেলে ধরলে কমে যায় তাদের ঘোরার গতি। ফলে ভবিষ্যতে ঠিক কী হারে ঘূর্ণন গতির পরিবর্তন হবে, তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক জন মাউন্ড বলেন, ‘ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো এত দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘটে যে আমাদের স্বাভাবিক সময়ের মাপকাঠিতে তার হিসাব করা খুব কষ্টসাধ্য।’
লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়